মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে অনেক বিষয়ে ছেলে তারেক রহমানের মতের মিল হচ্ছে না। স্থায়ী কমিটিতে শূন্য পদ নিয়ে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে।
বিএনপিতে মা-ছেলের দ্বন্দ্ব চলছে—মাঝেমধ্যেই এমন আলোচনা শোনা যায়। নানা বিষয়ে মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছেলে তারেক রহমানের মতের অমিলের কথাও দলের ভেতর আলোচনা আছে। আসলে পরিস্থিতি কী?
গত সেপ্টেম্বরের কথা। ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পান সালাহউদ্দিন আহমেদ, যিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৪ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন। তখন ঢাকা-৫ আসনে প্রার্থী ছিলেন নবীউল্লাহ। তাঁর মনোনয়ন হয় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ইচ্ছায়। এবার নবীউল্লাহর বদলে সেখানে সালাহউদ্দিন আহমেদকে প্রার্থী করতে ভূমিকা রাখেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাদ পড়েন নবীউল্লাহ।
পরিবারের ঘনিষ্ঠজন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-৫ আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী বদল নিয়ে মায়ের সঙ্গে তারেকের একচোট রাগ-অনুরাগও হয়েছে। দলের বিভিন্ন বিষয়ে এমনটা জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গেও হচ্ছে। খালেদা জিয়া দুদকের মামলায় দণ্ডিত হওয়ার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন তারেক রহমান।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, বর্তমান সংসদে বিএনপির সাংসদদের যোগদানের প্রশ্নেও খালেদা জিয়ার সঙ্গে মতভিন্নতা ছিল তারেক রহমানের। ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করার পর নাটকীয়ভাবে সংসদে যোগ দেয় বিএনপি। শেষ মুহূর্তে লন্ডন থেকে এ সিদ্ধান্ত দেন তারেক রহমান। পরে খালেদা জিয়া এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।
পরিবারের ঘনিষ্ঠজন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-৫ আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী বদল নিয়ে মায়ের সঙ্গে তারেকের একচোট রাগ-অনুরাগও হয়েছে। দলের বিভিন্ন বিষয়ে এমনটা জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গেও হচ্ছে। খালেদা জিয়া দুদকের মামলায় দণ্ডিত হওয়ার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন তারেক রহমান।
২০১৮ সালের নির্বাচনে ২০ দলের শরিক জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীদের ‘ধানের শীষ’ প্রতীক দেওয়া নিয়েও দুজনের ভিন্ন অবস্থান ছিল। তারেক রহমানসহ দলের স্থায়ী কমিটির মত ছিল, যেহেতু জামায়াতকে একটু আলাদা রাখতেই বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছে, তাই দলটিকে ‘ধানের শীষ’ না দেওয়াই ভালো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কারাগার থেকে খালেদা জিয়ার বার্তা আসে জামায়াতকে ‘ধানের শীষ’ দেওয়ার।
এ বিষয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকারের ব্যাখ্যা একটু ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামায়াতকে ছাড়ার জন্য চাপ আছে। আমাদের কিছুসংখ্যক লোক এটা চায়। সরকারও তাদের ব্যাক (সহযোগিতা) করছে। কিন্তু বিষয়টি রাজনৈতিক কৌশলগত। ঐক্যের লক্ষ্যেই জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছিল।’
সর্বশেষ সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষ মুক্তি চাননি বলে দলে গুঞ্জন আছে। এ কাজে সমঝোতায় মুখ্য ভূমিকা রাখেন খালেদা জিয়ার ভাইবোনসহ পরিবারের সদস্যরা।
‘জামায়াতকে ছাড়ার জন্য চাপ আছে। আমাদের কিছুসংখ্যক লোক এটা চায়। সরকারও তাদের ব্যাক (সহযোগিতা) করছে। কিন্তু বিষয়টি রাজনৈতিক কৌশলগত। ঐক্যের লক্ষ্যেই জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়া হয়েছিল।’জমিরউদ্দিন সরকার, জ্যেষ্ঠ নেতা ও স্থায়ী কমিটির সদস্য
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, সাইফুল আলম ওরফে নীরবকে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি করা নিয়েও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান অনেকটা বিপরীত অবস্থানে ছিলেন। এ পদে খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরীকে (এ্যানি)। শেষ পর্যন্ত সাইফুল আলমকেই সভাপতি করেন তারেক রহমান। সাইফুল আলমকে এখন বিএনপির মহানগর কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার চিন্তাও আছে বলে জানা গেছে।
এ ধরনের পরিস্থিতি দলের নেতা-কর্মীদের ভেতরে নানা প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। এর রেশ পড়ছে দলের নীতিনির্ধারণে এবং মাঠপর্যায়ে দল পুনর্গঠনেও।
এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির তিনজন সদস্যের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের দাবি, খালেদা–তারেকের মতবিরোধ ‘একেবারে অসত্য’। এর সঙ্গে জমিরউদ্দিন সরকার যুক্ত করেন, ‘অনেক সময় এমন কিছু ইস্যু থাকে, যেগুলো আমরা স্থায়ী কমিটিতে আলোচনার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বলি, আপনি আপনার মায়ের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন।’
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির ১৯টি পদের এখনো চারটি শূন্য আছে। এই শূন্যতা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ নেতাদের তিক্ততার একটা কারণ হয়ে উঠেছে বলেও জানা গেছে। যার বহিঃপ্রকাশ সম্প্রতি তিন ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, হাফিজউদ্দিন আহমেদ ও শাহজাহান ওমর দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করেন।
এ বিষয়ে দলের মহাসচিবসহ পাঁচজন জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলছেন, স্থায়ী কমিটিতে পদ না দেওয়ার মনঃকষ্ট থেকে তাঁরা এই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
নেতা-কর্মীদের অনেকে বলছেন, ২০১৬ সালের মার্চে বিএনপির কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয়। এর ৩৯ মাস পর গত বছরের ১৯ জানুয়ারি দলের স্থায়ী কমিটিতে নেওয়া হয় সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদকে। তখন এ নিয়ে দলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। কারণ, এ সিদ্ধান্তে জ্যেষ্ঠ অনেকে উপেক্ষিত হন। এর রেশ এখনো রয়ে গেছে।
‘দলের প্রধান মুক্ত নন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান দেশের বাইরে—এ রকম একটা পরিস্থিতিতেও দল ঐক্যবদ্ধ। দুটি ভিন্ন মেরুর জোটকে সঙ্গে নিয়ে আমরা একটি নির্বাচনও করেছি। মানুষ ভোট দিতে পারলে ফলাফল কী হতো সবাই জানে। এসব ছোট করে দেখার উপায় নেই।’মির্জা ফখরুল
বর্তমানে দলের স্থায়ী কমিটিতে আছেন ১৫ জন। খালেদা জিয়া মুক্ত নন, তারেক রহমান দেশে নেই। রফিকুল ইসলাম মিয়া গুরুতর অসুস্থ। ভারতে অনুপ্রবেশের মামলায় সে দেশে রয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। স্থায়ী কমিটি থেকে অব্যাহতি চেয়ে চিঠি দিয়েছেন সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান। সেটি গৃহীত হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে এখন সর্বোচ্চ ১১ জনের উপস্থিতিতে সভা হয়।
২০১৬ সালে দলের ষষ্ঠ কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর থেকেই স্থায়ী কমিটি নিয়ে গুঞ্জন চলছে। প্রায়ই খবর হয়, ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আবদুল্লাহ আল নোমান, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও মো. শাহজাহান স্থায়ী কমিটিতে যুক্ত হচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, শূন্য পদগুলো কি পূরণ হবে?
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়ার অবর্তমানে স্থায়ী কমিটিকে নিজের মতো করে তৈরি করতে চাইছেন তারেক রহমান। সে লক্ষ্যে সেলিমা রহমানকে নারী কোটায়, ইকবাল হাসান মাহমুদকে নিজের পছন্দে কমিটিতে আনেন। সামনে যাঁরা এ পদ পাবেন, তাঁরাও এ বিবেচনাতেই আসবেন বলে জানা গেছে।
এ নিয়ে অস্বস্তি আছে জ্যেষ্ঠ নেতাদের। অবশ্য দলে এমন কথাও দীর্ঘদিন থেকে চালু আছে যে জ্যেষ্ঠ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কাজ করতে যতটা স্বস্তিবোধ করেন, তারেক রহমানের সঙ্গে তা পান না। এ প্রসঙ্গে দলের একটি সূত্র গত সেপ্টেম্বর মাসে স্থায়ী কমিটির এক সভায় একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। তিনি জানান, সাংগঠনিক বিষয়ে স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের একটি বক্তব্যে তারেক রহমান যে প্রতিক্রিয়া দেখান, তাতে ওই সদস্য খুবই মনঃক্ষুণ্ন হন। তৎক্ষণাৎ ওই নেতা বলেন, দলের বিষয়ে তিনি আর কখনো কিছু বলবেন না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থায়ী কমিটিতে যেকোনো বিষয়ে দ্বিমতের চর্চা আছে, কিন্তু মূল নেতৃত্ব নিয়ে আমাদের মধ্যে এতটুকুও দ্বিমত নেই।’ তিনি বলেন, ‘দলের প্রধান মুক্ত নন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান দেশের বাইরে—এ রকম একটা পরিস্থিতিতেও দল ঐক্যবদ্ধ। দুটি ভিন্ন মেরুর জোটকে সঙ্গে নিয়ে আমরা একটি নির্বাচনও করেছি। মানুষ ভোট দিতে পারলে ফলাফল কী হতো সবাই জানে। এসব ছোট করে দেখার উপায় নেই।’
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর ওই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন ডেকে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, দল গুছিয়ে তাঁরা আবার আন্দোলন শুরু করবেন। এরপর ২০১৬ সালে দলের সম্মেলন হয় এবং দল পুনর্গঠনে দায়িত্ব বদল হয়েছে তিনবার—আদতে বলার মতো কিছুই হয়নি।
দেশের ৬৪ জেলা ও মহানগরে বিএনপির সাংগঠনিক ইউনিট আছে ৮১টি। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র বলছে, বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে মাত্র ৩৯টি ইউনিটে। ২৩টিতে আহ্বায়ক কমিটি, ১৬টিতে আংশিক কমিটি রয়েছে। একটি ইউনিট কমিটি বিলুপ্ত আছে, সেটি হচ্ছে লক্ষ্মীপুর জেলা কমিটি। এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ও আহ্বায়ক মিলিয়ে ৫২টি কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। অর্থাৎ মেয়াদ আছে মাত্র ১০টির। সেগুলো হচ্ছে লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, জামালপুর, শেরপুর, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলা কমিটি।
যদিও আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার সময় তিন মাসের মধ্যে সম্মেলন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউই সম্মেলন করতে পারেনি। এমনও আছে, ২০১১-২০১২ সালে কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, সেই কমিটি এখনো বহাল রয়েছে। যেমন ২০০৯ সালে বেগম রাবেয়া চৌধুরী ও আমিনুর রশিদ ইয়াসীনের নেতৃত্বে দুই বছরের জন্য কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা কমিটি দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর কমিটির মেয়াদ শেষ হয়, সে কমিটি এখনো বহাল রয়েছে।
বয়স, অসুস্থতা ও শারীরিক অবস্থা—সব মিলিয়ে আগের জায়গায় নেই খালেদা জিয়া। এর সঙ্গে আছে জেল ও মামলা। সার্বিক পরিস্থিতিতে অঘোষিতভাবেই দলের হাল ছেলে তারেক রহমানের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই কার্যত দল চলছে তারেক রহমানের নেতৃত্বে। এখন খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন পদে আছেন, এটুকুই।
দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দল পুনর্গঠনের কাজ তত্ত্বাবধান করছেন তারেক রহমান। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর প্রথম পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দলের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে (বর্তমানে স্থায়ী কমিটির সদস্য)। তিনি ১১টি জেলা কমিটি ভেঙে একমাত্র নেত্রকোনা জেলা কমিটি গঠন করেন। এরপর আন্দোলন শুরু হলে সালাহউদ্দিন আত্মগোপনে চলে যান। একপর্যায়ে তিনি গুম হন, পরে সিলেট সীমান্তের ওপারে তিনি আটক হন। এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে দল পুনর্গঠনের দায়িত্ব পান আরেক সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান (বর্তমানে ভাইস চেয়ারম্যান)। তিনি ২টিতে আহ্বায়ক, ২৪টিতে পূর্ণাঙ্গ ও ২৫টি আংশিক মিলিয়ে ৫১টি ইউনিটে কমিটি দেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পুনর্গঠনের দায়িত্বে ছিলেন মো. শাহজাহান।
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা জানান, অতীতে বিভিন্ন সময়ে দল ভাঙার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে যে চেষ্টা ছিল, তা এখনো আছে। এ কারণে মাঠপর্যায়ে দল পুনর্গঠন চলছে খুব ধীরে। তারেক রহমান নিজের আস্থার নেতাদের দিয়ে কমিটি করছেন, তাতে প্রাধান্য পাচ্ছে ছাত্রদল-যুবদল থেকে আসা ব্যক্তিরা; যাতে চরম খারাপ পরিস্থিতিতে দলের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া না হয়। কিন্তু এমন পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় দলের জ্যেষ্ঠ নেতা, সাবেক সাংসদ, সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীসহ অনেককে ক্ষুব্ধ করছে।
এ রকম কিছু অভিযোগ আছে বলে স্বীকার করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও ওনাকে (তারেক রহমান) পরামর্শ দিয়েছি কমিটি গঠনের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতা, চার-পাঁচবারের প্রার্থী ছিলেন বা সামনেও প্রার্থী হতে পারেন—তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করার। মনে হচ্ছে করছেন।’
তবে এখন আর এটা গোপন নয় যে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের তেমন কোনো যুক্ততা নেই। তিনি কেবল কমিটি অনুমোদনে সই করেন। এ নিয়েও দলে নানা রকম কথাবার্তা রয়েছে। তবে মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা দীর্ঘকাল দল নিয়ন্ত্রণ করেছেন, এসব অভিযোগ তাঁদের। বিভিন্ন এলাকায় এত দিন দল ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল, এখন সংগঠনের হাতে আসছে।’ তিনি চলমান পুনর্গঠন–প্রক্রিয়ার সঙ্গে পুরোপুরি একমত বলে জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তারেক রহমান এই মুহূর্তে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল পুনর্গঠনে মনোযোগী। এই তিন সংগঠনকে বিএনপির মেরুদণ্ড বিবেচনা করে কমিটি গঠন চলছে। এবার কমিটিতে পদ পেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য তিনটি সংগঠনই পৃথক ‘ফরম’ তৈরি করেছে। ওই ফরমে প্রার্থীর পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয়, দলের প্রতি অঙ্গীকার, বিগত আন্দোলনে সম্পৃক্ততার বিষয়ে অনেক তথ্য চাওয়া হয়েছে।
যুবদল বিভাগীয় ও মহানগরে ১১ টিম, ছাত্রদল ১১ টিম এবং স্বেচ্ছাসেবক দল ১২টি টিম গঠন করে থানা পর্যায়ে কমিটি করছে। ইতিমধ্যে যুবদল ও ছাত্রদলের থানা পর্যায়ে কমিটি গঠন অর্ধেকের বেশি হয়ে গেছে। যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এবার ফরমের তথ্য যাচাই-বাছাই ও মূল্যায়ন করেই কমিটিতে পদ দেওয়া হচ্ছে, যা আগে কখনো হয়নি। দল অচিরেই এর ফল পাবে বলে জানান তিনি। একই কথা বলেছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদির ভূঁইয়াও।
বয়স, অসুস্থতা ও শারীরিক অবস্থা—সব মিলিয়ে আগের জায়গায় নেই খালেদা জিয়া। এর সঙ্গে আছে জেল ও মামলা। সার্বিক পরিস্থিতিতে অঘোষিতভাবেই দলের হাল ছেলে তারেক রহমানের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই কার্যত দল চলছে তারেক রহমানের নেতৃত্বে। এখন খালেদা জিয়া চেয়ারপারসন পদে আছেন, এটুকুই।
মির্জা ফখরুল ইসলাম স্বীকার করেন, এখন দলের কোনো ব্যাপারে খালেদা জিয়া হস্তক্ষেপ করেন না। তিনি সব দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে দিয়ে দিয়েছেন।
নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে সরকারের তিন শর্তে জামিনে মুক্ত হয়েছেন ৭১ বছর বয়সী খালেদা জিয়া। তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, বিদেশে যেতে পারবেন না এবং বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন। যদিও বিএনপির নেতারা বলছেন, তার মানে বিষয়টি এমন নয় যে খালেদা জিয়া আর কখনো রাজনীতিতে ফিরবেন না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে অবশ্যই তিনি ভূমিকা রাখবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, খালেদা জিয়া মুক্ত নন। চাইলেও তিনি রাজনীতিতে ফিরতে পারছেন না। ফলে ১৯৮৮ সালে বিএনপির প্রাথমিক সদস্য, ২০০২ সালে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, ২০০৯ সালে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, সর্বশেষ ২০১৮ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়া তারেক রহমানই দলের মূল নেতা। তিনি লন্ডন থেকেই বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
অবশ্য ‘এত দূর থেকে নেতৃত্ব হয় না’ বলে মন্তব্য করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নেতা মানেই তো রাস্তায়, জনগণের পাশে। সেই নেতৃত্ব বিএনপির নেতা–কর্মীরা পাচ্ছেন না। আর খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তাতে রাজনীতি বলেন, দলের নেতৃত্বে বলেন—তাঁর ফেরার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।’