ঢাকার দুই সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১৩ নারী। এঁদের মধ্যে ৬ জন প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে লড়ছেন। যদিও তাঁদের কেউ নিজ দলের নেতা-কর্মীদের অসহযোগিতা; আবার কেউ প্রতিদ্বন্দ্বী দলের নেতা-কর্মীদের বাধা মোকাবিলা করে সমানতালে ভোটের মাঠে আছেন।
ঢাকার দুই সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ড আছে ১২৯টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ৭৫টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) ৫৪টি। দুই সিটির এসব ওয়ার্ডে মোট কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ৫৮৬ জন। এর মধ্যে নারী প্রার্থী মাত্র ১৩ জন, শতকরা হিসাবে যা মোট প্রার্থীর ২ শতাংশ। তাঁদের মধ্যে দুজন আওয়ামী লীগ–সমর্থিত এবং চারজন বিএনপি–সমর্থিত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী। বাকি সাতজন নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে বলেছেন, প্রচারে নেমে তাঁরা বুঝতে পারছেন নির্বাচনী মাঠে বহু প্রতিবন্ধকতা আছে, এসব মোকাবিলা করেই টিকে থাকতে হবে।
আওয়ামী লীগের আলেয়া ও হেলেন
উত্তর সিটিতে আয়তনে সবচেয়ে ছোট ৩১ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ৯ জন। যাঁদের মধ্যে ৪ জন আওয়ামী লীগের সমর্থন চেয়েছিলেন। কিন্তু সমর্থন পান আলেয়া সারওয়ার (ডেইজি)। তবে দলের সমর্থনপ্রত্যাশী অন্যরাও মাঠে আছেন। আলেয়াকে বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থীর পাশাপাশি স্বদলীয় বিদ্রোহীদেরও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
আলেয়া সারওয়ার গত সিটি নির্বাচনে সংরক্ষিত ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি উত্তর সিটির প্যানেল মেয়র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এবার তিনি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন। তাঁর প্রতীক লাটিম। এই ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী হলেন সাজেদুল হক খান (প্রতীক এয়ারকন্ডিশনার)।
এই ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, পুরো ওয়ার্ডটিই নির্বাচনী পোস্টারে ভরে গেছে। প্রার্থীরা সবাই ঘুরছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। এই এলাকার অন্তত ১০ জন ভোটারের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানিয়েছেন, প্রার্থী নারী না পুরুষ সেই বিবেচনা তাঁরা করছেন না। মানুষ হিসেবে কে কেমন, সেটাই মূল আলোচনা। তবে একাধিক নারী ভোটার নারী প্রার্থীর প্রতি সহানুভূতির কথা জানিয়েছেন।
>দুই সিটির ১২৯ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ৫৮৬ জন। তাঁদের মধ্যে ১৩ জন নারী। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন ৬ জন।
নির্বাচনী প্রচারকালে শনিবার নূরজাহান রোডে কথা হয় আলেয়া সারওয়ারের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোটারদের কাছে ভালো সাড়া পাচ্ছেন, কিন্তু দলের নেতাদের সেভাবে পাশে পাচ্ছেন না। নির্বাচিত হলে তিনি এই ওয়ার্ডে নিরাপত্তাসহ নারীদের মাঠে খেলার ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থাসহ নানা উন্নয়ন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
সাধারণ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া আরেক নারী হলেন হেলেন আক্তার। তিনি দক্ষিণ সিটির ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী। এর আগে তিনি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর ছিলেন। হেলেনা আক্তারও অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির প্রধান দুই নেতাকে প্রচারে পাশে পাচ্ছেন না। তবে কর্মীরা তাঁর পাশে আছেন। হেলেন আক্তারের নির্বাচনী প্রতীক ঘুড়ি। দক্ষিণের এই ওয়ার্ডে মোট প্রার্থী পাঁচজন। তাঁদের মধ্যে বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী হলেন আবদুল কাদির।
বিএনপির সমর্থনে মাঠে চার নারী
বিএনপির সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চার নারী। তাঁদের মধ্যে দুজন আগেও সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। একজন সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন এবং অন্যজন দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচন করছেন।
এই চারজন হলেন ফেরদৌসী আহমেদ, সাজেদা আলী (হেলেন), শাহিদা মোর্শেদ ও মেহেরুন নেছা। চারজনই প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ দলের নেতা-কর্মীদের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন। তবে প্রচারের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের বাধা ও হুমকির মুখে পড়েছেন।
তাঁদের মধ্যে উত্তর সিটির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির প্রার্থী ফেরদৌসী আহমেদ অভিযোগ করেন, ১২ জানুয়ারি থেকে তিনি প্রচার শুরু করেন। শুরু থেকেই তাঁর নির্বাচনী পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রচারপত্র কেড়ে নেওয়া, প্রচারের মাইক ভাঙচুর করাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছেন।
গত শনিবার এই ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কোথাও এই প্রার্থীর পোস্টার চোখে পড়েনি। তাঁর প্রতীক ঠেলাগাড়ি। তবে ফেরদৌসীকে জনসংযোগ ও প্রচারপত্র বিলি করতে দেখা গেছে। এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থীসহ মোট সাতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
উত্তরের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী সাজেদা আলী (হেলেন)। তাঁর নির্বাচনী প্রতীক ঝুড়ি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এলাকায় নির্বাচনী পরিবেশ থমথমে। নানাভাবে প্রচারে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য তিনি নারীদের নিয়ে ছোট পরিসরে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
দক্ষিণ সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির প্রার্থী শাহিদা মোর্শেদ। তাঁর প্রতীক লাটিম। তিনি বলেন, গণসংযোগে নারীদের ধাক্কা দেওয়া, হুমকি দেওয়াসহ নানা সমস্যা হচ্ছে। তারপরও মাঠ ছাড়েননি।
দক্ষিণের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন মেহেরুন নেছা। এখানে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী কেবল দুজন। মেহেরুন নেছা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রচারে বাধাসহ নানা সমস্যা নিয়ে একাধিকবার নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু প্রতিকার পাচ্ছেন না।
অন্যদের তৎপরতা কম
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থন পাওয়া প্রার্থীদের বাইরে সাধারণ ওয়ার্ডে আরও সাতজন কাউন্সিলর প্রার্থী আছেন। তাঁদের বেশির ভাগের নির্বাচনী মাঠে সরব উপস্থিতি নেই।
তাঁদের মধ্যে দক্ষিণ সিটির ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী ফারহানা আহম্মেদ (ঠেলাগাড়ি) বরখাস্ত হওয়া কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদের স্ত্রী। ক্যাসিনো–কাণ্ডে বিতর্কিত সাঈদ নিজেও একই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী।
অন্যদের মধ্যে রয়েছেন উত্তর সিটির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে হাছিনা মোরশেদ (টিফিন ক্যারিয়ার), ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে সাহানা আক্তার (রেডিও), ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে নাজমুন আরা হোসেন (কাঁটাচামচ), শামিমা শারমীন (টিফিন ক্যারিয়ার), ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে মাহমুদা ফেরদৌস (মিষ্টিকুমড়া) ও ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে সোনিয়া হোসেন (ঝুড়ি)।
নির্বাচনী মাঠে নেমে নারীরা যে নানা সমস্যায় পড়েন, সেটা উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী এটি রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার ও নৈতিক দায়িত্ব। তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী নির্ধারণে অর্থ ও পেশিশক্তিকে গুরুত্ব দেয়, যা নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ কম হওয়ার বড় কারণ।