জোট রাজনীতির যত সমীকরণ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে চলছে নানা মেরুকরণ। জোট গড়া নিয়ে ছোট-বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ, উদ্যোগ আর দৌড়ঝাঁপ কারোরই চোখ এড়াচ্ছে না। ভোটের রাজনীতিতে দলগুলো নানা সমীকরণ কষেই চলছে। আবার সমীকরণের প্যাঁচে কখনো জোট ভাঙছে আবার গড়ছে।

বিভিন্ন সময়ে গঠিত জোটের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কখনো কোনো নির্দিষ্ট ইস্যুকে কেন্দ্র করে জোট গঠন হয়। নির্বাচন এলে জোট, সরকারের বিরোধিতা করতে সরকারবিরোধী জোট, সরকার গঠন করতে জোট। তবে ভোট আর সরকার রোধী রাজনীতিই জোটের প্রধান অনুষঙ্গ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।

এ অঞ্চলে জোটের রাজনীতি প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯৫৪ সালে। ওই নির্বাচনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অংশ নিয়ে বিপুল জয় পায়। নির্বাচনে জোট রাজনীতির বিজয় হলেও সরকার গঠনের পর জোটের বিপর্যয় ঘটে। রাজনীতির ইতিহাসে এই রাজনৈতিক জোটের শরিকদের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব ও বিরোধ থাকলেও ‘সাধারণ শত্রু’র বিরুদ্ধে ২১ দফার ওপর ভিত্তি করে এই জোট গঠিত হয়েছিল।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত নানা জোট হয়েছে। পাকিস্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনে হয়েছে নানা মেরুকরণ। ছাত্রসমাজের নেতৃত্বেও জোট হয়েছে, যা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ তৈরি করেছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কোনো জোট না হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে এককাট্টা জনগণ আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে। এর পরের বছরই ওই দলের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এবার একাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোট রাজনীতিতে বড় ধরনের মেরুকরণ ঘটেছে। শুরুতে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন মিলে সরকারবিরোধী একটি জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলোকে একত্র করে এই উদ্যোগ শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলেও বাইরে চলে যান বি. চৌধুরী। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জেএসডি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। দলের বাইরে বিভিন্ন পেশার অনেকেই জড়িত আছেন এই জোটে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবার জোটগতভাবেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। ছবি: প্রথম আলো ফাইল ছবি

এই ঐক্য প্রক্রিয়ার শুরুতে বি. চৌধুরীর অবস্থান ছিল স্বাধীনতাবিরোধী কোনো দল ঐক্যফ্রন্টে আসতে পারবে না। বিএনপির উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য ছিল, জামায়াতকে ছেড়ে বিএনপিকে ঐক্যে আসতে হবে। তবে ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত না হওয়ার পর বি. চৌধুরীর ও তাঁর জোট যুক্তফ্রন্ট সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সরকারি জোটের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করছেন তাঁরা।

এর বিপরীতে সরকারি দল আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে জোট সম্প্রসারণ ও অন্য দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের ঐক্য বজায় রেখে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জোট ও বি. চৌধুরীর জোটকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোট গঠন করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন আদায়ের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জোটের সঙ্গী করেছে ক্ষমতাসীন দল। দলীয় ও জোটগত প্রার্থী মনোনয়নে নানাভাবে ছাড় দিচ্ছে জোটসঙ্গীদের।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটের রাজনীতিতে সক্রিয় আছে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে ৭০টি ইসলামি দল ও সংগঠন। এর মধ্যে ২৯টি দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ৩২টি দল আছে জাতীয় পার্টির সঙ্গে, যারা ভোটের মাঠে সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। আর বিএনপির সঙ্গে আছে ৫টি দল। তবে নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে ২টি বিএনপি, ২টি এরশাদ ও ৬টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছে।

ভোটের রাজনীতির নানা হিসাব–নিকাশ কষে ইসলামপন্থী দলগুলোর দিকে নজর বেশি সরকার ও সরকারের মিত্র জাতীয় পার্টির। তা ছাড়া কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও সরকারের সখ্য গড়ে ওঠার বিষয়টি মানুষ দেখেছে। কওমি শিক্ষাকে স্বীকৃতি দিয়ে হেফাজতের কাছ থেকে ‘কওমি জননী’ উপাধি পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত ৩ নভেম্বর সরকারের সমর্থনে সম্মিলিত ইসলামী জোট নামে নতুন একটি জোটের আত্মপ্রকাশ হয়। এই জোটের শরিক দল আটটি। জোটের চেয়ারম্যান মাওলানা জাফরুল্লাহ খান দীর্ঘদিন প্রয়াত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব ছিলেন। এই জোটের লক্ষ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন করা।

গত সেপ্টেম্বরে ১৫টি দল নিয়ে সরকারের সমর্থনে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (আইডিএ) নামের আরেকটি জোটের আত্মপ্রকাশ হয়। এর চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী।

নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ ‘সম্মিলিত ইসলামী মহাজোট’ নামে একটি ৩৪-দলীয় মোর্চার সঙ্গে জোট করেন। এই জোটের দুটি দলের নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন আছে। বাকি দলগুলো অপরিচিত ও নামসর্বস্ব।

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই পীর) ও ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনী) ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। এবার ইসলামী ঐক্যজোটের প্রধান অংশ বিএনপির সঙ্গে নেই। জামায়াত নিবন্ধন ও প্রতীক হারিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন স্বতন্ত্র অবস্থানে আছে। তবে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে জোটগতভাবেই নির্বাচন করছে।

তবে দুটি দল—চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (আতাউল্লাহ) এখনো পর্যন্ত কোনো দিকে যায়নি।

বাংলাদেশে জোট রাজনীতির শুরু
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। এরপর ১৯৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে সরকারবিরোধী সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। এটিই স্বাধীনতা–পরবর্তী প্রথম জোট। ১৫ দফাভিত্তিক এই জোটের অংশীদার ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সোশ্যালিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল ও বাংলা জাতীয় লীগ।

তাদের দাবি ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের পদত্যাগ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা এবং সর্বদলীয় সরকার গঠন। এই জোট বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সে সময় জাসদের প্রতিষ্ঠা ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাপে জোটটিও দুর্বল হয়ে পড়ে।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে ভাসানীর নেতৃত্বে আরেকটি সাতদলীয় জোট হয়। ভোটের পর ১৯৭৩ সালের ২২ মে ৩ দফা দাবিতে ভাসানীর সমর্থনে সাতদলীয় জোট গঠন করা হয়। জোটে ছিল জাসদ, ন্যাপ ভাসানী, বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদি) ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। পরে ১৯৭৪ সালে ১৪ এপ্রিল ভাসানীকে চেয়ারম্যান করে আরেকটি জোট ‘সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করা হয়।
এর আগে ১৯৭৩ সালের ২০ এপ্রিল ১১টি সংগঠন নিয়ে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট।

রাজনৈতিক নানা বিরোধিতার ভেতরে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর সরকারি দলের সঙ্গে ন্যাপ (মোজাফ্ফর) ও সিপিবির মধ্যে সমঝোতা তৈরি হয়। ১৪ অক্টোবর গঠিত হয় গণঐক্যজোট। এটি ছিল বাকশাল গঠনের পূর্বপ্রস্তুতি।

পঁচাত্তর–পরবর্তী রাজনৈতিক জোট
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে রাজনৈতিক মেরুকরণ হয় নতুন করে। ক্ষমতার দৃশ্যপটে জিয়াউর রহমান নেপথ্যে থেকে গঠন করেন জাগদল। পরে এই জাগদল, মুসলিম লীগ (শাহ আজিজ), ন্যাপ ভাসানী, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি-ইউপিপি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ তফসিল জাতি ফেডারেশনের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। জোটের চেয়ারম্যান হন জিয়া। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, জাতীয় জনতা পার্টি, ন্যাপ (মোজাফফর), গণআজাদি লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়া অংশ নেন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট থেকে। আর গণতান্ত্রিক জোট থেকে অংশ নেন এম এ জি ওসমানী।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে বিলুপ্ত করে জিয়াউর রহমান গঠন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

এরপর সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদের মধ্যে ঘটে নতুন নতুন মেরুকরণ। ওই বছরের শেষ দিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে পাঁচটি বাম দলের সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করা হয়। ৮০ সালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১০–দলীয় জোট। এই জোট সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকলেও তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

১৯৮১ সালে ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তাঁর আমলে গড়ে ওঠা সরকারবিরোধী ১০-দলীয় জোট রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একক প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যায়। জোটভুক্ত দলগুলো আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। আওয়ামী লীগ (মিজান), বাসদ, মজদুর পার্টি ও জাতীয় জনতা পার্টি মিলে নাগরিক কমিটি নামে জোট গঠন করে এম এ জি ওসমানীকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করে। ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (হারুণ) ও সিপিবির সমন্বয়ে গঠিত প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শিবির মোজাফফর আহমদকে প্রার্থী করে। জাসদ, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল ও ওয়ার্কার্স পার্টির সমন্বয়ে গঠিত ত্রিদলীয় জোট প্রার্থী করে মেজর এম এ জলিলকে। ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ জাস্টিস পার্টির সমন্বয়ে গঠিত ওলামা ফ্রন্টের প্রার্থী হন মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর। নির্বাচনে ৬৫ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন বিচারপতি সাত্তার। ড. কামাল হোসেন পান ২৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রধান দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। ছবি: সংগৃহীত


এরশাদ শাসনামলে গতি পায় জোটের রাজনীতি
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ দেশের ক্ষমতার রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ১৯৮৩ সালে জোট রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ ঘটে। আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয় ১৫–দলীয় জোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত হয় সাতদলীয় জোট।

১৫–দলীয় জোটের শরিক দলগুলো ছিল আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ (মিজান), আওয়ামী লীগ (ফরিদ গাজী), জাসদ, বাসদ, গণআজাদী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ (হারুণ), ন্যাপ (মোজাফফর), সিপিবি, সাম্যবাদী দল (তোয়াহা), সাম্যবাদী দল (নগেন), জাতীয় একতা পার্টি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল ও জাতীয় মজদুর পার্টি। আওয়ামী লীগ ভেঙে বাকশাল গঠন, মিজান চৌধুরীর জোট ত্যাগ, বাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টিতে ভাঙন, সাম্যবাদী দলের দুই অংশের এক হওয়া, দুই ন্যাপ ও একতা পার্টির এক হওয়ার কারণে এই জোটে দলের সংখ্যা কখনো বেড়েছে কখনো কমেছে।

বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত সাতদলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত ছিল বিএনপি, ইউপিপি, গণতান্ত্রিক পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, ন্যাপ (নুরু) কৃষক শ্রমিক পার্টি ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ। এই জোটেও ভাঙন ছিল। ফলে জোটে দলের সংখ্যা কমেছে-বেড়েছে।

শুরু থেকে দুই জোট যুগপৎ আন্দোলনে যায়। পাঁচ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৮৪ সালের ১৪ অক্টোবর ঢাকায় জাতীয় গণসমাবেশের ঘোষণা দেয় দুই জোট ও জামায়াত। দুই জোট সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানায়। ১৯৮৬ সালের ৭ মে সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে ১৫ দলে ভাঙন দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল নির্বাচনে অংশ নেয়। এর প্রতিবাদে জোট থেকে বেরিয়ে যায় সাতটি দল। হাসানুল হক ইনুর জাসদ, মেননের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ কয়েকটি বাম দল মিলে পাঁচদলীয় জোট গঠন করে। আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোটও নির্বাচন বর্জন করে।

এরপর প্রধান দুই জোট, বাম জোট ও জামায়াত মিলে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। ওই দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ছয়জন নিহত হন। পরদিন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়।

১৯৮৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হলেও বিরোধী জোটগুলোর আন্দোলনের মুখে ৩ মার্চ নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তিন জোটসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। তখন সরকার কৌশল করে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে নামসর্বস্ব দলের সমন্বয়ে ১৪০ দলের সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) গঠনে সহায়তা করে। এই জোট পরিচিতি লাভ করে গৃহপালিত বিরোধী দল হিসেবে।

১৯৯০ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে আবারও তৎপর হয়ে ওঠে বিরোধী জোটগুলো। ১০ অক্টোবর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশি হামলায় ছয়জন নিহত হওয়ার পর ছাত্রসংগঠনগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। ২২টি ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। ছাত্র আন্দোলনের চাপে একসঙ্গে বসতে বাধ্য হয় প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো। ১৯ নভেম্বর তিন জোট এরশাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য রূপরেখা ঘোষণা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগে বাধ্য হন সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে জীবন্ত পোস্টার নুর হোসেন। ছবি: সংগৃহীত


এরশাদ–পরবর্তী ও খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদে জোট রাজনীতি
এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগেই এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গড়ে ওঠা জোট বা ঐক্য অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আটদলীয় জোটের শরিকেরা জোটবদ্ধ নির্বাচন করার চেষ্টা করলেও আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে একমত হতে পারেনি। পরে আওয়ামী লীগ বাদে আটদলীয় জোটের অন্য শরিকেরা এবং পাঁচদলীয় বাম জোটের সমন্বয়ে গঠন করা হয় গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট। এ সময় আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দিলেও একক পর্যায়ে পাঁচটি দলকে ৩৬টি আসন ছেড়ে দেয়। এ কারণে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের ভেতরেও দেখা দেয় ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। অনেক আসনে এই জোটের প্রার্থীরা আটদলীয় জোটের প্রার্থী হয়েছেন, কোথাও গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের প্রার্থী আবার কোথাও দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।

অন্যদিকে, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে ৬৮ আসন ছাড়তে রাজি হয়। জামায়াত এই সমঝোতাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিত চাইলেও রাজি হয়নি। ওই সময় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সমন্বয়ে ইসলামী ঐক্যজোট নামে আরেকটি জোট হয়।

নির্বাচনে বিএনপি ১৪০ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। আওয়ামী লীগ ৮৮, জাতীয় পার্টি ৩৫, জামায়াত ১৮, বাকশাল ৫, সিপিবি ৫, অন্যান্য দল ৬ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান ৩টি আসন।

এই সময়ে সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ (খালেক), জাসদ (ইনু), বাসদ (মাহবুব), শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, সাম্যবাদী দল ও ঐক্য প্রক্রিয়া মিলে গঠন করে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। তারাও আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের মতো তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলনে শামিল হয়।

শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে জোট রাজনীতি
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার শুরু থেকেই সরকারি দলের সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয় বিরোধী দলগুলোর। সংসদে কথা বলতে দেওয়া হয় না অভিযোগ করে সংসদ বর্জন শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর বিএনপি, জামায়াত ও সরকারের অংশীদার জাতীয় পার্টি সরকারের সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। আন্দোলনে নামে। জাতীয় পার্টি সরকারের তিন বছর যাওয়ার আগেই সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। জোট বাঁধে বিএনপির সঙ্গে। অবশ্য দলের মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে দলে ভাঙন তৈরি হয় এবং তিনি সরকারের সঙ্গেই থেকে যান।

সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে ১৯৯৯ সালে গড়ে ওঠে চারদলীয় জোট। বিএনপির নেতৃত্বাধীন এ জোটে যোগ দেন এরশাদের জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট। ৬ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, জামায়াতের আমির গোলাম আযম ও ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ফজলুল হক আমিনী সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তা ঘোষণা করেন। অবশ্য এরশাদ এই জোটে বেশি দিন থাকতে পারেননি। তাঁকে জোট ছাড়তে হয়। সে সময় তাঁর দলে আবারও ভাঙন ধরে। নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি অংশ চারদলীয় জোটের অংশ হয়ে থেকে যায়।

পরে এরশাদ ইসলামপন্থী কয়েকটি দল নিয়ে গঠন করেন ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

আওয়ামী লীগের এ আমলে চারদলীয় জোট সক্রিয় ছিল নির্বাচন পর্যন্ত। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে এককভাবে। আর বিএনপি করেছে জোটবদ্ধভাবে এরশাদ করেছেন ইসলামী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে। নির্বাচনে বিএনপি ও চারদলীয় জোট নিরঙ্কুশ বিজয় পায়।

বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে জোট রাজনীতি
নির্বাচনে বড় জয়ের পর সরকার গঠন করে চারদলীয় জোট। তবে জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা মন্ত্রিসভায় স্থান পেলেও অন্য দুই দল থেকে কেউই স্থান পাননি। ইসলামী ঐক্যজোট থেকে আল্লামা আজিজুল হককে মন্ত্রী করার আলোচনা এলেও জোটের আরেক নেতা ফজলুল হক আমিনীর দ্বন্দ্বে তা ভন্ডুল হয়ে যায়। এই দ্বন্দ্বের জের হিসেবে জোট থেকে বেরিয়ে যান আজিজুল হক।

চারদলীয় জোটের শাসনের শেষ দিকে উল্লেখযোগ্য জোট ছিল ১১–দলীয় বাম জোট। জোটের অংশীদার ছিল সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, সাম্যবাদী দল, বাসদ (খালেক), বাসদ (মাহবুব), গণতন্ত্রী পার্টি, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল।

২০০৫ সালে এই জোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু হলে সিপিবি, বাসদের দুই অংশ এবং শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল ওই জোট থেকে বেরিয়ে যায়। অন্য সাতটি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠনে এগিয়ে যায়। এদের সঙ্গে যুক্ত হয় জাসদ (ইনু) ও ন্যাপ মোজাফ্ফর। গঠিত হয় ১৪–দলীয় জোট। এই জোট বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।

এই সময় জোট রাজনীতিতে এরশাদকে নিয়ে শুরু হয় নতুন খেলা। প্রধান দুই জোটের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন এরশাদ। এরশাদ কখনো চারদলীয় জোট, কখনো ১৪–দলীয় জোটের সঙ্গে থাকার কথা বলে রাজনীতিতে নিজের অবস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণের চেষ্টা চালান।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। এরশাদ ও খেলাফত মজলিসকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোট গঠন করে ১৪–দলীয় জোট।

ওই সময় ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, মাইজভান্ডারির তরিকত ফেডারেশন এবং বি. চৌধুরীর বিকল্পধারার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একপর্যায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান মাইজভান্ডারি। ড. কামালও বেরিয়ে যান ঐক্যফ্রন্ট থেকে। সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তাঁরা আবারও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেন। গঠন করেন জাতীয় যুক্তফ্রন্ট। গণফোরাম ও বিকল্পধারার পাশাপাশি এ দলে ছিল ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর পিডিপি, জেনারেল ইব্রাহিমের কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ ফরোয়ার্ড পার্টি।

আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। তাদের সঙ্গী ১৪ দল, এরশাদের জাতীয় পার্টি, এলডিপি ও খেলাফত মজলিস। আর বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট।

জোট রাজনীতি ২০০৯ থেকে
মহাজোটের ভূমিধস বিজয়ের পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করেন জোট নেতা শেখ হাসিনা। জোটবদ্ধভাবে বিজয়ী হলেও জাতীয় পার্টির জি এম কাদের ও সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া ছাড়া কেউই মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। এ নিয়ে জোটের ভেতরে নানা টানাপোড়েন ছিল, মান-অভিমান ছিল।

এ সময়ে বিরোধী দলগুলো সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য জোট সম্প্রসারণে মনোযোগী ছিল। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোট বিলুপ্ত করে ১৮–দলীয় জোট গঠনের ঘোষণা আসে। জোটের শরিক দলগুলো হলো: বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, বিজেপি, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, এলডিপি, কল্যাণ পার্টি, জাগপা, এনপিপি, লেবার পার্টি, এনডিপি, বাংলাদেশ ন্যাপ মুসলিম লীগ, ইসলামিক পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ডেমোক্রেটিক লীগ ও পিপলস পার্টি। তারা সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলে।

এরই মধ্যে বিরোধী দল ও জোটের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন করে সরকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন প্রার্থীরা। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোটের সরকার গঠনের পর দেশে সরকারবিরোধী রাজনীতিতে তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি বিরোধী জোট। তবে ১৮–দলীয় জোট একসময় ২০–দলীয় জোট হয়েছে।

সরকারের চাপে পুরো মেয়াদেই কোণঠাসা ছিল তারা। এরই মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছে ২০–দলীয় জোটে।