গাজীপুরের সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভার এ সিদ্ধান্ত সারা দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখন স্থানীয় রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
প্রথম আলো: গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। জাহাঙ্গীর আলম দীর্ঘ সময় ধরে দলে আছেন। তাঁর নিশ্চয়ই অনেক অনুসারী আছে। তাঁর বহিষ্কারে দলে নতুন করে একটি পক্ষ সৃষ্টি হবে না? এর ফলে দলের ক্ষতি হবে না?
আজমত উল্লা খান: জাহাঙ্গীর আলমকে যখন আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তখন থেকে আওয়ামী পরিবারের কেউ তাঁর সঙ্গে নেই। তাঁর অতীত দিনের কার্যকলাপে দেখা গেছে, তিনি দলে থেকেও এর বাইরে একটি বলয় তৈরি করেছিলেন। এটা তিনি করেছিলেন জাহাঙ্গীর ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের মাধ্যমে। এই জাহাঙ্গীর ফাউন্ডেশনে যারা ছিল, তাদের অধিকাংশের ব্যাকগ্রাউন্ড ছাত্রশিবির বা জামায়াত বা বিএনপি। তাদের নিয়েই তিনি একটি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
প্রথম আলো: জাহাঙ্গীরের প্রভাবের পেছনে জামায়াত-শিবির ছিল?
আজমত উল্লা খান: জি। এসব দলের লোক ছিল। তাই অনেক সময় আমাদের নেতা-কর্মীদের এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তিনি সিটি মেয়র ও সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় তাদের অনেকের আপত্তি ছিল। কিন্তু যখন তাঁর ভিডিও ভাইরাল হলো, তারপর সাধারণ নেতা-কর্মীরা এককাট্টা হলো। এরপর যখন তাঁকে বহিষ্কার করা হলো, তখন আমাদের আওয়ামী পরিবারের সবাই একত্র হয়েছে। সুতরাং তাঁর অবর্তমানে দল ক্ষতিগ্রস্ত তো হয়ইনি, বরং তাঁর কার্যকলাপের কারণে যাঁরা দল থেকে অভিমান করে দূরে ছিলেন বা নীরব ছিলেন, আমাদের সেই নেতা-কর্মীরা সরব হয়ে গেছেন খুবই। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের যে ঐতিহ্য আছে, সেটি ফিরে আসবে। এই গাজীপুরকে বলা হয় ‘দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ’। সেই অবস্থা আবার ফিরে আসবে। এখানে বিভাজনের কোনো প্রশ্নই নেই।
প্রথম আলো: জাহাঙ্গীর আলমের জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে আপনারা এত দিন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে কিছু জানাননি?
আজমত উল্লা খান: কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে বিভিন্নভাবে এটা আমাদের নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন। আমরাও বিভিন্ন সময় জাহাঙ্গীর আলমকে শোধরানোর চেষ্টা করেছি। উনি তো এগুলো কানে নিতেন না। উনি একটি লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। আলাদা মিশন ছিল।
প্রথম আলো: আলাদা মিশনটা কী?
আজমত উল্লা খান: এসব গোষ্ঠীকে প্রতিষ্ঠিত করে দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। এ সমস্ত ক্ষোভ মানুষের মধ্যে ছিল। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবার হয়েছে।
প্রথম আলো: দল এসব অভিযোগ পেয়েও ব্যবস্থা নিল না, তার অর্থ এখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা ছিল?
আজমত উল্লা খান: দলের কাছে একটি অভিযোগ গেলে সাংগঠনিকভাবে এটি প্রমাণের বিষয় আছে। যেমন তাঁর বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার পরও কিন্তু দল সঙ্গে সঙ্গে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দল প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। তাঁর জবাবের পর দল যাচাই-বাছাই করেই তাঁকে বহিষ্কার করেছে। সে জন্য সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত হয়েছে। তাঁকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিতে তাড়াহুড়া করেনি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সময় নিয়েই এ কাজ করেছে। তাদের কর্মকাণ্ড কোনো শৈথিল্য ছিল না।
প্রথম আলো: জাহাঙ্গীর আলম দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও সিটির মেয়র আছেন। তিনি আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেট নিয়েই নির্বাচিত হয়েছেন। এখন তিনি সিটির মেয়র থাকলে স্থানীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাধার সৃষ্টি হবে না?
আজমত উল্লা খান: তিনি মেয়র আছেন কিন্তু তাঁর সেই পদ নিয়ে সিদ্ধান্ত দুয়েক দিনের মধ্যেই হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী। সিটি করপোরেশন আইন আছে। আবার তাঁর যে অপরাধমূলক বক্তব্য, তাই তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাও হতে পারে। নানা ব্যবস্থা তো আছে। এ নিয়ে আমার এ মুহূর্তে বেশি বলা ঠিক হবে না। দেখি কী হয়।
প্রথম আলো: সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী কাউন্সিলরদের দুই-তৃতীয়াংশের অনাস্থায় মেয়র পদ হারাতে পারেন। এখন যাঁরা কাউন্সিলর আছেন, তাঁদের আপনি যথেষ্ট চেনেন। এমন প্রচেষ্টা চলতে পারে কি না?
আজমত উল্লা খান: কাউন্সিলরদের মৌলিক অধিকার আছে সিটি করপোরেশনের সভার সিদ্ধান্ত জানা। কিন্তু কাউন্সিলরদের দাবি, বেশির ভাগ সভার সিদ্ধান্ত তাঁরা জানেন না। সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী পরিষদের প্রথম সভার এক মাসের মধ্যে প্যানেল মেয়র নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু তিন বছরে তা হয়নি। তিনি আইনের কোনো তোয়াক্কাই করেননি। এটা বাংলাদেশে কোথাও আপনি পাবেন না। এসব নিয়ে ক্ষোভ তো আছেই।
প্রথম আলো: গাজীপুর আওয়ামী লীগের ‘দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ’ হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রয়াত আহসান উল্লাহ মাস্টার, রহমত আলী, আ ক ম মোজাম্মেল হক, আখতারউজ্জামান এবং আপনার মতো নেতা তৈরি হয়েছেন। এসব নেতার মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের উত্থান এবং তিনি সিটির বড় একটি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দলের মর্মমূলে আঘাতের অভিযোগ। এই নেতার উত্থানের দায়ভার আপনাদের মতো জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের নেই?
আজমত উল্লা খান: না, জ্যেষ্ঠ নেতাদের কোনো খামতি নেই বলেই আমার মনে হয়। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তিনি হয়েছেন। আবার তাঁর কর্মের জন্যই তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তিনি যেভাবে বহিষ্কৃত হলেন, তা নজিরবিহীন।
প্রথম আলো: তাহলে নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ছিল?
আজমত উল্লা খান: না, তা ঠিক নয়। জাহাঙ্গীর আলম দায়িত্ব পাওয়ার আগে তাঁর ভেতরের বিষয়গুলো মানুষ বুঝত না। পরে তা ধীরে ধীরে প্রকাশ্য হয়ে গেছে।
প্রথম আলো: ২০১৩ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম আপনার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছিলেন। সেই নির্বাচনের পরাজয়ের পর জেলা আওয়ামী লীগের সভায় পরাজয়ের কারণ হিসেবে জাহাঙ্গীর আলমের বিরোধিতাকে উল্লেখ করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেও সে কথা জানানো হয়েছিল। তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরে তিনি আবার মেয়র পদ পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিবেচনাবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে না?
আজমত উল্লা খান: আমি অতীতে যেতে চাই না। আমরা সামনে যাব, এই বিশ্বাস রাখতে হবে। আমি দলের আদর্শে বিশ্বাস করি এবং পালন করে এসেছি সব সময়। এর বিরোধিতা করার মানসিকতা আমার আগেও ছিল না, এখনো নেই। দল যাঁকে মনোনয়ন দিয়েছে, আমি তাঁর সঙ্গে থেকেছি। জাহাঙ্গীর আলম আমার নির্বাচনে বিরোধিতা করেছিলেন, আমি পরে তা ভুলে গেছি। আমি মনে করি, দলের যেকোনো মনোনীত ব্যক্তি পাস করা মানে আমার পাস করা।
প্রথম আলো: জাহাঙ্গীর আলম ভুল স্বীকার করে বলেছেন, তিনি সদস্যপদ ফিরে পেতে চান। দল যদি আপনার কাছে মত জানতে চায়, আপনি কী বলবেন?
আজমত উল্লা খান: কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁকে বহিষ্কার করেছে। সেই সিদ্ধান্ত হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। তাই তাঁকে সদস্যপদ দেওয়া বা না দেওয়াটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যাপার। কেন্দ্রীয় কমিটির আমার কাছে মত চাইবে কি না, বলতে পারি না। সেখানে আমার আবেগ ও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। যেহেতু ঘটনাটা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, তাই এসব নিয়ে আমার একান্ত নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্ত হবে। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমি প্রথম দিন থেকেই বলে আসছি, উনি মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে যে কথা বলেছেন, তা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। আমি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এসব বিষয় অবশ্যই জানাব।