এমন ফলাফলের পেছনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের আধিক্য ও কোন্দলকে দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পঞ্চম ধাপে দেশের ১১ জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্তত ২১ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী জামানত হারাচ্ছেন। এর মধ্যে ঝিনাইদহে এক প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৪২ ভোট আর ফরিদপুরে আরেকজন পেয়েছেন ৫৬ ভোট। এ ছাড়া ৫০০ ভোটের কম পেয়েছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের এমন প্রার্থী আছেন আটজন।
এর আগে চতুর্থ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে জামানত হারান আওয়ামী লীগ মনোনীত ২৯ প্রার্থী। ওই ধাপের নির্বাচনেও নৌকার দুজন প্রার্থী ১০০ ভোটের কম পেয়েছিলেন।
টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের এমন ফলাফলের পেছনে নির্বাচনে দলীয় বিদ্রোহীদের আধিক্য ও কোন্দলকে বড় কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। তাঁদের মতে, অনেক ইউনিয়নে দলের প্রার্থী বাছাই সঠিক হয়নি। আবার বহু জায়গায় নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশ বিদ্রোহী কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে। অনেকে মনোনয়ন-বাণিজ্যের কথাও বলেছেন।
প্রচারণার শুরুর দিন থেকেই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা যড়যন্ত্র শুরু করেন। ভোটের কয়েক দিন আগে তাঁরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের প্রচারণায় অংশ নেন। এ কারণে এমন ফল হয়েছেনৌকার প্রার্থী এম সম্পা মাহমুদ
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জামানত হিসেবে প্রার্থীদের জমা দিতে হয়। আইন অনুযায়ী, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর জামানত পাঁচ হাজার টাকা। মোট প্রদত্ত ভোটের ৮ ভাগের ১ ভাগ ভোট যদি কোনো প্রার্থী না পান, তাহলে তাঁর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়।
স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবে বর্জন করেছে রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি। তারপরও প্রতিটি ধাপেই নৌকার জয়ের হার ক্রমান্বয়ে কমেছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পঞ্চম ধাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের চেয়ে জয়ের হারে এগিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অবশ্য স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বড় একটি অংশ মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন।
নীলফামারীর ডোমার ও কিশোরগঞ্জ উপজেলায় তিনজন প্রার্থী জামানত হারাচ্ছেন। কিশোরগঞ্জের চাঁদখানা ইউপিতে নৌকার প্রার্থী মিজানুর রহমান পেয়েছেন ২৮৯ ভোট। নীলফামারীর ডোমার উপজেলার কেতকীবাড়ি ইউপিতে রবিউল ইসলামের প্রাপ্ত ভোট ১৮৮। একই উপজেলার ভোগডাবুরী ইউপিতে নৌকা প্রতীকের মো. হাফিজুর রহমান পেয়েছেন ৫৪২ ভোট।
পঞ্চম ধাপে গত বুধবার দেশের ৭০৭টি ইউপিতে নির্বাচন হয়। এর মধ্যে ১৫টি ইউপির ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ৬৯২টি ইউপির চেয়ারম্যান পদের ফলাফলের তথ্য দিয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ৩৪১টিতে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৪৬টিতে। অবশ্য এ ধাপে ৪৭টি ইউপিতে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী দেয়নি।
পঞ্চম ধাপে ঝিনাইদহের ২০টি ইউপিতে নির্বাচন হয়। এর মধ্যে নৌকার আটজন প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ফলসী ইউপিতে নৌকার প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নিমাই চাঁদ মণ্ডল মাত্র ৪২ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। এই ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বজলুর রহমান ৪ হাজার ৬২৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচনের এ ফলাফলের পর নৌকার প্রার্থী নিমাই চাঁদ মণ্ডল বলেন, কেন ভোটের ফল এমন হলো, তা বলতে পারছেন না তিনি।
ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার চরমোনাই ইউপিতে নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ বজলু মাতুব্বর ৫৬ ভোট পেয়েছেন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলু নির্বাচনে ১১ জন প্রার্থীর মধ্যে ষষ্ঠ হয়েছেন।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা ১০টিতেই পরাজিত হন। এর মধ্যে তিনজন প্রার্থী জামানত হারাচ্ছেন। তাঁরা হলেন হাটশ হরিপুর ইউপিতে এম সম্পা মাহমুদ (২৩২ ভোট), বটতৈলে এম এ মোমিন মণ্ডল (১১৪) এবং আলামপুরে আবদুল হান্নান (১১৭)।
হাটশ হরিপুর ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে লড়েন সাতজন। তাঁদের মধ্যে জামানত হারানো সম্পা মাহমুদ পঞ্চম হয়েছেন। বটতৈলে আটজন প্রার্থীর মধ্যে মোমিন মণ্ডল পঞ্চম হয়েছেন। আলামপুরে আবদুল হান্নানও আট প্রার্থীর মধ্যে হয়েছেন পঞ্চম।
নৌকার প্রার্থী এম সম্পা মাহমুদ বলেন, ‘প্রচারণার শুরুর দিন থেকেই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা যড়যন্ত্র শুরু করেন। ভোটের কয়েক দিন আগে তাঁরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহীদের প্রচারণায় অংশ নেন। এ কারণে এমন ফল হয়েছে।’
ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার চরনাছিরপুর ইউপিতে নৌকার প্রার্থী মিরাজ ব্যাপারী ১০১ ভোট পেয়ে জামানত হারাচ্ছেন। চারজন প্রার্থীর মধ্যে চতুর্থ হয়েছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা মিরাজ। সদরপুর উপজেলার ভাষানচরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মইদুল বাসার ৬৯৭ ভোট পেয়ে জামানত হারাচ্ছেন। তিনি ১২ জন প্রার্থীর মধ্যে ষষ্ঠ হয়েছেন। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
নীলফামারীর ডোমার ও কিশোরগঞ্জ উপজেলায় তিনজন প্রার্থী জামানত হারাচ্ছেন। কিশোরগঞ্জের চাঁদখানা ইউপিতে নৌকার প্রার্থী মিজানুর রহমান পেয়েছেন ২৮৯ ভোট। নীলফামারীর ডোমার উপজেলার কেতকীবাড়ি ইউপিতে রবিউল ইসলামের প্রাপ্ত ভোট ১৮৮। একই উপজেলার ভোগডাবুরী ইউপিতে নৌকা প্রতীকের মো. হাফিজুর রহমান পেয়েছেন ৫৪২ ভোট।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কাগইল ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী আফরোজা খাতুন ৪১৯ ভোট পেয়েছেন। তাঁর মতোই জামানত হারিয়েছেন একই উপজেলার মহিষাবান ইউপির জাকিউল হাসান। তিনি ভোট পেয়েছেন ১ হাজার ৫৪১টি। জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার চামরুল ইউপিতে নৌকার প্রার্থী আজমল হোসেন প্রামাণিক ১ হাজার ৮৭৯ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন।
ঢাকার সাভারের কাউন্দিয়া ইউপি নির্বাচনে মোট ভোট পড়ে ১৩ হাজার ৮৭৫টি। এর মধ্যে নৌকার প্রার্থী মেশের আলী ৮৫৮ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। চার প্রার্থীর মধ্যে তিনি তৃতীয় হয়েছেন। যশোরের কেশবপুরের ত্রমোহিনী ইউপিতে নৌকার প্রার্থী শেখ অহিদুজ্জামান (১ হাজার ১৭৪) এবং সাগরদাঁড়ি ইউনিয়নের অলিয়ার রহমানও (৫০৬) জামানত হারাচ্ছেন। অহিদুজ্জামান ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক।
রাজশাহীর বাগমারার হামিরকুৎসা ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছানোয়ারা খাতুন ৫৮২ ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, ভোটে তাঁকে হারানো হয়েছে। দলীয় প্রধান তাঁকে মনোনয়ন দিলেও স্থানীয় এবং উপজেলার কোনো নেতাকে তিনি পাশে পাননি। তাঁর পক্ষে কেউ নৌকায় ভোট না চেয়ে উল্টো দলের বিদ্রোহীর পক্ষে সরাসরি প্রচার চালিয়েছেন।
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার উদাখালিতে নৌকার প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান এবং সাঘাটা উপজেলার মুক্তিনগর ইউনিয়নে দলের প্রার্থী আরশাদ আজিজও জামানত হারাচ্ছেন। আসাদুজ্জামান ৪৪০ ভোট এবং আরশাদ আজিজ ১ হাজার ২০০ ভোট পেয়েছেন।
গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দ শামস-উল-আলম প্রথম আলোকে বলেন, একই ইউনিয়নে দলের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকা, দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নেতা-কর্মীদের কাজ না করায় ফল বিপর্যয় হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় নির্বাচনে আঞ্চলিকতা বেশি কাজ করেছে।
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার বাঘাব ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ জহুরুল হক ১ হাজার ৩৪৬ ভোট পেয়ে জামানত হারাচ্ছেন। তিনি শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খানের ভাগিনা।
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার বংশীকুণ্ডা উত্তর ইউপিতে ৭৫২ ভোট পেয়ে জামানত হারাচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আনোয়ার হোসেন। এই ইউপিতে বৈধ ভোট পড়েছে ১১ হাজার ৭৪৯টি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমদ বলেন, দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে যেভাবে কাজ করার কথা ছিল, সেটি উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা করেননি।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]