জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের আটটি হলে আসন বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণ করছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এই দায়িত্ব হল প্রশাসনের হলেও তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতারা হলের ‘সিটমন্ত্রী’। হলে থাকার জন্য, কক্ষে আসন পেতে ‘বড় ভাইদের’ কাছে ধরনা দিতে হয়। আর হলের আসনসংকটকে পুঁজি করে ছাত্রদের ওপর নানা অত্যাচার চালাচ্ছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে ম্যানার (আচার-আচরণ) শেখানোর নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো, নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের মারধরসহ নানা অভিযোগ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাখা ছাত্রলীগের অন্তত ৩০ জন পদধারী নেতা ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলেও হলে আসন দখল করে রেখেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ছেলেদের ৮টি হলে আসনসংখ্যা ৪ হাজার ৬৪৫। বিপরীতে এখন থাকছেন প্রায় ৭ হাজার ৭০০ ছাত্র। দেশের একমাত্র আবাসিক এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর শিক্ষার্থীদের দুই বছরের বেশি সময় গণরুমে থাকতে হচ্ছে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কক্ষ দখল করার সংস্কৃতি আসনসংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
>আগে প্রাধ্যক্ষ-আবাসিক শিক্ষকেরা হলের কক্ষে যেতে পারতেন
এখন প্রাধ্যক্ষ-শিক্ষকেরা জানেনও না হলের কোন কক্ষে কারা থাকছেন
হলের আসনসংকটকে পুঁজি করে ছাত্রদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে ছাত্রলীগ
একাধিক প্রাধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, হলের আসন বণ্টন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের কাছে প্রশাসন অনেকটাই অসহায়। আগে সপ্তাহে এক-দুই দিন প্রাধ্যক্ষ, আবাসিক শিক্ষকেরা হলের কক্ষে কক্ষে যেতে পারতেন। এখন তাঁরা জানেনও না হলের কোন কক্ষে কারা থাকছেন। হলের আসন ফাঁকা করা, নতুন কাউকে কক্ষে ওঠানোর কাজগুলো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
এ বিষয়ে প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি ও শেখ হাসিনা হলের প্রাধ্যক্ষ বশির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, হলগুলোতে মনিটরিং ব্যবস্থা দুর্বল। ছেলেদের হলের কক্ষগুলোতে কারা থাকছেন, তা নিশ্চিত হতে আগে সপ্তাহে দুদিন রোলকল করা হতো। অনেক দিন ধরে এই ব্যবস্থা বন্ধ। প্রাধ্যক্ষ কমিটির সর্বশেষ সভায় এটি পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও কারা হলে থাকছেন, তাঁদের তালিকা করা হচ্ছে।
আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হওয়ার তিন বা চার দিন আগে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন হলে সংযুক্ত করে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটি। এরপর সব হলেই শিক্ষার্থীরা গণরুমে ওঠেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের পুরোটা সময় হলের এক অথবা দুটি গণরুমে এক থেকে দেড় শ শিক্ষার্থীকে থাকতে হয়। এরপর দ্বিতীয় বর্ষে তাঁদের স্থান হয় ‘মিনি গণরুমে’। যেখানে ২ জনের কক্ষে ৬ থেকে ৮ জন ও ৪ জনের কক্ষে ৮ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী থাকেন। এরপর ধীরে ধীরে যেসব শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন, তাঁরা অপেক্ষাকৃত ভালো কক্ষগুলোতে আসন পান। আর রাজনীতিবিমুখ শিক্ষার্থীদের আরও ছয় মাস থেকে এক বছর সেই মিনি গণরুমে থাকতে হয়। তৃতীয় বর্ষের শেষের দিকে তাঁদের আসন দেওয়া হয়।
কোন হলে কে দায়িত্বে
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলে আসন বণ্টনের কাজ করেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক রাশেদ আল নাঈম এবং গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ কর্মী নুর আমিন আকন্দ। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন শাখা ছাত্রলীগের উপছাত্র বৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী, উপ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ইসমাঈল হোসেন ও সমাজসেবা-বিষয়ক সম্পাদক কানন সরকার।
আল-বেরুনী হলের আসন বণ্টনের কাজ করেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী চিন্ময় সরকার ও দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরান আহমেদ। তাঁরা দুজনই শাখা ছাত্রলীগের কার্যকরী সদস্য। তাঁদের পৃষ্ঠপোষক সংগঠনটির সহসভাপতি আবু সাদাত সায়েম এবং কর্মী মাহমুদুল হাসান ও এনামুল হক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের আসন বণ্টনের দায়িত্ব পালন করেন ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্র ও শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল আজিম। তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মিজানুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আফফান হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লা।
মাওলানা ভাসানী হলের আসন বণ্টনের দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগের কর্মী সাজিদুজ্জামান ও সৌরভ কাপালি। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক তারেক হাসান ও কর্মী সাইফুল ইসলাম।
আ ফ ম কামালউদ্দিন হলে এই দায়িত্ব পালন করেন ছাত্রলীগের সদস্য আসিফুজ্জামান ওরফে মাহদী, কর্মী মিনহাজুল মোর্শেদ ও ওয়ালিদ ইসলাম। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা।
শহীদ সালাম-বরকত হলের আসন বণ্টন করেন উপস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পাদক আরিফ আহমেদ। পৃষ্ঠপোষকতা দেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আবু সুফিয়ান এবং গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক নীলাদ্রি শেখর মজুমদার।
শহীদ রফিক-জব্বার হলে এই কাজ করেন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ছাত্রলীগ কর্মী নিজাম উদ্দিন, নৃবিজ্ঞান বিভাগের নাহিদ ও সাজ্জাদ। পৃষ্ঠপোষকতা দেন শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মাজেদ সীমান্ত ও সাংগঠনিক সম্পাদক অভিষেক মণ্ডল।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে আসন বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করেন উপ-স্কুলছাত্র বৃত্তিবিষয়ক সম্পাদক আরিফুল ইসলাম ও সহসম্পাদক পাভেল রহমান। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দেন সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানার দাবি, হল প্রশাসনে সাত থেকে আটজন আবাসিক শিক্ষক থাকেন। তাঁরা প্রতিদিন হলে আসতে পারেন না। তাই আবাসিক হলের ছাত্রদের তালিকা তৈরি করে হল প্রশাসনকে সহযোগিতা করে ছাত্রলীগ।
‘রাজনৈতিক কক্ষ’ অছাত্রদের দখলে
২০১৬ সালে আংশিক কমিটি গঠনের পরের বছরের ২৮ এপ্রিল এক বছরের জন্য ২১৪ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেই কমিটি এখনো বহাল। ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, এ কমিটির বিভিন্ন পদে থাকা ৬৮ জনের ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেছে, চাকরি ও অন্যান্য কাজে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন অর্ধশতাধিক নেতা এবং ১০ জন নেতা বিয়ে করেছেন (ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিবাহিত ব্যক্তিরা সংগঠনের সদস্য থাকতে পারে না)।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শাখা ছাত্রলীগের অন্তত ৩০ জন পদধারী নেতা ছাত্রত্ব শেষ হয়ে গেলেও হলে আসন দখল করে রেখেছেন। এসব নেতার কক্ষে ক্ষেত্রবিশেষে দুজন বা একজন করে থাকেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কক্ষ দখল করার সংস্কৃতি আসনসংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
ছাত্রলীগ সূত্র জানায়, শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের ২৪৫ নম্বর কক্ষে একাই থাকেন। সাধারণ সম্পাদক এস এম আবু সুফিয়ান ওরফে চঞ্চল শহীদ সালাম-বরকত হলের ৩০১ নম্বর কক্ষে একাই থাকতেন। তবে কক্ষ থাকলেও গত সেপ্টেম্বর থেকে তিনি ক্যাম্পাসে আসেন না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও হলে থাকছেন শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নিয়ামুল হাসান, মামুনুর রশীদ, মাজেদ সীমান্ত, মাসুদ ইউনুস, শামীম আহমেদ শিকদার, ইউনুস আলী, আবু সাদাত ওরফে সায়েম, সারোয়ার হোসেন, নাহিদ হোসেন, জহিরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, হামজা রহমান, মেহেদী আল মাহমুদ ও অভিজিৎ নন্দী। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইন ও আফফান হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লা, তারেক হাসান, অভিষেক মণ্ডল ও পংকজ কুমার দাস, প্রচার সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মুহিদ, উপদপ্তর সম্পাদক মাঈনুল হুসাইনসহ বেশ কয়েকজন পদধারী নেতা।
ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পরও হলে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবু সাদাত সায়েম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দায়িত্বে থাকার কারণে হলে থাকতে হচ্ছে।’ সহসভাপতি মাজেদ সীমান্ত বলেন, ‘হল প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। রাজনৈতিক কাজকর্মের জন্য মাঝেমধ্যে এসে হলে থাকতে হয়।’
গেস্টরুম ও গণরুমে নির্যাতন
শতভাগ আবাসিকের তকমা লাগানো এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর গণরুমে ২৫ থেকে ১৫০ জন নবীন শিক্ষার্থীকে থাকতে হয়। অভিযোগ আছে, এসব গণরুমে ম্যানার শেখানোর নামে গভীর রাতে শিক্ষার্থীর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। নির্যাতনের ফলে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর নতুন ব্যাচের ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকে গণরুমগুলোতে নানা ধরনের গালিগালাজ ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি চলে শারীরিক নির্যাতন। মুরগি হওয়া (পায়ের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কান ধরা), সংশপ্তক হওয়া (এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভাস্কর্য), জানালার রড ধরে ঝুলে থাকা, বিভিন্ন ধরনের বিকৃত যৌন আচরণের মতো নির্যাতন চলে গণরুমে থাকা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ওপর। ছাত্রীদের হলে নির্যাতনের মাত্রা কম।
গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম-বরকত হলের ছাত্র মিজানুর রহমান র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। দীর্ঘদিন মানসিক চিকিৎসা নেওয়ার পর গত বছরের ২৭ জুলাই তিনি ক্যাম্পাসে ফেরেন।
পরে হল পরিবর্তন করে মিজানুরকে আল-বেরুনী হলে দেওয়া হয়। তিনি এখন প্রথম বর্ষের সঙ্গে ক্লাস করছেন। মিজানুর গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমার জীবন থেকে একটা বছর নষ্ট হয়ে গেছে। আমার এ বছর দ্বিতীয় বর্ষে থাকার কথা ছিল। আমি চাই না আর কারও সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা ঘটুক।’
সবচেয়ে বড় গণরুম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে। এখানে ১০০ থেকে ১৫০ জন নবীন শিক্ষার্থী থাকেন। এখানে চলতি বছরের জুলাইয়ে মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র মো. শিহাবের থাপ্পড়ে গণিত বিভাগের ছাত্র ফয়সাল আলমের কান ফেটে যায়। এ ছাড়া র্যাগিংয়ের হুমকি দেওয়ায় হল ছেড়ে এক রাত খোলা আকাশের নিচে কাটান হলের প্রথম বর্ষের অনেক শিক্ষার্থী।
চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী হলের ১১৪ নম্বর কক্ষে বাংলা বিভাগের জাহিদ হাসান ও নজরুল ইসলামের থাপ্পড়ে মোশাররফ হোসেন নামের এক ছাত্রের কানের পর্দা ফেটে যায়। হলটির ১১২, ১১৩ ও ১১৪ নম্বর কক্ষ গণরুম হিসেবে পরিচিত।
গত বছরের মার্চে মীর মশাররফ হোসেন হলের গণরুমে বড় ভাইদের জানালার গ্রিল ধরে ঝোলার ‘নির্দেশ’ মানতে গিয়ে কোমর ও পায়ে চোট পান পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আজওয়াদ রহমান। ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে চিকিৎসকের কাছে ‘টয়লেটে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে’ বলার নির্দেশ দেন নির্যাতনকারীরা।
একই হলের গণরুমে ২০১৭ সালের মে মাসে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের ছাত্র রাজন মিয়াকে থাপ্পড় মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের রাকিব হাসান ও অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সাকিব জামান। রাজন মিয়া এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েও পরে প্রত্যাহার করে নেন। ছাত্রলীগের একটি সূত্র জানায়, রাজনকে চাপ দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করানো হয়। রাজন মিয়া এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, ‘আমরা র্যাগিং ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। ছাত্রলীগের কেউ নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
১৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাধ্যক্ষ কমিটির জরুরি সভায় র্যাগিং পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধের জন্য প্রাধ্যক্ষ কমিটি ও প্রক্টরিয়াল বডির সমন্বয়ে চারটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এসব কমিটিকে যেকোনো সময় হল পরিদর্শনের ক্ষমতা এবং সপ্তাহে অন্তত দুই দিন হল পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি হলের প্রধান ফটক ও গেস্টরুমে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য প্রতিটি হলে ৬০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
অস্ত্রের দৌরাত্ম্য, প্রশাসন নীরব
নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে প্রতিটি হলেই বিপুল অস্ত্রের মজুত আছে। ছাত্রলীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ছেলেদের আটটি হলে দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। প্রতিটি হলে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা এসব অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন।
মাওলানা ভাসানী হলের সাবেক প্রাধ্যক্ষ ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের সংঘর্ষের ঘটনাগুলো দেখে মনে হয়, আবাসিক হলগুলোতে অস্ত্রের পরিমাণ বেড়েছে। অস্ত্র থাকার কারণে ছোট ঘটনা থেকে বড় সংঘর্ষের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশাসন এখনই ব্যবস্থা না নিলে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।
চলতি বছরের ৩ জুলাই মিষ্টি খাওয়ার সময় ধাক্কা লাগাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ও মাওলানা ভাসানী হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় অন্তত ১১টি গুলির শব্দ শোনা যায়। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ-বাণিজ্যের টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় অন্তত ছয়টি গুলির শব্দ শোনা যায়।
সংঘর্ষ ছাড়াও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তুচ্ছ বিষয়ে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করেন। এ বছরের ৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আন্তবিশ্ববিদ্যালয় হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল। খেলা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পিস্তল দেখিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়ায় মাঠ ছাড়েন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলোয়াড়েরা।
গত বছরের ২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে ছাত্রী উত্ত্যক্তের ঘটনার জেরে মধ্যরাতে আল-বেরুনী ও মীর মশাররফ হোসেন হলের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ান। এ সংঘর্ষে দেশি অস্ত্রের ব্যবহারের পাশাপাশি দুটি গুলির শব্দ শোনা যায়।
আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি জুয়েল রানা বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কাছে অস্ত্র আছে কি না, জানা নেই। বহিরাগতদের কাছে থাকতে পারে। আমরাও চাই বহিরাগতদের হল থেকে বের করে দেওয়া হোক। এ ক্ষেত্রে হল প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে চাইলে আমরা সহযোগিতা করব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রক্টরিয়াল বডি প্রস্তুত আছে। যেকোনো দিন হলে তল্লাশি হতে পারে।
প্রতিটি ঘটনার পরই দায়সারা তদন্ত কমিটি হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণে প্রশাসনের দায় আছে, সেটি স্বীকার করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গা ছেড়ে দেওয়ায় সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। প্রশাসনকে শক্ত হাতে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে প্রশাসনের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি বাধা বলে মনে করেন তিনি।