নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার না জাতীয় সরকার—এ নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ওঠা বিতর্কের রেশ টানতে জাতীয় সরকারের নতুন ধারণা নিয়ে হাজির হচ্ছে বিএনপি। ধারণাটি হচ্ছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপিসহ মিত্রজোট যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাদের নিয়েই জাতীয় সরকার গঠন হবে। নির্বাচনে মিত্রদলগুলো জিতলেও সরকারে থাকবে, হারলেও থাকবে। অর্থাৎ নির্বাচনে যদি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক দলের কোনো শীর্ষস্থানীয় নেতা হেরেও যান, তবু তাঁদের জাতীয় সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র প্রথম আলোকে এসব তথ্য জানিয়ে বলেছে, শিগগিরই জাতীয় সরকারের এ ধারণা তুলে ধরে সব গণতান্ত্রিক দল ও মতকে একত্র করার উদ্যোগ নেবে বিএনপি। রাজনৈতিক দলগুলোকে বলা হবে নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার নয়, নির্বাচনের পর ফলাফলের ভিত্তিতে সব দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক দলকে নিয়েই জাতীয় সরকার হবে। তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন নির্বাচনকালে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার, যাদের অধীন সবার কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। নির্বার্চনে যে ফলাফল আসবে, তার ভিত্তিতে জাতীয় সরকার হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় সরকারের নতুন ধারণা সামনে রেখে শিগগির সরকারবিরোধী সব দল-মতকে সঙ্গে নিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়তে চাইছে বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, গত ১০ বছরে দেশের সমাজ ও মূল্যবোধের মারাত্মক অবনতি হয়েছে। সরকারি হস্তক্ষেপে দেশের সব রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করা হয়েছে। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। এ অবস্থায় সমাজ, আইনশৃঙ্খলা, সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই চলবে না; এসবের বড় আঙ্গিকে মেরামত করতে হবে। এর জন্য সব দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক শক্তির মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করা জরুরি। সবাই মিলে ঠিক করতে হবে কোথায় কোথায় এর মেরামত বা সংস্কার করতে হবে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, কাজটি বিএনপি একা করতে চায় না বা একা করা তাদের পক্ষে সমীচীন হবে না।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাতীয় সরকারের নতুন ধারণা উপস্থাপন করেন। এর পরপরই দলের নেতা-কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই ধারণার প্রচারণা শুরু করেন। ওই অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ প্রধান বক্তা এবং কেন্দ্রীয় নেতা জহিরউদ্দিন স্বপন বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে আজ বুধবার দুপুরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগ দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে ধ্বংস করে ফেলেছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচনে জিতলে আমরা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করব। দেশে অনেক ছোট দল, যাদের অনেক যোগ্য নেতা আছেন, তাঁরা নির্বাচনে না জিতলেও আমরা তাঁদের জাতীয় সরকারে নেব। আমরা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ করব।’
বিএনপি অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছে সরকারবিরোধী সব পক্ষকে একসূত্রে গাঁথার। এ লক্ষ্যে বিএনপির নেতারা ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক শরিক–দলের পাশাপাশি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদসহ অন্তত ৩০টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই ঐক্যপ্রক্রিয়া ভিত্তি পায়নি। ঐক্যপ্রচেষ্টার মধ্যেই বিতর্ক ওঠে নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকার হবে, নাকি জাতীয় সরকার। ২০-দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুই শীর্ষ নেতা আ স ম আবদুর রব ও অলি আহমেদ জাতীয় সরকারের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তাঁদের আগেই জাতীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ করে বক্তব্য দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
আ স ম আবদুর রব ২২ মার্চ প্রথম আলোকে বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যারাই সরকার পতনের জন্য আন্দোলন করবে, তারা সবাই মিলে একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করবে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য। এটা তাঁর প্রস্তাব, তবে এটাই চূড়ান্ত নয়। সবাই আলোচনা করে যেটা সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই চূড়ান্ত।
বৃহত্তর ঐক্যে ২০-দলের শরিক জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রাখার চিন্তা করছিলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। ভিন্ন কোনো কৌশলে তাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত রাখার কথা ভাবা হচ্ছিল। যদিও জামায়াতকে জোটে রাখা হবে কি না, কাদের নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য হবে, এর প্রক্রিয়া নিয়ে এখন পর্যন্ত স্পষ্ট কোনো রূপরেখা নেই বিএনপির। বিশেষ করে জামায়াতকে জোটে রাখা বা না রাখা নিয়ে খোদ বিএনপির ভেতরেই বিতর্ক ও মতবিরোধ আছে। এখন জাতীয় সরকারের নতুন ধারণায় জামায়াতের অবস্থান কি হবে—সে প্রশ্নও সামনে আসছে।
জামায়াতও জাতীয় সরকারে থাকবে কি না, জানতে চাইলে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির নেতা জহিরউদ্দিন স্বপন গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রীয় সংস্কারের বিষয়ে সবাই মিলে যে কর্মসূচি নির্ধারিত হবে, তাতে তারা যদি একমত থাকে এবং পরস্পরের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তখন বিষয়টি সবাই মিলে ঠিক করবে।
দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন, নাকি নির্দলীয় সরকার অথবা জাতীয় সরকারের অধীন নির্বাচন—এমন আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যে বিএনপি জাতীয় সরকারের ধারণা সামনে নিয়ে আসছে।
এ বিষয়ে জহিরউদ্দিন স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে কেবল দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীন। সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি দলীয় সরকার নয়, জাতীয় সরকার গঠন করবে, যে সরকারের লক্ষ্যই থাকবে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই রাষ্ট্রকে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনা।