গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আজ শনিবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রায় ছিলেন না যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান বি. চৌধুরী। যদিও যুক্তফ্রন্টের অপর দুই দলের নেতারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে উপস্থিত ছিলেন। এ অবস্থায় ঐক্যফ্রন্টে যোগ না দেওয়ার বিষয় স্পষ্ট করতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বি. চৌধুরী।
আজ সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে বি. চৌধুরী বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গ ত্যাগ না করলে আজ থেকে বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের বৈঠকে বসবেন না। তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া সৃষ্টির লক্ষ্যে আমি স্পষ্ট বলেছি, আমাদের দুটি ব্যাপার আছে। ১ নম্বর ব্যাপার ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি, আমরা শুধু তাদের সঙ্গে ঐক্য করব। যারা আমাদের মানচিত্রকে অস্বীকার করবে, আমাদের মা-বোনদের ত্যাগ স্বীকারকে অস্বীকার করবে, মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ শহীদ—এই ইতিহাসকে যারা অশ্রদ্ধা করবে এবং এখন পর্যন্ত যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বকে স্বীকার করবে না, তাদের বাদ দিয়ে আসার কথা বলা হয়েছিল।’
সংবাদ সম্মেলনে বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) মান্নান, যুগ্ম মহাসচিব, দলের মুখপাত্র মাহী বি. চৌধুরীসহ বিকল্পধারার নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
২ নম্বর শর্তের কথা বলে বি. চৌধুরী বলেন, ‘আমরা একদলীয় শাসন দেখেছি। গণতন্ত্রে, তথাকথিত গণতন্ত্রে আমরা একদলীয় শাসন দেখেছি। গণতন্ত্রের কথা বলি, আসলে গণতন্ত্র নেই। তারপর দেখলাম জোটের সরকার হলো। চার দলের জোট, ১০ দলের জোট আরও কত কত সরকার। জোটের পর মহাজোট। ঠিক আছে। কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সেখানে একটি দলের প্রাধান্য থাকে। তারপর সত্যিকার অর্থে জোটের যে সরকার ব্যালেন্স অব ডিফারেন্ট পার্টিস (বিভিন্ন দলের মধ্যে ভারসাম্য) সেটা নেই। একটি দলের প্রাধান্য থাকে। আজকে যে স্বেচ্ছাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করছি, তাতে নাকি ১৪টি দল আছে।’
বি. চৌধুরী বলেন, ‘এই ১৪টি দলের মধ্যে সারা বাংলাদেশে যত অভিযোগ, তা একটি দলের নেতাদের বিরুদ্ধে, একটি দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে, একটি দলের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। তার মানে কী?’ তিনি বলেন, ‘এই যে স্বেচ্ছাচার, এই স্বেচ্ছাচারের অবসান চেয়েছিলাম আমরা। একটি পদ্ধতি করতে চেয়েছিলাম, যার মাধ্যমে একটি দল ১৫০ আসনের বেশি পাবে না। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০টি আসন সীমাবদ্ধ করে দেওয়া। তার ফলে ক্ষমতাসীন সেই দলের সঙ্গে যারা আছে, তাদের সঙ্গে ভবিষ্যতে পরামর্শ করে দেশ চলবে এবং তাদের দল একা স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারবে না। এটা ছিল আমাদের প্রপোজাল। এটার নাম ছিল ভারসাম্যের রাজনীতি। এটা কোনো কঠিন বিষয় না।’
বি. চৌধুরী বলেন, ‘গতকাল আমাকে বলা হলো আজ আমি ড. কামাল হোসেনর সঙ্গে দেখা করব। আমি সানন্দে বলেছি, নিশ্চয় যাব। আমি দাওয়াত কবুল করে আজ সেভাবে গেলাম। বলতেও লজ্জা লাগে, কেমন করে বলব? আমরা তাঁর (ড. কামাল হোসেন) বাসায় গেলাম, গিয়ে দেখলাম বাসার দরজা বন্ধ, বাসায় কেউ নেই। দরজা খোলার লোকও নেই, ভেতরে নিয়ে বলবে “বসেন এক কাপ চা খান, উনি বাসায় নেই, আসবেন”, তা বলার লোকও নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি একটি টেলিফোন করতে পারতেন যে “সরি বড় ভাই, আমার একটি কাজ পড়ে গেছে”—এ কথাটি বলতে পারতেন। আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন? আমি তো বিশ্বাস করতে পারি না। এখন পর্যন্ত একটি টেলিফোন তিনি (ড. কামাল) করেননি। আমি অভিযোগের সুরে বলছি না। এটি সাধারণ ভদ্রতার ব্যাপার। কিন্তু জিনিসটা হয় কী, এতে আপনার-আমার মধ্যে যে একটি আন্ডারস্ট্যান্ডিং (বোঝাপড়া) ছিল, তার মধ্যে একটুখানি সন্দেহ তৈরি হয় যে ব্যাপারটা কী? এটা কি পরিকল্পিত? এটা কি সুপরিকল্পিত, কুপরিকল্পতি না অন্য কিছু। সন্দেহ জাগবে না? অবশ্যই সন্দেহ জাগবে।’
ঐক্য প্রক্রিয়ার বিষয়ে বি. চৌধুরী বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য আমরা চাই। আমাদের চেষ্টা ছিল সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে আন্তরিক এবং সবচেয়ে ক্রমাগত। বহুদিন করেছি আমরা, বহু বছর করেছি। যখন বিএনপি আমাদের সঙ্গে এল, তখন আমরা বললাম নিশ্চয়। বিএনপির প্রতি আমার বিশেষ সহানুভূতি থাকারই কথা। আমি তো বিএনপির প্রথম মহাসচিব। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছি। এই অহংকার আমার সব সময় আছে এবং থাকবে। জিয়াউর রহমান ছিলেন সত্যিকারের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। সেই জন্য তাঁর জন্য আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ছিল। জিয়াউর রহমানের প্রতি বিএনপির যে অনুভূতি, দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও সেই একই অনুভূতি আছে।’
বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বড় করে ঐক্য করতে চাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আপস করতে রাজি নই। এখন আমি জানি, বিএনপির নেতা-কর্মীর বিপুল অংশ এতে সাড়া দেবে। কিন্তু আজকে যে কারণেই হোক, বর্তমান বিএনপির যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা এই ব্যাপারে (মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলের সঙ্গে ঐক্য) একমত হতে পারেননি। তাঁদেরও দুর্ভাগ্য, আমাদেরও দুর্ভাগ্য। ঠিক একইভাবে যত দিন পর্যন্ত তাঁরা (বিএনপি নেতারা) ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি না করবেন, তত দিন আমি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস দেখছি না।’
বিকল্পধারার চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে এবং সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা চিরকালের মতো দূর করতে হলে একটি ভারসাম্যের রাজনীতি সৃষ্টি করতে হবে। এই ভারসাম্যের কারণে মেজরিটিওয়ালা দল অন্যান্য দলের চাপে থাকবে এবং তার ফলে সত্যিকার অর্থে প্রান্তিক শাসন আসবে এবং স্বেচ্ছাচারমুক্ত আমাদের স্বপ্ন, শেষ বয়সের শেষ স্বপ্ন এই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব।’
চারদলীয় ঐক্যজোটে আপনি (বি. চৌধুরী) ছিলেন, তখন জামায়াতও ছিল? এ বিষয়ে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করতে গেলে তাঁকে থামিয়ে দেন মাহী বি. চৌধুরী। এরপরও বি. চৌধুরী প্রশ্নটির উত্তর দেন। তিনি বলেন, ‘মানুষমাত্র ভুল করে। জীবনে একটি ভুলের জন্য আমি প্রকাশ্য ক্ষমা চেয়েছি। আর তুলবেন না এই প্রশ্ন।’
আজ আপনাদের বাদ দিয়ে ঐক্য প্রক্রিয়া গঠন করা হলো, আপনাদের বাদ দেওয়া হয়েছে, নাকি আপনারা যোগ দেননি? সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে মাহী বি. চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে এখনো সরিনি, আমরা বলছি না। ওনারা যদি বাদ দিয়ে থাকেন, তাহলে ওনাদের ঘোষণা দিতে হবে। আমরা এখনো মনে করি জাতির প্রত্যাশা, স্বাধীনতাবিরোধীদের বাদ দিয়ে একটি জাতীয় ঐক্য, সেই স্বপ্ন জাতির সঙ্গে আমরা এখনো দেখি।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণা মঞ্চ থেকে বলা হয়, তাঁদের সঙ্গে থাকা বিকল্পধারা এখনো তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়নি, তাঁরা আশা করছেন তাঁরা যোগ দেবেন। এ বিষয়ে এক সাংবাদিক দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মাহী বি. চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি ২০ দলে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসতে পারে, সেখানে বিবাহিত ওখানে পরকীয়া—আমরা মনে করি আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নারও আসল বিবাহ এখানে, ওখানে পরকীয়া চলছে। ইনশা আল্লাহ ঠিক হয়ে যাবে।’
সংবাদ সম্মেলনে অপর এক প্রশ্নের জবাবে মাহী বি. চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপিকে এককভাবে ক্ষমতায় বসানোর কোনো চক্রান্তে আমরা নেই।’ এ সময় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে দাওয়াত পাননি বলেও জানান তিনি।
বিকল্পধারার মহাসচিব আবদুল মান্নান সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়েন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আজকের দুঃশাসনের হাত থেকে জাতির মুক্তির জন্য আমরা অনেক দিন থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছি। প্রথম দফায় আমরা জেএসডি এবং নাগরিক ঐক্যকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করি। পরে ড. কামাল হোসেনের ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি ও লক্ষ্য নিয়ে বৃহত্তর ঐক্যের একটি প্রক্রিয়া শুরু করি। এ বিষয়ে বিকল্পধারা সব সময়ই আন্তরিক ছিল।’
আবদুল মান্নান বলেন, ‘মাহমুদুর রহমান মান্নাকে নিয়ে ঐক্য প্রক্রিয়ার আপত্তি থাকলেও আমরা তাঁর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করি এবং উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বৃহত্তর ঐক্য গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করি। পরবর্তী সময়ে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য প্রক্রিয়া সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিকল্পধারা এই ঐক্য প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সচেষ্ট ছিল। শুধু নীতির প্রশ্নে দুটি প্রধান দাবিকে সামনে রেখে বিকল্পধারা অনড় অবস্থান গ্রহণ করে।’
আবদুল মান্নান লিখিত বক্তব্যে আরও বলেন, ‘গতকাল ১২ অক্টোবর আ স ম আবদুর রবের বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ বেলা সাড়ে তিনটায় গণফোরাম নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টু ড. কামাল হোসেনের পক্ষে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় বৈঠকে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ড. কামাল হোসেন তখন বাড়িতে ছিলেন না এবং তাঁর বাড়ির দরজা খোলার জন্য কোনো লোকও বাসায় ছিলেন না। এটি শিষ্টাচারের কোন পর্যায়ে পড়ে, তা সহজেই অনুমেয়।’
আবদুল মান্নান বলেন, ‘আজ দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে। এক, জনগণকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে পরোক্ষভাবে একটি ঐক্য গড়ে তোলার অপচেষ্টা। দুই, নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে বিকল্পধারার অনড় অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে একটি চক্র জাতির প্রত্যাশিত ও স্বপ্নের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করতে চায়—এটা আজ জাতির সামনে পরিষ্কার।’
লিখিত বক্তব্যে মান্নান আরও বলেন, ‘আজকের পর থেকে জাতীয় ঐক্যের নামে বিএনপির সঙ্গে কোনো বৈঠকে বসে জাতিকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ বিকল্পধারা দেবে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গ ত্যাগ না করে জাতীয় সংসদে ভারসাম্যের ভিত্তিতে স্বেচ্ছাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা বর্তমান বিএনপির পক্ষ থেকে না আসা পর্যন্ত শুধু বিএনপিকে এককভাবে ক্ষমতায় বসানোর জন্য বিকল্পধারা দেশে কোনো চক্রান্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে না।’