রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

ছাত্র হলের আসন নিয়ন্ত্রণে ছাত্রলীগই ‘সর্বেসর্বা’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোর আসন খালি হওয়ামাত্র তা চলে যায় ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। এরপর চাঁদা দিলে সেই আসন শিক্ষার্থী তুলে দেওয়া হয়। বৈধভাবে হল প্রশাসন ফাঁকা আসনে (সিট) শিক্ষার্থী তুলে দিলে তাকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।

হলের ফাঁকা আসনে শিক্ষার্থী তোলা নিয়ে প্রায়ই প্রাধ্যক্ষদের সঙ্গে ছাত্রলীগের বাগ্‌বিতণ্ডা লেগে থাকে। সম্প্রতি একটি হলে এক প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে। হলগুলোতে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য আর প্রশাসনের নিশ্চুপ থাকা নিয়ে গত সোমবার রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে আবাসিক হলের সংখ্যা ১৭। এর মধ্যে ছাত্রীদের ছয় হলে ৪ হাজার ৮৫ জন আর ছাত্রদের ১১টি হলে ৫ হাজার ৩৯৩ জন শিক্ষার্থী থাকতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। বাকিরা বাইরে মেস-বাসা ভাড়া করে থাকেন। হলসংকট নিরসনে দুটি ১০ তলা করে হল নির্মাণাধীন রয়েছে।

আবাসিক হলগুলোতে সিটবাণিজ্য, হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের হয়রানি ও নিপীড়ন এবং শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রতিবাদে মানববন্ধন করেন সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। গতকাল সকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে

বৈধভাবে হলের আবাসিকতা পেলেও আসন ফাঁকা না পেয়ে মাসের পর মাস ঘুরছেন, এমন অন্তত ২০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, আসন বরাদ্দের পর থেকেই হলের ভাড়া পরিশোধ করতে হলেও থাকতে হচ্ছে মেসে। এমনই একজন ফার্মাসি বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের মো. ইবনে কাশির। তিনি ২০২০ সালে মাদার বখ্শ হলের ১১১ নম্বর কক্ষে আসন বরাদ্দ পান। যতবার হলে গেছেন, কর্তৃপক্ষ তাকে বলেছে নিজে আসন দেখে উঠতে। কিন্তু গিয়ে দেখেছেন তাঁর বরাদ্দ করা কক্ষে অন্য কেউ থাকছেন। ইবনে কাশির বলেন, ‘আমি প্রতিবন্ধী, আসন পাওয়ার পরও উঠতে পারলাম না। এ বছরই মাস্টার্স শেষ হবে। থাকার স্বাদ নিতে পারলাম না। বেতন দিয়ে গেলাম।’

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২ জুন রাতে শহীদ ড. শামসুজ্জোহা হল থেকে শরিফুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীকে বের করে দেয় ছাত্রলীগ। পরদিন পুনরায় তাঁকে হলে তুলে দেন প্রাধ্যক্ষ। এ ঘটনায় সেদিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রাধ্যক্ষকে শাসিয়ে যান বলে অভিযোগ ওঠে। ৫ জুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রলীগের সভা হয়। সেখানে এ ঘটনার মীমাংসা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এ নিয়ে প্রাধ্যক্ষ মো. একরামুল ইসলাম কিছু বলতে রাজি হননি।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, গত ২৮ মে রাত ১২টার দিকে হবিবুর রহমান হলের ২৩৪ নম্বর কক্ষের শিক্ষার্থী তুষার রায়কে নামিয়ে অন্য এক শিক্ষার্থী তুলে দেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। সেদিনের একটি অডিও রেকর্ডে এক ছাত্রলীগ নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘রবিবার কোন স্যার সমাধান করবে? আমাদের ছেলে এখানে থাকবে বলে যাওয়া হলো না, বৈধ আসন কার দেখবনিনে।’ পরে গণমাধ্যমকর্মীরা এ নিয়ে তৎপর হলে প্রাধ্যক্ষ পুনরায় তুষারকে ওই আসনে তুল দেন। তবে এ মাসেই প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব শেষ হবে, তখন ছাত্রলীগ ঝামেলা করতে পারে বলে আশঙ্কা তুষারের।

তাঁরা হলের এই ইস্যুকে খুব ‘সিরিয়াসলি’ নিয়েছেন। এটাকে সঠিক নিয়মে আনার জন্য যা যা করার দরকার, তা তাঁরা করবেন। তাঁরা চান, এই প্রতিবাদের পর ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন আসবে। যদি না আসে তবে তাঁরা প্রতিবাদ করবেন।
সালেহ্ হাসান নকীব, মানববন্ধনটির ডাক দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক

সোহরাওয়ার্দী হলে ১১ জুন রাতে ৪৭৬ নম্বর কক্ষে ছাত্রলীগ তাঁদের এক কর্মীকে তুলে দেয়। ওই কক্ষে আগে থেকেই আসিফ আলম নামে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরে আসিফ বিষয়টি জানালে প্রাধ্যক্ষ তিন দিন সময় নিয়েছেন। বর্তমানে ওই আসনে দুজন ভাগাভাগি করে থাকছেন।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হলগুলোতে ছাত্রলীগের আসন-বাণিজ্যে অতিষ্ঠ তাঁরা। হলে থাকলে মিছিল-মিটিংয়ে যেতে হয়। ভয়ে বৈধভাবে ওঠা শিক্ষার্থীরাও ছাত্রলীগকে টাকা দিয়ে থাকেন। টাকা না দিলেই তাঁদেরও নামিয়ে দেওয়া হতে পারে।

শেরেবাংলা ফজলুল হক হলের একজন শিক্ষার্থী বলছেন, তিনি প্রাধ্যক্ষের মাধ্যমে হলে উঠলেও ছাত্রলীগের এক পক্ষ তাঁর কাছে টাকা চায়। নিরাপত্তার জন্য তিনি এক নেতাকে ৩ হাজার টাকা দেন। অন্য পক্ষকে কেন টাকা দেওয়া হলো না, এ নিয়ে একবার তাঁকে নামিয়ে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য ছাত্রলীগকে ‘ম্যানেজ’ করে তিনি হলেই থাকছেন।

ছাত্রলীগের এক পক্ষকে চার হাজার টাকা দিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে উঠেছিলেন এক শিক্ষার্থী। পরে হলে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন হয়। তাঁরা এসে ওই শিক্ষার্থীকেও নামিয়ে দেন। পরে গণমাধ্যমকর্মীদের কারণে ওই শিক্ষার্থীকে হলে তুলে দিতে বাধ্য হন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রতিটি হলের প্রায়ই কক্ষেই কোনো না কোনোভাবে আসন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ছাত্রলীগ। তারা আসন বিক্রি করেছে, নয় তো তাদের কাছের কোনো কর্মীকে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

হলে আসন–বাণিজ্য ও আবাসিক শিক্ষার্থীদের হয়রানির প্রতিবাদে গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা। তাঁরা বলেছেন, হলগুলোতে ছাত্রলীগ ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। তারা হল থেকে বৈধ শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে। এ রকম বহু শিক্ষার্থী রয়েছেন, যাঁরা ছাত্রলীগের অত্যাচারে নীরবে হল ত্যাগ করেছেন। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না।

মানববন্ধনটির ডাক দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব। তিনি গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা হলের এই ইস্যুকে খুব ‘সিরিয়াসলি’ নিয়েছেন। এটাকে সঠিক নিয়মে আনার জন্য যা যা করার দরকার, তা তাঁরা করবেন। তাঁরা চান, এই প্রতিবাদের পর ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন আসবে। যদি না আসে তবে তাঁরা প্রতিবাদ করবেন।

ছাত্রলীগ হলে কোনো আসন–বাণিজ্য করে না, আসন দখলও করে না বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ। তিনি বলেন, এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পেলে তাঁরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন। জোহা হলে প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁরা ওই দিন শুধু কথা বলতে গিয়েছিলেন। তাঁরা বসে বিষয়টি সমাধান করেছেন। প্রাধ্যক্ষ যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই সমাধান হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, হলগুলোর সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। আগের যে সমস্যাগুলো হয়েছে, সেগুলো দেখা হচ্ছে। হল প্রাধ্যক্ষদের ক্ষমতা রয়েছে, তা তাঁরা বাস্তবায়ন করলেই এ সমস্যা কেটে যাবে। তিনি আরও বলেন, তাঁরা চান বৈধ শিক্ষার্থীরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই হলে থাকবেন এবং এটা নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন।