ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে গত ছয় বছরে ৩৯ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতির দাবি, এই সংখ্যা ৮-১০ এর বেশি হবে না; বরং বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের হামলায় ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন।
গত ছয় বছরে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে বা অন্য সংগঠনের সঙ্গে অন্তত ৪৩২টি সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৫৪ জন। নিজ সংগঠনের ৩৯ জনের বাইরে বাকি ১৫ জনের মধ্যে দুটি শিশু এবং অন্যরা প্রতিপক্ষ সংগঠনের কর্মী বা সাধারণ মানুষ। এসব সংঘর্ষে আহত হয়েছেন দেড় হাজারের বেশি। এই ছয় বছরে অন্য ছাত্রসংগঠনের হাতে ছাত্রলীগের ১১ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন।
২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল (২১ নভেম্বর ২০১৪) পর্যন্ত প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন ঘেঁটে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তি-বাণিজ্য, শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক-পুলিশের ওপর হামলাসহ নানা ঘটনায় বারবারই আলোচনায় উঠে এসেছে ছাত্রলীগ।
সর্বশেষ, গত বৃহস্পতিবার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ছাত্রলীগের কর্মী ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসনের (বিবিএ) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমন দাস নিহত হন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন। ওই দিন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে গত এক বছরে এ নিয়ে চারবার এ ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল।
গত ছয় বছরে ছাত্রলীগের সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে অধর্শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়েছে। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। একাধিকবার বন্ধের ঘটনা ঘটেছে অন্তত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চারবার এবং কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় তিনবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়েছে। বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
ছয় বছরে ছাত্রলীগের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ১৬৩ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ছাত্রদের বহিষ্কার করলেও তাঁরা নানা কৌশলে ফিরে আসেন ক্যাম্পাসে, অংশ নেন পরীক্ষায়ও।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এক বক্তব্যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, বর্তমান কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে ৬২২ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এঁদের মধ্যে কয়জনের বহিষ্কারাদেশ কার্যকর হয়, সে সম্পর্কে ছাত্রলীগের নেতারাই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। বহিষ্কার হওয়া নেতা-কর্মীরা সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নেন বলে বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামানকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারি না। আমরা সংগঠন থেকে বহিষ্কার করি, পরে তাঁদের বিরুদ্ধে যদি পুলিশ বা প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তাদের কাছেই জানা উচিত, কেন নিচ্ছে না।’
দলীয় কোন্দল: চলতি বছরের ৩১ মার্চ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) আশরাফুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সায়াদ ইবনে মমতাজ নিহত হন। তিনি মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে দ্বন্দ্ব ও পূর্বশত্রুতার জের ধরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই সায়াদকে হত্যা করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মামলায় কারও নাম উল্লেখ করেনি। অথচ প্রশাসন এ ঘটনায় জড়িত থাকায় ছাত্রলীগের ছয় নেতাকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে।
পুলিশ এই মামলায় ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ১৪ নেতা-কর্মীকে আসামি করে ময়মনসিংহ আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। এঁদের মধ্যে সুজয় কুমার কুণ্ডু, রুকনুজ্জামান ও অন্তর চৌধুরী নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও প্রথম দুজন জামিনে আছেন। মামলার অন্য আসামিরা পুলিশের কাছে ‘পলাতক’।
গত ৪ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ নিজ কক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এই ছাত্র পরবর্তী সম্মেলনে সংগঠনের ওই হল শাখার সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, পদ নিয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অন্তঃকোন্দলেই প্রাণ হারান তিনি। এ হত্যাকাণ্ডের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও হত্যায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ। এ ছাড়া ২০১০ সালের ১৫ আগস্ট ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের তিনতলার ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হলে ছাত্রলীগ নেতা নাসিরুল্লাহ নাসিম মারা যান।
চলতি বছরের ১৪ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলামকে। ঘটনায় জড়িত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত ১২ আসামির মধ্যে মূল আসামি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সুব্রত বিশ্বাসকে নিহতের সহপাঠীরা ধরে পুলিশে দেন। কিন্তু অন্য আসামিরা নিয়মিত মিছিল-সমাবেশে অংশ নিলেও তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।
এ বছরের ৩১ আগস্ট ঢাকায় সমাবেশ শেষ করে ফেরার পথে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা তৌকির ইসলামকে। আসনে বসা নিয়ে বিবাদের সূত্র ধরে সাতকানিয়া ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী তাঁকে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দেন। তাঁকে টঙ্গীর নিমতলী থেকে উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পর মারা যান তৌকির। এ ঘটনায় কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিজেদের সংঘর্ষে প্রথম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ওই বছরের ৩০ মার্চ। ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিহত হন কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় কলেজ। কিন্তু ওই ঘটনারও কোনো সুরাহা হয়নি।
এ ছাড়া ২০১০ সালের ১২ জুলাই সিলেট এম সি কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী উদয়েন্দু সিংহকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের একটি অংশ। একই বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর গোড়ানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন ছাত্রলীগের নেতা আলী রেজা। ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কর্মী জুবায়ের আহমেদ একই সংগঠনের কর্মীদের হামলায় নিহত হন। ২০১২ সালের ১৬ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের নেতা আবদুলাহ আল হাসান সোহেল মারা যান।
গতকাল যোগাযোগ করা হলে জুবায়েরের ভাই আবদুল্লাহ আল মামুন ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ছোট ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এ মামলার চার আসামি আদালতের কাঠগড়া থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ধরা না পড়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান অবশ্য দাবি করেছেন, গত পাঁচ বছরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সংঘর্ষে মৃত্যুর সংখ্যা ৮-১০ এর বেশি হবে না; বরং বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের হামলায় ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন বলে তাঁর দাবি। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সব ঘটনায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলাও হয়েছে।
সাধারণও বাদ পড়েনি: ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মারা গেছেন নিরীহ মানুষ ও শিক্ষার্থী। বাদ পড়েনি শিশুও। ২০১৩ সালের ২৪ জুন চট্টগ্রামে রেলের দরপত্র জমা দেওয়া নিয়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগের মধ্যে গোলাগুলিতে আট বছরের শিশু আরমান হোসেন ও ২৫ বছরের যুবক সাজু পালিত মারা যান। একই বছরের ১৯ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, পূর্বশত্রুতার জের ধরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারিতে নিহত হয় শিশু রাব্বী।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর দরজি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় আটজনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১১ জনই ‘পলাতক’। এখন পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কোনোটিরই বিচার হয়নি।
২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মারা যান ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবু বকর।
ছাত্রদল নেতা খুন: এ বছরের ৪ জুন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন কলেজ ছাত্রদলের আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক তাওহীদ ইসলাম (২৬)। চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হত্যা করেন।
পরদিন মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সৌমেন দে, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হাই, সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিকুজ্জামান আকন্দসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়। মামলায় নাম থাকা ১০ জনকে ৭ জুন কলেজ থেকে বহিষ্কারও করা হয়।
এ ঘটনায় সৌমেন দে গ্রেপ্তার হন। ৮ জুন সৌমেন সিলেট মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি হত্যার দায় স্বীকার করে জড়িতদের সম্পর্কে তথ্য দেন। সৌমেন প্রায় এক মাস জেল খাটার পর সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি এখন ওই কলেজে ‘শিক্ষানবিশ চিকিৎসক’ হিসেবে কাজ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মুরশেদ আহমেদ চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁর ইন্টার্ন করার বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’
শিক্ষক-পুলিশ-সাংবাদিক কেউ বাদ পড়ছেন না: ছাত্রলীগের হাতে প্রহৃত হওয়া থেকে বাদ পড়েননি শিক্ষক, পুলিশ কিংবা সাংবাদিক। ছাত্রলীগের হাতে ছয় বছরে ৬২টি ঘটনায় অন্তত ১৭১ জন পুলিশ ও সাংবাদিক আহত হন। এ সময়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছে ৩৩টি। ছাত্রলীগের হাতে ৭৪ জন শিক্ষক লাঞ্ছিত হন। ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শংকর চন্দ্র দত্তকে পিটিয়ে কলেজ থেকে বের করে দেয় ছাত্রলীগের একটি অংশ।
ছাত্রলীগের কোনো নেতাকে আটক বা গ্রেপ্তার করা হলে এর পরিণতিও সুখকর হয়নি। কর্মী বাহিনী গিয়ে রাস্তা অবরোধ করেছে, গাড়ি ভাঙচুর করেছে। গ্রেপ্তারের পরিণতি হিসেবে ওই পুলিশ কর্মকর্তার ওপরও হামলা হয়েছে।
যখন-তখন মারামারি: ছয় বছরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা যায়, অপহরণ, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তি-বাণিজ্য, ছাত্রী উত্ত্যক্ত, ছাত্রাবাসে কক্ষ দখল, ঠিকাদারি কাজে বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল ছাত্রলীগ। দেড় শর বেশি অপরাধে আটক বা গ্রেপ্তার হয়েছেন ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মী।
তুচ্ছ যেকোনো বিষয় নিয়েই ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধেছে। গত ছয় বছরে প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সময়ে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে আড়াই শ বারের বেশি। ভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে দেড় শর বেশি। শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়া, নির্যাতন ও নিরীহ মানুষের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
অপহরণ: এ বছরের শুরু থেকে অপহরণের ঘটনার কারণে আলোচিত ছিল ছাত্রলীগ। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবির ঘটনা ঘটে অন্তত ছয়টি। ১৩ ফেব্রুয়ারি সূর্য সেন হলে মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের তরিকুল ইসলামকে অপহরণ করে আটকে রাখেন ছাত্রলীগের কর্মী আরিফুর রহমান। ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে অপহরণের অভিযোগে স্যার এ এফ রহমান হল শাখার ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. হাফিজ ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস রিফাতকে আটক করলেও গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুল আলম প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের এক দোকানদারকে ধরে নিয়ে আসেন। গত ৬ মে ফারসি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র এ বি মাইনুল ইসলামকে চানখাঁরপুল থেকে অপহরণ করেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির প্রচার সম্পাদক সোহেল রানা। ৯ মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের সামনে থেকে ফরহাদ ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ নেওয়ার অভিযোগে ছাত্রলীগের সাত নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ। তাঁরাও সবাই জামিনে আছেন। গত ১৮ নভেম্বর রাতে ছাত্রলীগের কর্মীদের সহযোগিতায় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা উৎপল সাহার ছোট ভাই এক গাড়িচালককে জগন্নাথ হলে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করেন। পরদিন মুক্তি পেয়ে গাড়িচালক মামলা করলেও কাউকে ধরা হয়নি। এত দিনেও এসব অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি।