নানা অভিযোগে ও গঠনতন্ত্রবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় ৩২ জন নেতা-নেত্রীকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দিয়েছে ছাত্রলীগ। এর মধ্যে ২১ জনের বিরুদ্ধে সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের আনা অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। আর বাকি ১১ জন পদ থেকে অব্যাহতি নিতে নিজেরাই আবেদন করেছিলেন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে ছাত্রলীগ। আংশিক কমিটি প্রকাশের প্রায় ১০ মাস পর চলতি বছরের ১৩ মে ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। ওই দিনই সন্ধ্যায় কমিটিতে পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে হামলার শিকার হন। এতে সংগঠনের কয়েকজন নারীনেত্রীসহ ১০-১২ জন আহত হন। এরপর বিতর্কিতদের বাদ দেওয়াসহ চার দফা দাবিতে কয়েক দফায় মাসব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি ও অনশন করেন পদবঞ্চিতরা।
আন্দোলনের একপর্যায়ে কমিটিতে পদ পাওয়া ৯৯ জনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ তালিকা প্রকাশ করেছিলেন ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া নেতা-কর্মীরা। অর্থের বিনিময়ে বিতর্কিতদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু আশ্বাস দিলেও তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। এরই মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় সংগঠনের তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর তিন মাসের মাথায় বর্তমান সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ৩২ জন নেতা-কর্মীকে পদবি থেকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিলেন।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, ৩২ নেতা-নেত্রীকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্দোলনকারী পদবঞ্চিতদের সেই তালিকা ছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্য আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে অনেকে নিজে থেকেই অব্যাহতি নিয়েছেন বলে ছাত্রলীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন।
দ্রুত সময়ের মধ্যে যোগ্যদের দিয়ে শূন্য হওয়া ৩২টি পদ পূরণ করা হবে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান। যাঁরা বিতর্কমুক্ত ছাত্রলীগ চেয়ে আন্দোলন করেছেন, তাঁদের পদবি দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার বা প্রাধান্য দেওয়া হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদবঞ্চিত বা আন্দোলনকারীদের আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। যাঁরা মাঠে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে থেকেই শূন্য পদ পূরণ করা হবে।
কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ ছিল
অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় কমিটি থেকে বাদ পড়া ২১ নেতা-নেত্রীর মধ্যে রয়েছেন ১৩ জন সহসভাপতি, দুজন সম্পাদক, চারজন উপসম্পাদক ও দুজন সহসম্পাদক। সহসভাপতি তানজিল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে নির্ধারিত বয়সের চেয়ে বেশি বয়স, ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িত ও মাদকসেবী। আরেফিন সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মাদকাসক্তি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা এবং ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা, বরকত হোসেন হাওলাদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একসময় স্থায়ীভাবে বহিষ্কার হওয়া, শাহরিয়ার কবিরের বিরুদ্ধে মাদকাসক্তি, মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ও মাদক মামলার আসামি, সাদিক খানের বিরুদ্ধে মাদকাসক্তি ও দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকা, সোহানী হাসানের বিরুদ্ধে বিবাহিত, মুনমুন নাহারের বিরুদ্ধে জামায়াত পরিবারের সন্তান ও বিবাহিত, আবু সাঈদের বিরুদ্ধে সংগঠন থেকে আজীবন বহিষ্কার হওয়া, রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও বিবাহিত, রাকিব উদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট থাকা, সোহেল রানার বিরুদ্ধে বেশি বয়স হওয়ার অভিযোগ ছিল। দপ্তর সম্পাদক আহসান হাবীবের বিরুদ্ধে চাকরিজীবী, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক তাজ উদ্দীনের বিরুদ্ধে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক পদধারী নেতা, উপদপ্তর সম্পাদক মমিন শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মীর অভিযোগ ছিল। এ ছাড়া উপদপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আবদুল্লাহ বিন মুন্সীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন, যা ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। বিবাহিত হওয়ার অভিযোগে কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপসম্পাদক লিপি আক্তার, সংস্কৃতিবিষয়ক উপসম্পাদক আফরিন লাবণী ও সামিয়া সরকার ৷ সহসম্পাদক রনি চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলার কোলা ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আসিফ হাওলাদার হত্যা মামলার আসামি৷ সহসভাপতি ইসমাইল হোসেনকে কী অভিযোগে বাদ দেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি৷
অন্যদিকে নিজ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যে ১১ নেতা-নেত্রীকে ছাত্রলীগ পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়, পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশের পর তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠেছিল ৷ অব্যাহতি নেওয়া সহসভাপতি এস এম তৌফিকুল হাসানের বিরুদ্ধে তাঁর বাবা সোহরাব উদ্দিন একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত, সহসভাপতি আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হওয়া, সহসভাপতি বি এম শাহরিয়ার হাসানের বিরুদ্ধে চাকরিজীবী, সহসভাপতি এস এম হাসান আতিকের বিরুদ্ধে বিবাহিত ও সরকারি চাকরিজীবী, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা বিষয়ক উপসম্পাদক শাফিউল সাজিব চাকরিজীবী ও সংগঠনে আগে কোনো পদবি না থাকা, উপপ্রচার সম্পাদক সিজাদ আরেফিন ও পাঠাগারবিষয়ক উপসম্পাদক রুশী চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিবাহিত এবং সহসম্পাদক আঞ্জুমানারা অনুর বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল ৷
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা বিষয়ক সম্পাদক শাহরিয়ার ফেরদৌস ও উপসম্পাদক রাতুল সিকদারের অব্যাহতি নেওয়ার কারণ জানা যায়নি। আর সহসভাপতি হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না৷ সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের একটি পদে যোগ দেওয়ায় অব্যাহতি নিয়েছেন তিনি ৷
বিভিন্ন অভিযোগে সংগঠন থেকে ৩২ জনকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র রাকিব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আরও যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাঁদের বাদ দেওয়া এবং যোগ্যদের পদবি দিলে তবেই এই পদক্ষেপ পূর্ণতা পাবে।