ছাত্রলীগ করলে হলে আসন, সাধারণ ছাত্রের ঠাঁই নেই

ছাত্রদের সাতটি হলের ১ হাজার ৮০টি কক্ষের মধ্যে ১ হাজারটি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হলে পাঁচ বছর ধরে আসন বরাদ্দ দেয় না কর্তৃপক্ষ। আবাসিক হলগুলোর কোন কক্ষে কে থাকবে, তা ঠিক করে দেন সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা। ভর্তি হওয়ার পর যাঁরা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন, কেবল তাঁরা হলে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন।

শুধু তা–ই নয়, পড়াশোনা শেষ করেও বিভিন্ন হলের কক্ষ দখল করে আছেন ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ অন্তত ৯ জন নেতা। আর আসন বরাদ্দ না পাওয়া সাধারণ ছাত্রদের বাড়তি খরচে থাকতে হচ্ছে ক্যাম্পাস ও চট্টগ্রাম শহরের মেস-কটেজে।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রদের সাতটি হল শাহজালাল হল, শাহ আমানত হল, শহীদ আবদুর রব হল, এ এফ রহমান হল, আলাওল হল, সোহরাওয়ার্দী হল ও মাস্টারদা সূর্য সেন হলের ১ হাজার ৮০টি কক্ষের মধ্যে ১ হাজারটি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। বাকিগুলোতে ক্যাম্পাসে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা থাকছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১৪টি আবাসিক হল রয়েছে। তবে নতুন নির্মিত দুটি ছাত্র ও একটি ছাত্রী হলে এখনো পর্যন্ত কাউকে ওঠানো হয়নি। বাকি ১১টি হলের মধ্যে ছাত্রদের জন্য রয়েছে সাতটি ও ছাত্রীদের চারটি। এসব হলে মোট আসন রয়েছে ৪ হাজার ২৮০টি। ছাত্রদের সাতটি হলে আসন ২ হাজার ৭৩০টি। নিয়ম মেনে সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুনে আবাসিক হলগুলোতে আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য ছাত্রী হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাদ্দ দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, স্নাতকে প্রতিবছর ৪ হাজার ৯২৬ শিক্ষার্থী ভর্তি হন। এর মধ্যে ছাত্র গড়ে ৬০ শতাংশ। বর্তমানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ২৭ হাজার ৫৫০ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১৭ হাজার ৪৯৪ জন।

ছাত্র হলে আসন বরাদ্দ না দেওয়ার বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও হলের প্রাধ্যক্ষেরাও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এদিকে আসন বরাদ্দ না দিলেও প্রতিবছর ছাত্রদের হলের সাতজন প্রাধ্যক্ষ ও ২৭ জন আবাসিক শিক্ষক ভাতা নিচ্ছেন। আবাসিক শিক্ষকেরা প্রতি মাসে মূল বেতনের ১১ শতাংশ আর প্রাধ্যক্ষেরা পান ১২ শতাংশ করে।

কোন হলে কারা

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুটি পক্ষে বিভক্ত। তাদের একটি পক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী ও সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীপুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরীর এবং আরেকটি পক্ষে হচ্ছে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। আবার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটিও দুই সদস্যের—সভাপতি রেজাউল হক মহিবুল হাসানের ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন আ জ ম নাছিরের অনুসারী। ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে রয়েছে ১১টি উপপক্ষও। এর মধ্যে বিজয় ও চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার (সিএফসি) মহিবুলের, বাকি ৯টি উপপক্ষ নাছিরের অনুসারীদের।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রদের সাতটি হল শাহজালাল হল, শাহ আমানত হল, শহীদ আবদুর রব হল, এ এফ রহমান হল, আলাওল হল, সোহরাওয়ার্দী হল ও মাস্টারদা সূর্য সেন হলের ১ হাজার ৮০টি কক্ষের মধ্যে ১ হাজারটি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। বাকিগুলোতে ক্যাম্পাসে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিক ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা থাকছেন। এর মধ্যে শাহজালাল ও মাস্টারদা সূর্য সেন হলে একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে নাছিরের অনুসারীদের। বাকি হলগুলো কক্ষের ভিত্তিতে দুই পক্ষের নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন।

হলে আসন নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা সংকটে পড়েন, তাঁদের আমরা সহযোগিতা করি। কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাঁদের হলের থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ ছাত্রলীগ না করলে আসন না পাওয়া প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন।

কষ্টে সাধারণ ছাত্ররা

হলে থাকার জন্য একজন ছাত্রের প্রতি মাসে কোনো ফি দিতে হয় না। নাশতা, যাতায়াতসহ খরচ পড়ে ৩ থেকে ৬ হাজার টাকা। আর কটেজে (ব্যক্তিমালিকানাধীন আধা পাকা কক্ষ) তাঁদের খরচ হয় ৫ থেকে ৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে মেসে বসবাসরত ছাত্রদের খরচ সব মিলিয়ে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। ক্যাম্পাসের আশপাশের বিভিন্ন কটেজ-মেসে অন্তত পাঁচ হাজার ছাত্র থাকেন।

আবাসিক হলে বরাদ্দ না পাওয়া বিভিন্ন বিভাগের ২০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। শিক্ষার্থীরা বলেন, হলে উঠতে হলে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে হয়। কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে উঠলেও সংঘাতের ভয়ে হল ছেড়ে চলে আসেন। যদি নিয়মিত বরাদ্দ দেওয়া হতো এবং কর্তৃপক্ষের তদারকি থাকত তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই দুর্ভোগ হতো না।

পাস করেও হলে নেতারা

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক পরিসংখ্যান বিভাগের ভর্তি হন ১৬ বছর আগে, ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষে। তিনি স্নাতক পাস করেন ২০১০ সালে। স্নাতকোত্তর পাস করেছেন ২০১৩ সালে। তাঁর শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা অন্তত আট বছর আগেই স্নাতকোত্তর করে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন। কিন্তু রেজাউল হক এখনো ক্যাম্পাস রাজনীতিতে যুক্ত। তিনি থাকেন শাহ আমানত হলের ৩১১ নম্বর কক্ষে। রেজাউল হকের দাবি, তিনি জাপানি ভাষা কোর্সে ভর্তি আছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের মার্কেটিং বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। স্নাতক পাস করেছেন ২০১৬ সালে। এই শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর শেষ হয়েছে। তিনি থাকেন শাহ জালাল হলের ৩০৬ নম্বর কক্ষে থাকেন।

সংগঠনের সাবেক সহসভাপতি নাছির উদ্দিন শাহ আমানত হলের ৩০৯ নম্বরে, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াছ সোহরাওয়ার্দী হলের ২২১ নম্বরে, সাবেক সদস্য সাইদুল ইসলাম শাহজালাল হলের ৪১৬ নম্বরে, ভার্সিটি এক্সপ্রেসের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী শহীদ আবদুর রব হলের ২২০ নম্বরে, সিক্সটি নাইনের নেতা রাজু মুন্সি ও শামসুজ্জামান সম্রাট শাহজালাল হলের ২১৮ ও ২২২ নম্বরে ও একাকার উপপক্ষের নেতা মঈনুল ইসলাম শাহজালাল হলের ৪১৫ নম্বর কক্ষে থাকছেন।

পাস করেও হলে থাকার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক বলেন, নতুন করে আসন বরাদ্দ দেওয়া হলে নেতারা বের হয়ে যাবেন। বরাদ্দ না হওয়ায় তাঁরা এত দিন থাকছিলেন।

কর্তৃপক্ষের ভাষ্য

পাঁচ বছর ধরে আসন বরাদ্দ না দেওয়ার বিষয়ে প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ সালের দিকে আসন বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু করেও বিভিন্ন কারণে পারেননি। এরপর থেকে সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলে নতুন ছাত্ররা হলে উঠেছেন। আসন বরাদ্দ না পাওয়া নিয়ে কোনো অভিযোগও আসেনি। বাকি সময়গুলো করোনার কারণে সম্ভব হয়নি। তবে শিগগির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে আসন বরাদ্দের কার্যক্রম শুরু করা হবে বলে জানান তিনি। ছাত্রলীগের কর্মী ছাড়া অন্যরা আসন না পাওয়ার প্রসঙ্গে প্রক্টর বলেন, ‘এ ধরনের কোনো কিছু আমরা জানি না।’

পাঁচ বছর ধরে আসন বরাদ্দ না দেওয়াটা অরাজকতার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান। তিনি বলেন, এমন পরিবেশে পড়াশোনা ও হলের শৃঙ্খলা হুমকির মুখে পড়ে। এ অবস্থার সমাধান করা অতি জরুরি।