ডাকসু নির্বাচনে কেবল নিয়মিত (প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে যাঁরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) শিক্ষার্থীরাই প্রার্থী ও ভোটার হতে পারবেন। আর সান্ধ্যকালীন কোর্সে স্নাতকোত্তর, এমফিলের শিক্ষার্থী বা অন্য কোনো ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রত্ব থাকা শিক্ষার্থীরা ভোটার হতে পারলেও প্রার্থী হতে পারবেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের বিদ্যমান গঠনতন্ত্র সংশোধন ও পরিমার্জনে প্রশাসন গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটি আজ রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে তাঁদের চূড়ান্ত সুপারিশ দিয়েছে ৷ এই কমিটি ছাত্র সংগঠনের দাবি সত্ত্বেও গঠনতন্ত্রে প্রার্থী ও ভোটার হওয়ার যোগ্যতার ধারা কোনো পরিবর্তনের সুপারিশ না করায় কেবল নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
অবশ্য কমিটি বলছে, ছাত্রসংগঠনগুলোর বক্তব্য পর্যালোচনা করে এ সুপারিশ দেওয়া হয়েছে ৷ কমিটি গঠনতন্ত্র সংশোধনের বিষয়ে ডাকসুতে নতুন কয়েকটি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব ছাড়া আর কোনো মৌলিক পরিবর্তনের সুপারিশ করেনি ৷
কমিটি ভোটকেন্দ্র হলে করার ব্যাপারেই মত দিয়েছে। যদিও ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো ভোটকেন্দ্র একাডেমিক ভবনে করার সুপারিশ করেছিল।
কমিটির সুপারিশে ক্ষোভ জানিয়েছে বেশিরভাগ ছাত্রসংগঠন ৷
কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থিতার সুযোগ পাবেন না ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বেশিরভাগ শীর্ষ নেতা ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়েও বাদ পড়বেন ছাত্রলীগের চার শীর্ষ নেতার তিনজন, ছাত্রদলের চারজন, প্রগতিশীল ছাত্রজোটভুক্ত ৪টি বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদভুক্ত ৩টি ছাত্রসংগঠনের ১০ জন নেতা ৷
১০ জানুয়ারি কমিটির সঙ্গে মতবিনিময় সভার পর ১৪ জানুয়ারি তাঁদের কাছে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতারা ৷ বেশিরভাগ ছাত্রসংগঠন গঠনতন্ত্রের প্রার্থিতা সম্পর্কিত ১৯৯১ সালের সংশোধনী প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনা,৮ (ই) ধারা না মেনে অন্তত এবারের নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র হলের বাইরের একাডেমিক ভবনে করা এবং ৫ (এ) ধারার সংশোধন করে ডাকসুর সভাপতি (বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) ও নির্বাচিত সংসদের নেতাদের ক্ষমতায় ভারসাম্য আনার পক্ষে মত দিয়েছিল ৷ কিন্তু এসব বিষয়ে কোনো সুপারিশই দেয়নি কমিটি ৷ বরং আগের গঠনতন্ত্রের নিয়মাবলী অপরিবর্তিত রেখেই সুপারিশ দেওয়া হয়েছে ৷
কমিটির সুপারিশের মধ্যে ডাকসুতে কয়েকটি নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাবই শুধু রয়েছে ৷ কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলছেন, গঠনতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোতে কোনোরকম পরিবর্তন না এনে কীভাবে দ্রুত ডাকসু নির্বাচনটা করা যায়, সেই জায়গা থেকেই তাঁরা সুপারিশগুলো করেছেন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে অনুমোদনের পর গঠনতন্ত্র সংশোধনী চূড়ান্ত হবে ৷
কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, 'ডাকসুর গঠনতন্ত্রে প্রার্থী ও ভোটারের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই৷ যাঁরা সদস্য হতে পারবেন, তাঁরাই প্রার্থী হতে পারবেন ৷ ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে যাঁরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে রয়েছেন, তাঁরাই ভোটার ও প্রার্থী হতে পারবেন৷ যাঁরা স্নাতক করেননি, তাঁরা ডাকসুর সদস্য নন৷ আগের গঠনতন্ত্রে এ বিষয়ে যা ছিল, সেটিই বহাল রাখা হয়েছে৷ একমাত্র নিয়মিত ছাত্ররাই হবেন ডাকসুর সদস্য ও প্রার্থী৷'
অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, 'ডাকসু নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র কোথায় হবে, এটি একটি মৌলিক ব্যাপার ৷ যেখানকার ভোট, ভোটকেন্দ্র সেখানেই হওয়া বাঞ্ছনীয় ৷ হলের ভোট অন্য কোথাও করার দাবিটি আমাদের কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি ৷ তাই সেখানে আমরা হাত দিইনি ৷'
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, 'ছাত্রসংগঠনগুলো গঠনতন্ত্রসম্পর্কিত যেসব প্রস্তাব বা সুপারিশ বা দাবিদাওয়া জানিয়েছে, সুপারিশে আমরা সেগুলো রাখার চেষ্টা করেছি ৷ যেহেতু স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনটা করার পরিকল্পনা আছে, সেহেতু মৌলিক কোনো বিষয়ে আমরা হাত দিইনি ৷ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটির এটি করার এখতিয়ার রয়েছে বলে আমার মনে হয় না৷ এটি করতে পারে নির্বাচিত সংসদ৷ সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে নতুন কয়েকটি পদ সৃষ্টির প্রস্তাব এসেছে৷ যেমন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ইত্যাদি৷ আমাদের সুপারিশে এগুলো সংযোজনের কথা বলেছি৷'
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পদাধিকার বলে ডাকসুর সভাপতি অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, 'সুপারিশটি হাতে পেয়েছি৷ এই সুপারিশই চূড়ান্ত নয়৷ সংশোধন, পরিমার্জন যা প্রয়োজন, সেটি সিন্ডিকেটে চূড়ান্ত হবে৷'
ছাত্রসংগঠনগুলোর ক্ষোভ
সুপারিশে বেশিরভাগ ছাত্রসংগঠনের দাবিদাওয়ার প্রতিফলন না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সংগঠনগুলোর নেতারা৷ তাঁরা বলছেন, সুপারিশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি ৷ তবে ছাত্রলীগ বলছে, সুপারিশগুলো তাঁরা এখনও দেখেননি ৷ তাই এ বিষয়ে এখন তাঁদের কোনো মন্তব্য নেই ৷
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আল মেহেদী তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, 'কমিটির এই সুপারিশে ছাত্রসমাজের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি৷ মনে হচ্ছে, নিয়ন্ত্রিত কোনো জায়গা থেকে সুপারিশটি এসেছে৷ আমরা এর নিন্দা জানাই৷ পরিবেশ পরিষদের সভায় আমরা আবার বিষয়গুলো উত্থাপন করব৷'
প্রগতিশীল ছাত্রজোটের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের(বাসদ-মার্ক্সবাদী) বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, 'বেশিরভাগ সংগঠনের দাবিদাওয়াকে উপেক্ষা করে এই সুপারিশ দেওয়া হয়েছে৷ এই সুপারিশে আমরা ক্ষুব্ধ৷ সোমবার পরিবেশ পরিষদের সভায় আমরা আমাদের দাবি ও বক্তব্যগুলো আমরা আবার উত্থাপন করব ৷'
ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, 'সুপারিশে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি৷ আমরা ক্ষুব্ধ৷ পরিবেশ পরিষদের সভায় আমরা দাবিগুলো আবার উত্থাপন করব ৷ সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়া অনুযায়ী গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হবে ৷'
ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সুপারিশগুলো এখনও দেখেননি৷ না দেখে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে চান না ৷