গত রোববার বাংলাদেশে হয়ে গেল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। বেসরকারি ফলাফলে দেখা গেছে, ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ও এর ফলাফল নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিশ্লেষণ ও মতামতধর্মী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এই নিবন্ধগুলোর সারসংক্ষেপ এখানে তুলে ধরা হলো:
ওয়াশিংটন পোস্ট
মার্কিন এই সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিপুল ব্যবধানে একটি রাজনৈতিক দল জয়লাভ করেছে। বিজয়ী ও বিজিত দলের মধ্যে পার্থক্যসূচক এমন চিত্র উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে আশা করা যায়, বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে নয়।
ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে, শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতাকে আরও সংহত করছেন, কিন্তু সেটি হচ্ছে তাঁর নির্বাচনী বৈধতার বিনিময়ে। যদিও নির্বাচনের আগে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই ধারণা করেছিলেন, শেখ হাসিনাই নির্বাচনে জিতবেন। কিন্তু এত বিপুল ব্যবধানে তিনি জয়ী হবেন—সেই ধারণা ছিল খুবই কম। ভোট গ্রহণের দিন বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। কিন্তু পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, গত রোববারের অনেক আগেই মাঠ দখলে নিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ।
অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের শক্তিশালী হয়ে ওঠার বিষয়টিও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, একই সঙ্গে বাড়ছে বিরুদ্ধমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা। রোববারের নির্বাচনের পর বাংলাদেশ ক্রমে ‘একদলীয় গণতন্ত্রের’ দেশে পরিণত হতে চলেছে।
টাইম
টাইম ম্যাগাজিনের এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে গত রোববারের ভোট গ্রহণের বিভিন্ন ‘অনিয়মের’ খণ্ডচিত্র। বলা হচ্ছে, নির্বাচন উপলক্ষে ভোটারদের ওপর দমনপীড়ন চলেছে।
টাইম-এর মতে, বাংলাদেশের নির্বাচন পৃথিবীর গণতান্ত্রিক ধারার নির্বাচনের মধ্যে অন্যতম। গত ২০ বছরে এখানে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি। শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে এসেছে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাঁর সরকারকে ‘ধীরগতির নিপীড়ন’ চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করে আসছে।
নতুন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের সমালোচনা করে এই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এর ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সরকারের সমালোচনা করার বিষয়টি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা।
টাইম বলছে, গত রোববার ভোটারদের বাধা দেওয়ার প্রমাণাদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা ক্রমে বিদ্রূপে পরিণত হয়।
সিএনএন
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনে প্রকাশিত এক মতামতধর্মী নিবন্ধে রোববারের নির্বাচনকে ‘বিতর্কিত’ অভিহিত করে বলা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটি ‘নতুন ও বিপজ্জনক’ যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ।
সিএনএন বলছে, বিরোধীদের ‘ক্রুদ্ধ’ হওয়ার সব কারণই রয়েছে। কয়েক বছর ধরে বিরোধীদের সরিয়ে দেওয়ার একটি ‘পদ্ধতিগত প্রচারের’ সঙ্গে যুক্ত আছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগকে একটি ‘জনপ্রিয় দল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সিএনএনের এই লেখায়। বলা হয়েছে, প্রত্যাশিতভাবেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিরোধীদের নতুন নির্বাচনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাস্তবে, নির্বাচন কমিশনে গিয়ে অভিযোগ জানানো ছাড়া ক্ষোভ প্রকাশের খুব কম বিকল্পই বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর হাতে রয়েছে।
সিএনএনের এই মতামতধর্মী লেখায় আরও বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ‘অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে’ ক্ষমতা লাভের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ‘প্রায় একদলীয় রাষ্ট্রে’ পরিণত হওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন অস্পষ্ট। দেশটির তরুণ ও যুবসমাজ গণতন্ত্রের ওপর বিশ্বাস হারাতে বসেছে।
দ্য ইকোনমিস্ট
ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গত রোববারের নির্বাচনে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। ঢাকায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর হাজার হাজার পোস্টারের ভিড়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি বিএনপির প্রার্থীর কোনো পোস্টার। অন্যদিকে উঠেছে ভোট গ্রহণে নানা অনিয়মের অভিযোগ।
ইকোনমিস্ট বলছে, একটি অধিকতর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও সম্ভবত শেখ হাসিনাই জিততেন। বিভিন্ন জনমত জরিপে এগিয়ে ছিল তাঁর দল আওয়ামী লীগ। কিন্তু গত রোববারের জাতীয় নির্বাচনের পর এখন প্রশ্ন উঠেছে—আওয়ামী লীগের এই বিশাল বিজয় কি স্বস্তি আনবে, নাকি দমননিপীড়ন আরও বাড়বে?