দেশের প্রায় ২২ শতাংশ ভোটারের বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। এসব তরুণের বড় অংশ, প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ এবারই প্রথম ভোট দেবেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল নির্ধারণে এই তরুণের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ।
আবার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও নতুন ভোটার ছিল প্রায় ১ কোটি ৩৭ লাখ। সেবার অর্ধেকের বেশি আসনে ভোট না হওয়ায় (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত) এবং বিএনপি–জামায়াতের বর্জনের কারণে বাকি আসনে নতুনদের একটা অংশ ভোট দিতে পারেনি। ফলে এবারের সংসদ নির্বাচনে এই তরুণেরাও প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। ফলে প্রথমবার ভোট দিতে যাওয়া তরুণের সংখ্যাটি বেশ বড়। আড়াই কোটির মতো। এঁরা দেশের মোট ভোটারের চার ভাগের এক ভাগ।
এই পরিসংখ্যান মাথায় রেখে এবার রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্যও তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব তরুণ ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে নিতে হলে ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
২০০০ সালের ঠিক আগে আগে যাঁরা জন্ম নিয়েছেন, তাঁদের বলা হয় জেনারেশন জেড বা প্রজন্ম জেড, তাঁদের বড় অংশই সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, এই প্রজন্ম অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর আর নিজেদের অনেক বেশি বৈশ্বিক নাগরিক মনে করে। ফলে তাদের ভোট আদায় করার জন্য দলগুলোর উচিত হবে তাদের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেওয়া।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ জন এবং ২০০৮ সালে ৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৩ জন। অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে ভোটার বেড়েছে ২ কোটি ৩১ লাখ ৩ হাজার ৪৭৭ জন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোটারদের বয়সভিত্তিক বিভাজনের গোছানো কোনো তথ্য নেই। সাধারণত প্রতিবছর হালনাগাদের সময় যাঁদের বয়স ১৮ বা তার বেশি, তাঁদের ভোটার করা হয়। এর চেয়ে বেশি বয়সের এমন অনেকেও ভোটার হন, যাঁরা আগে ভোটার হননি। বিশেষ করে প্রবাসীদের অনেকে ১৮ বছর বয়সের অনেক পরেও ভোটার হয়ে থাকেন। তবে সে সংখ্যা খুব বড় নয়। আবার ১০ বছরে ২ কোটি ৩১ লাখ ভোটার বাড়লেও প্রকৃতপক্ষে এ সময়ে আরও বেশিসংখ্যক নতুন ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছেন। কারণ, ১০ বছরে কয়েক লাখ মৃত ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। প্রতিবছর গড়ে ২২ থেকে ২৪ লাখ নতুন ভোটার তালিকায় যোগ হয়। সব মিলে ১৮ থেকে ২৮ বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা ২ কোটি ৩১ লাখের বেশি হতে পারে। অর্থাৎ মোট ভোটারের কমবেশি ২২ শতাংশ ভোটার এই বয়সের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার ২২ দশমিক ৭০ শতাংশের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৩০ বছরে মধ্যে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের প্রাক্কলন বিশ্লেষণ করে তারা ওই তথ্য বের করেছে।
তবে তরুণ ও নতুন ভোটারদের ভোট দিতে উৎসাহী করাকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এ জন্য ইসি বিশেষ কর্মসূচি নিতে পারে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলের কিছু নির্ধারিত ভোট আছে। এই অবস্থায় এই সুইং ভোটারদের ওপর নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করবে বলেও মনে করেন তিনি।
২০০৮ সালের নির্বাচনে তরুণদের আকৃষ্ট করতে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণা সামনে এনেছিল আওয়ামী লীগ। সেবার বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছিল দলটি। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র জানায়, এবারও তরুণদের আকৃষ্ট করতে নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারাবাহিকতায় অনেক কিছু থাকবে।
অন্যদিকে বিএনপি মনে করছে, তরুণদের একটি বড় অংশ ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করছে; বিশেষ করে সরকারের শেষ দিকে এসে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সরকারের ভূমিকা তরুণদের একটি বড় অংশকে ক্ষুব্ধ করেছে। এই অবস্থায় বিএনপিও তরুণদের আকৃষ্ট করার চেষ্টায় থাকবে। তাদের ইশতেহারে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতে অবকাঠামো-সুবিধা বাড়ানো, নতুন সেবা আনা, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য তহবিল করা, ছেলেদের জন্য দশম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, মেয়েদের উপবৃত্তি সম্প্রসারণ করার মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় ছায়া জাতিসংঘের সভাপতি মো. রাকিবুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয় ইশতেহারে কোন দল কী বলল তা নয়; কারা তরুণদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে, তরুণেরা তাদের পক্ষেই থাকবে। তাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবিলায় দলগুলোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে।’
তরুণেরা কী চান
সরকারি হিসাবে দেশে এখন বেকার প্রায় ২৭ লাখ। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন। আর গড়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, মাত্র সাত বছরে বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারের হার বেশি। আবার বাংলাদেশের তরুণদের বড় অংশ নিষ্ক্রিয়। তাঁরা কোনো ধরনের শিক্ষায় যুক্ত নন, প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না, আবার কাজও খুঁজছেন না। মেয়েদের মধ্যে এই হার বেশি।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে নির্বাচনী হাওয়ার মধ্যে তরুণের ভাবনাজুড়ে আছে বেশ কিছু বিষয়। তরুণেরাই প্রথম আলোকে বলেছেন, এসবের মধ্যে রয়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, উদ্যোক্তা হওয়ার পরিবেশ বিনির্মাণ, চাকরির পরীক্ষার ফি কমানো, দলীয় সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ করা ইত্যাদি। তরুণদের সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলো দেখলেও এসব বিষয় স্পষ্ট বোঝা যায়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রকট হচ্ছে। দলগুলো তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে কী কী পদক্ষেপ নেবে, তার দিকে তাকিয়ে আছে তরুণসমাজ।’
বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটের ব্যবধান খুব সামান্য। এই অবস্থায় তরুণ ভোটারদের যে দল বা জোট যত বেশি টানতে পারবে, তারা তত বেশি লাভবান হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, তরুণেরা কর্মসংস্থান এবং ভবিষ্যৎমুখী রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন। তাঁদের আস্থা অর্জন করাই এবার রাজনৈতিক দলগুলোর বড় পরীক্ষা।