>• ১৮টি আবাসিক হলে অন্তত ৮১টি গণরুম রয়েছে
• গণরুমে থাকেন আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী
•১০ বছর ধরে হলগুলো ছাত্রলীগের দখলে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ডাকসু নির্বাচনের সাজ সাজ রব। নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থীরা। চারদিক ছেয়ে আছে তাঁদের ব্যানার-ফেস্টুনে। হলের আবাসনব্যবস্থার উন্নয়ন, মেধার ভিত্তিতে সিট বরাদ্দসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীদের কাছে এই প্রতিশ্রুতিগুলো ‘হাস্যকর’। এক কক্ষে গাদাগাদি করে রাত পার করার পর সকাল হলেই তাঁদের ছুটতে হচ্ছে ছাত্রলীগের নির্বাচনী প্রচারে। অনেককে আবার রাত জেগে টানাতে হচ্ছে ব্যানার ও ফেস্টুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলগুলোতে থাকার সুযোগ পান না। আর এ সুযোগে হল নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন কিছু কক্ষে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে, যা ‘গণরুম’ নামে পরিচিত। ১০ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় হলগুলো ছাত্রলীগের দখলে। দুই মাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন এসব কক্ষে অবস্থান করছেন। কোনো কোনো হলে কক্ষগুলো অছাত্র ও ছাত্রত্ব শেষ হওয়া ছাত্রলীগ নেতাদের দখলে থাকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাও ‘গণরুমে’ থাকছেন। কক্ষে থাকার ‘বিনিময়ে’ আগে তাঁদের ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে হতো। আর এখন তাঁরা অংশ নিচ্ছেন নির্বাচনী প্রচারণায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলে অন্তত ৮১টি গণরুম রয়েছে। এসব কক্ষে গাদাগাদি করে থাকেন আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে একটি গণরুমেই থাকেন প্রায় ২৫০ জন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি গণরুমে থাকেন প্রায় ৭০ জন। তবে কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের জীবন এখানে আরও কঠিন। প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী থাকেন হলের বারান্দায়। তাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের কেউ কেউও রয়েছেন।
গণরুমে অবস্থান করা এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাঁদের প্রতি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের আচরণে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো কথায় কথায় তাঁরা হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন না। ভোটের হিসাব মাথায় রেখে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন হাসিমুখে। তবে নির্বাচনী প্রচারে তাঁদের যেতে হচ্ছে ‘বাধ্যতামূলকভাবে’।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, হলে কোনো সমস্যা থাকলে সেটি দেখার জন্য হল প্রশাসন রয়েছে। প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে কথা হয় মাস্টারদা সূর্য সেন হলের প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে ছাত্রলীগের দলীয় প্যানেলের এক প্রার্থীর পক্ষে লিফলেট বিলি করছিলেন তিনি। ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘হলে থাকা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য নেই। হল থেকে বড় ভাইয়েরা লিফলেট বিলি করতে পাঠিয়েছেন।’
হলে ফেরেন কখন, এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ভাইদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। কখনো আগেভাগেই ছেড়ে দেন। আবার কখনো রাত ১০টা-১১টা বেজে যায়।’ তবে অনেককে রাত জেগে ক্যাম্পাসে ব্যানার-ফেস্টুন টানাতে হয়।
কলাভবনের সামনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা ও প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলেন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রথম বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী। তাঁর ভাষ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর গত দুই মাস আগে যে পরিস্থিতি তিনি দেখেছেন, গত ১৫ দিনে তা বেশ বদলে গেছে। কঠোরতা অনেকটা কমেছে। তবে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে তাঁদের দেওয়া হচ্ছে নানা নির্দেশনা। হল সংসদে কে কোন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তা মুখস্থ করানো হচ্ছে।
বুধবার রাত সাড়ে ১১টায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে গিয়ে দেখা যায়, হলের বারান্দায় যেখানে সারি বেঁধে শিক্ষার্থীরা শুয়ে থাকেন, তার পুরোটাই ফাঁকা। দু-একজন এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছেন। তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, দিনের প্রচারণা শেষে বিকেলের দিকে তাঁদের সহপাঠীরা ফিরে এসেছিলেন। সন্ধ্যার পর আবারও তাঁদের ডেকে পাঠানো হয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারণায় ‘গণরুমে’ থাকা শিক্ষার্থীদের জোর করে কাজে লাগানো হচ্ছে, এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রার্থীদের কাছ থেকেও। তাঁদের জোর করে নিজেদের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করা হবে—এমন অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ।
বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর প্যানেল প্রগতিশীল ছাত্রঐক্য থেকে সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী সাদেকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গণরুমগুলোতে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে। জোর করে হলেও তাঁরা এই শিক্ষার্থীদের ভোট আদায় করে ছাড়বেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তাঁর দাবি, অন্তত ডাকসু নির্বাচন উপলক্ষে হলেও গণরুমগুলোকে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনা হোক।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল থেকে ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমানের অভিযোগ, গণরুমে থাকা শিক্ষার্থীদের জোর করে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করছে ছাত্রলীগ। তাঁদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, আগের চিত্র আর এখন নেই। বর্তমান কমিটির নেতৃত্বে ক্যাম্পাসে ‘ভালোবাসার’ সম্পর্ক বিরাজ করছে। কাউকেই জোর করে প্রচারণায় নিয়ে আসা হচ্ছে না।
কলাভবন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনের চত্বরে গতকাল ছাত্রলীগের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়া অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর প্রতিবেদকের। তাঁরা সবাই ছিলেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। একজন বলেন, ‘ভাই, আপনাদের বড় ভাইরা চেনে। কথা বলছি দেখলেই খবর আছে।’ আরেকজন বলেন, ‘গণরুম হলেও হলে থাকতে পারছি। এটাই-বা কম কী। কথা বলে সিট হারাতে চাই না।’
গণরুমের শিক্ষার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় কাজ করানোর বিষয়ে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ থেকে ডাকসুর ভিপি প্রার্থী নুরুল হক বলেন, জোরজবরদস্তি করে শিক্ষার্থীদের নিজেদের দলীয় কর্মসূচিতে ব্যবহারের এ প্রবণতা থেকে তাদের সরে আসা উচিত।