সাংসদ হিসেবে শপথের বিপক্ষে থেকেও শেষ দিকে এসে বিএনপির নির্বাচিতদের সংসদে যাওয়ার প্রসঙ্গটি এখন জোরেশোরেই উঠেছে। নির্বাচিতরা চান সংসদে যেতে। তবে অপেক্ষা করছেন দলের সংকেতের জন্য। শপথের সঙ্গেই খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়ও সামনে এসেছে। এই দুই ইস্যুতে বিএনপিতেই এখন আলোচনা রয়েছে। তা ছাড়া বিএনপিতে পদ-পদবি, দলের কাউন্সিল, বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের মতো বিষয়গুলোও আলোচনায় আছে।
একাদশ জাতীয় সংসদে যোগ দিতে শপথ নেওয়ার জন্য হাতে সময় আছে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ছয়জন এবার নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি পাঁচ প্রার্থী সম্প্রতি গুলশানে বিএনপির অফিসে মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করে শপথ, দল ও নেত্রীর মুক্তির বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। মহাসচিব তাঁদের অপেক্ষা করতে বলেছেন। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির দায়িত্বশীল দুজন নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বা এখন দেশে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁরা এই সব ইস্যুতে কোনো সমাধান দিতে পারবেন না। দল এখন তাকিয়ে আছে খালেদা জিয়ার দিকে। কারাগারে থাকলেও সাংসদদের শপথ বা তাঁর প্যারোল কিংবা সরকারের সঙ্গে পর্দার অন্তরালে কোনো কোনো ইস্যুতে সমঝোতার চেষ্টা হলে সে ব্যাপারে মূল সংকেত খালেদা জিয়ার কাছ থেকেই আসতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিএনপির চেয়ারপারসনের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিএনপির সংসদে যাওয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার একটি গুঞ্জন অনেক দিন থেকেই হচ্ছে। যদিও বিএনপি বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে গুজব বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। শপথ নিয়ে দলের চেয়ারপারসনের মুক্তিসহ কয়েকটি বিষয়ে বিএনপির মধ্যে হিসাব-নিকাশ চলছে। ১১ দিনের মধ্যে শপথ বিষয়ে বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কোনো শর্ত, সমঝোতা নাকি নির্বাচিতদের আগ্রহেই সংসদে যাবে এই দল; এ প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আলোচনা উঠে এসেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, প্যারোলের জন্য খালেদার পক্ষ থেকে আবেদন করলে তা বিবেচনা করা হবে। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার মিথ্যা মামলায় তাঁকে আটকে রেখেছে এবং জামিন তাঁর প্রাপ্য।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সংসদ অনেক বড় একটি বিষয়। সেখানে দলের পক্ষ থেকে কথা বলার লোক থাকা দরকার। বিগত সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে নানা অনিয়ম হয়েছে, তবে সেখানে গিয়েই কথা বলতে হবে। শপথ নেওয়ার সময় প্রায় শেষ দিকে। তিনি বলেন, দল যদি কোনোদিকে যেতে চাইলে তা এর মধ্যেই হয়ে যাবে। আর সেটা না হলে যেভাবে যাচ্ছে যাবে। খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, সবারই নীতির মধ্যে থাকা উচিত। তবে তিনি এটাও বলেন, সব পরিস্থিতি মিলিয়ে খালেদা জিয়াকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পয়লা বৈশাখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দলের তিন শীর্ষ নেতা। সেখানেও খালেদা জিয়া কোনো সিদ্ধান্ত দেননি বলে জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম। অবশ্য পরদিন মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি দলের নয়, এটা খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবারের বিষয়। তাই এ নিয়ে দলীয় চেয়ারপারসনের সঙ্গে তাঁর খুব বেশি আলোচনা হয়নি।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অবশ্য মনে করেন, খালেদা জিয়াকে প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা রটাচ্ছে। এর সঙ্গে খালেদা জিয়ার অবস্থান এক নয়।
সরকার না চাইলে খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন না—এই কথা অনেক আগেই বলেছিলেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন। সে সময় প্যারোলের বিষয়টিও সামনে আনেন খালেদা জিয়ার এই আইনজীবী। বিএনপি চেয়ারপারসন জেলে যাওয়ার পর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার কথা বলেছিলেন। যদিও এই দুই নেতার বক্তব্য বিএনপিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এরপর বিএনপির নেতারা খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন।
বিএনপির একজন নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, তাদের দলের নেতারা সঠিক সিদ্ধান্ত সব সময় নিতে পারছেন না। বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছেন না। দেশে যারা দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট। ফলে করণীয় নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। ওই নেতা বলেন, পবিত্র শবে বরাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে পরিবার ও দলের নেতাদের কথা হতে পারে। সেখানে হয়তো কিছু বিষয়ে আলোচনা বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেছেন, খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নেওয়া অসম্মানজনক। তিনি নিয়মিত জামিন পাওয়ার অধিকার রাখেন এবং দেশে এ জাতীয় জামিনের বহু দৃষ্টান্ত আছে। তিনি বলেন, ‘সংসদে যাওয়া না-যাওয়ার যে গুঞ্জন আছে, সে ব্যাপারে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত নই। তবে প্রাথমিকভাবে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত আছে দল, ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে।’
অবশ্য ভিন্নমতও রয়েছে। বিএনপির রাজনীতি ও দলের স্বার্থে কোনো সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন দলের নেতাদের কেউ কেউ। বিএনপির দায়িত্বশীল এক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে এখন রাজনীতি, দল, সংগঠনের স্বার্থে কোনো একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিএনপির নেতাদের অনেকেই মনে করছেন, সরকার খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দেবে না। এ জন্যই প্যারোল বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। আর খালেদা জিয়া এবং দলের অনেক নেতা প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে রাজি না। এখন শপথসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলের ওপর চাপ আছে। ঐক্যফ্রন্ট থেকে এবার নির্বাচন করেছে বিএনপি। সেখানে গণফোরামের দুজন শপথ নিয়েছেন। বিএনপি থেকে নির্বাচিতরাও চাচ্ছেন সংসদে যেতে। তবে তাঁরা এও বলছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে চান না। খালেদা জিয়ার জামিন হবে, সেদিকে তাকিয়ে আছেন তাঁরা। নির্বাচিত সদস্যরা এবং বিএনপির নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি এখন সরকারের ওপর নির্ভর করছে এবং দলকেও সে অনুযায়ীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।