বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় গত ২৭ এপ্রিল। হাসপাতালে ভর্তির পর তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসকেরা বারবারই বলেছেন, খালেদা জিয়ার অবস্থা ভালো। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাঁকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় যাবেন।
কিন্তু চিকিৎসকদের এ ধারণা পাল্টে যায় ৩ মে। খালেদা জিয়া ওই দিন সকালে শ্বাসকষ্ট অনুভব করেন। বিকেলেই তাঁকে হাসপাতালের কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। দিতে হয় অক্সিজেন। ওই রাতে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে সিসিইউতে কথা হয়েছে। স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসও তিনি নিতে পারছেন। কথাও বলেছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দর সেদিন রাতে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করেন। কথোপকথনের বিষয়ে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল প্রথম আলোকে বলেন, সরকারকে বিএনপির চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয়েছে।
পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশ নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপি বা তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আবেদন করা হয়নি।
গতকাল বুধবার সকালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসকেরা বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের করোনা-পরবর্তী কিছু জটিলতা আছে। তবে কয়েক দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে চিকিৎসকেরা আশা প্রকাশ করেছেন। দুপুর পর্যন্ত সবকিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু বিকেলে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা চিকিৎসকদের চিন্তায় ফেলে দেয়। বেলা তিনটার দিকে সিসিইউতে চিকিৎসারত খালেদা জিয়ার শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। এ সময় তিনি কিছুটা বুকে ব্যথাও অনুভব করছিলেন।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, বলা যায়, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি গত কয়েক দিনে নেই। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা হওয়ায় তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির খানিকটা অবনতি হয়েছে বলা চলে। তিনি জানান, এ অবস্থার মধ্যে সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড সব রিপোর্ট ও সর্বশেষ শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার সুপারিশ করে।
হঠাৎ শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা হওয়ার ঘটনায় এবং মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ—সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার পরিবার চাইছে তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করাতে। আর এ কারণেই রাত সাড়ে আটটায় লিখিত আবেদন নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় চলে যান শামীম এস্কান্দর। লিখিত আবেদনে কী আছে, তা জানতে চাইলে একটি সূত্র জানায়, সেখানে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয়েছে। কোন দেশে খালেদা জিয়াকে তাঁর পরিবার নিতে চায়, সে সম্পর্কে চিঠিতে কিছু বলা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে ওই সূত্র জানায়, না, সে কথা লেখা নেই।
খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম গতকাল জানিয়েছেন, তাঁরা বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারে আবেদন করেছেন। আবেদনে কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি। তবে সরকার অনুমতি দিলে খালেদা জিয়াকে তাঁরা লন্ডনে নিতে চান।
বিএনপি চেয়ারপারসন দেশের বাইরে মূলত সিঙ্গাপুর ও লন্ডনে চিকিৎসা করাতেন। এ ছাড়া একবার যুক্তরাষ্ট্রেও চিকিৎসা করিয়েছেন। বেশির ভাগ রোগের ফলোআপ চিকিৎসা সিঙ্গাপুরে হয়েছে। তবে লন্ডনে নিতে চাওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে খালেদা জিয়ার একজন চিকিৎসক আজ সকালে বলেন, সেখানে তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমান আছেন। তাঁর পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান চিকিৎসক। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়গুলো মূলত তিনি দেখভাল করেন। লন্ডনে নেওয়া হলে চিকিৎসা, পরিবারের সান্নিধ্য—সবই পাবেন। ৭৬ বছর বয়সী একজন নারীর সুস্থ থাকা ও মানসিকভাবে ভালো থাকার জন্য পরিবারের সান্নিধ্যটাও অনেক জরুরি।
ওই চিকিৎসক জানান, এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত। অক্সিজেন লাগছে। শরীরে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রাও (স্যাচুরেশন) ওঠানামা করছে।
খালেদা জিয়া গত ১১ এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। আনুষ্ঠানিকভাবে আরটিপিসিআর পরীক্ষায় তিনি করোনা নেগেটিভ হননি। তবে খালেদা জিয়ার চিকিৎসক এ জে এম জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর দুই সপ্তাহ অনেক আগেই পার করেছেন খালেদা জিয়া। করোনা চিকিৎসার আন্তর্জাতিক গাইড লাইন অনুযায়ী দুই সপ্তাহ পর করোনার কোনো উপসর্গ শরীরে না থাকলে ধরে নেওয়া হয় ওই ব্যক্তির দ্বারা করোনা সংক্রমণ হবে না। এ কারণে খালেদা জিয়াকে নন-কোভিড রোগী হিসেবেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।