বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘মানবিক’ মুক্তিতেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চাওয়া পূর্ণ হয়েছে। সুবিধাজনক শর্তে খালেদার মুক্তির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় ছিল। গত কয়েক মাসে সরকার, বিএনপি ও খালেদা জিয়ার পরিবারের মধ্যে পর্দার অন্তরালে দফায় দফায় আলোচনা সবাইকে একবিন্দুতে আনতে পারেনি। কিন্তু করোনাভাইরাসজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে মুক্তির মাধ্যমে সরকারের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। আবার বিএনপি বা খালেদা জিয়ার পরিবারের চাওয়াও অনেকটা রক্ষা হয়েছে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত রেখে মুক্তি দেওয়ার ঘোষণার পর সরকারের তিনজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের চারজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের কেউ কেউ হঠাৎ খালেদা জিয়ার মুক্তিতে কিছুটা বিস্মিত। তবে তাঁরা মনে করেন, সরকার অত্যন্ত সুবিধাজনক সময়ে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে। তাঁরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকা ও বাসায় থাকার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। বরং সরকার তাঁকে মুক্তি দিয়ে কতগুলো রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে পেরেছে। আজ বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সেখানে মানবিক আবেদন রাখতে পারেন। ওই দিনই খালেদা জিয়ার মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা রাজনৈতিকভাবে অর্থবহ।
মন্ত্রী ও নেতাদের কথায় যেসব অর্জনের কথা এসেছে, সেগুলো মোটাদাগে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, খালেদা জিয়াকে আন্দোলন করে বিএনপি মুক্ত করতে পারেনি। সরকারের দয়ায় খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন। এখানে বিএনপির কোনো অবদান বা অর্জন নেই। ফলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার কোনো কৃতিত্ব বিএনপি নিতে পারবে না। এ ছাড়া এই মুক্তির পরও আইনিভাবে খালেদা জিয়াও দুর্নীতির দায় থেকে মুক্ত নন। বরং সরকারের দয়ায় খালেদা জিয়া মানবিক কারণে মুক্তি পেয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি না থাকলে খালেদা জিয়া জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় বিএনপির নেতারা পুরো ঢাকা অচল করে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে সরকার সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করেছে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতা–কর্মীদের নামিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি উদ্যাপন করতে পারবে না। দেশ লকডাউন করার জন্য সরকারের ওপর চাপটা সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই বেশি এসেছে। এ পরিস্থিতিতে অল্প কিছু মানুষের জমায়েত করলেও মানুষ বিএনপির সমালোচনা করবে।
তৃতীয়ত, খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বের হয়ে রাজনীতি করুন, তা চায়নি সরকার। এ জন্য প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে রাজি ছিল সরকার। প্যারোলে মুক্ত হলে সরকারের কঠিন শর্ত মেনেই মুক্তি পেতে হতো। এখনকার মুক্তির শর্ত কিছুটা শিথিল। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়া চাইলে সেভাবে রাজনীতি করতে পারবেন না। কারণ, এখন বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ই অনেকটা ফাঁকা। এ সময় নেতা-কর্মীরা চাইলেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে যখন-তখন সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাবেন না। আর মুক্তির শর্তে খালেদা জিয়া বিদেশ যেতে পারবেন না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে খালেদা জিয়া চাইলেও এখন বিদেশ যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হয়, এর নিশ্চয়তা তো নেই।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে খালেদা জিয়াকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। সারা বিশ্বে একটা মানবিক বিপর্যয় চলছে। এ সময় শেখ হাসিনা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। এরপর প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপির নির্বাচিত সাতজন সাংসদ প্রথমে শপথ নিতে না চাইলেও পরে শপথ নেন। বিএনপির সাংসদেরা শপথ নিয়ে সংসদের কার্যক্রমে অংশ নিলে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হতে পারে, এমন একটা সমঝোতার কথা শোনা যায়। এতে বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যস্থতাও আলোচনায় আছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক অবনতি হয়। তাঁর অঙ্গহানির আশঙ্কা করেন বিএনপির নেতা ও পরিবারের সদস্যরা। ফলে অসুস্থ খালেদা জিয়াকে নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এই পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে দল ও পরিবারের সদস্যরা ব্যাপক তৎপর হন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে ফোনালাপ হয়। কিন্তু খালেদার মুক্তি কোন প্রক্রিয়ায় মিলবে, এটা নিয়ে ঐকমত্যে পোঁছাতে সক্ষম হয়নি কোনো পক্ষই।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান খালেদা জিয়া। এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায়ও তাঁর সাজা হয়। সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার দণ্ড ১৭ বছর। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটিতে তাঁর সাজা হয়েছে। বাকিগুলো বিচারাধীন।
কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপি খালেদা জিয়ার জামিনের জন্য চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু জামিন হয়নি। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন নাকচ করে দেন। গত ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে পুনরায় হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘নতুন কোনো কারণ না পাওয়ায়’ তাঁর আবেদন খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। এরপরই বিএনপি অনেকটা আশা ছেড়ে দেয়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আকস্মিক সেই সুযোগ করে দেয়।
সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে তিনটি বিকল্প সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, তাঁকে জামিন দেওয়া, প্যারোলে মুক্তি ও সরকারের পক্ষ থেকে সাজা স্থগিত করা। এর মধ্যে বিএনপি বরাবরই খালেদা জিয়ার জামিনের পক্ষে অবস্থান নেয়। আর সরকার প্রকাশ্যে না বললেও পর্দার অন্তরালে প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে আগ্রহ দেখায়। ফলে কোনো পক্ষই সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি। এরপর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা ফৌজদারি আইনের ৪০১ (১)-এর ধারার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। এ ধারায় সরকার চাইলে একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামির সাজা সাময়িকভাবে স্থগিত করতে পারে। গতকাল দুটি শর্তে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এই ধারায় খালেদা জিয়ার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করার ঘোষণা দেন। শর্তগুলো হচ্ছে, ১. খালেদা জিয়া ঢাকার নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন। চাইলে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যেতে পারবেন। ২. তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।
৪ মার্চ খালেদা জিয়াকে লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার জন্য নির্বাহী আদেশে মুক্তি চেয়ে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের আবেদন করেন পরিবারের সদস্যরা। এরপর খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, তাঁর বোন সেলিমা ইসলাম এবং তাঁর বোনের স্বামী রফিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুক্তির আবেদন জানিয়েছেন বলে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সাজা স্থগিত হয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মানবিক ও সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর পক্ষেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। তাঁর আশা, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও বিএনপি ভবিষ্যতে ইতিবাচক রাজনীতি করবে।