ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ঝিলপাড় বস্তি

শুক্রবার রাতের আগুনে পুড়ে পুরো বস্তিই এখন ধ্বংসস্তূপ। পাশে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখা ছাড়া যেন আর কিছু করার নেই বাসিন্দাদের। গতকাল মিরপুরের রূপনগরে ঝিলপাড় বস্তিতে। ছবি: আশরাফুল আলম
শুক্রবার রাতের আগুনে পুড়ে পুরো বস্তিই এখন ধ্বংসস্তূপ। পাশে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখা ছাড়া যেন আর কিছু করার নেই বাসিন্দাদের। গতকাল মিরপুরের রূপনগরে ঝিলপাড় বস্তিতে।  ছবি: আশরাফুল আলম

রূপনগরে পুড়ে যাওয়া ঝিলপাড় বস্তিটি অবৈধভাবে গড়ে উঠেছিল জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের জমিতে। বস্তির প্রতিটি ঘরেই ছিল বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অবৈধ সংযোগ। চলত মাদক ব্যবসাও। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের অন্তত ৫০ নেতা-কর্মী এসব নিয়ন্ত্রণ করতেন।

বস্তিবাসী জানিয়েছেন, বস্তি নিয়ন্ত্রণকারীরা রূপনগর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজি রজ্জব হোসেনের লোক। এই অবৈধ ব্যবসা থেকে তাঁদের মাসে আয় ছিল ৩০ লাখ টাকার বেশি।

তবে রজ্জব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা আমার লোক নয়, তারা নব্য আওয়ামী লীগার।’

গত শুক্রবার রাতে ঝিলপাড়ের এই বস্তিতে আগুন লেগে অন্তত আট হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে তিনজন আহত হয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করতে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস।

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, রূপনগর থানার পেছনের সড়ক থেকে সাত-আট ফুট নিচু ভূমিতে ঝিলপাড় বস্তির অবস্থান। এর চারদিকে আবাসিক বহুতল ভবন। ঝিলের ওপর কাঠের পাটাতনে বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে সাত-আট হাজার ঘর তোলা হয়। এর মধ্যে টিনের দোতলা ঘরও ছিল। আগুনে সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গৃহকর্মী, পোশাকশ্রমিক, রিকশাচালকসহ দিনমজুরশ্রেণির লোকজনই এর বাসিন্দা।

ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা বলেন, বস্তির ভেতরে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে গ্যাসের সংযোগ ছিল। সেই সংযোগ দিয়ে প্রতিটি ঘরেই রান্না হতো। শুক্রবার সন্ধ্যায় বস্তির দক্ষিণ দিকের একটি ঘর থেকে প্রথমে আগুন লাগে। আগুনে গ্যাসের পাইপ ফেটে যায়। এতে আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাসের কারণে আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায়। অনেক দূর থেকে সে আগুন দেখা যাচ্ছিল। বেশির ভাগ বাসিন্দা ঈদের কারণে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন।

>রূপনগরে বস্তিতে আগুন
সরকারি জমিতে বস্তি
প্লাস্টিকের পাইপে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ
এ থেকেই আগুন ছড়ায়


জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা ১৯৭৩ সালে রূপনগর থানার পেছনের ওই ঝিলের ২০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। তখন স্থানীয়রা এই নিচু জমিতে ময়লা ফেলতে শুরু করে। এতে ঝিলটি ভরে যায়। এরপর কাঠের পাটাতন দিয়ে বস্তিঘর গড়ে উঠতে শুরু করে। ২০০০ সালে পুরো জমি বস্তিতে ভরে যায়।

সরেজমিনে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরুর দিকে যাঁরা বস্তিতে ছিলেন, তাঁরা প্রথমে নিজেরা থাকার পাশাপাশি ঘর তুলে ভাড়া দিতে থাকেন। ওই সময় বিএনপি ও যুবদলের কিছু নেতা-কর্মী বস্তির নিয়ন্ত্রণ নেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ঘর তুলে ভাড়া দিতে শুরু করেন। তাঁরা বস্তিতে অবৈধ পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে প্রতিটি ঘর থেকে দুই হাজার টাকা এবং ভাড়া বাবদ প্রতিটি ঘর থেকে দুই হাজার টাকা করে আদায় করেন। এ কাজে যুক্ত ছিলেন দুলাল হোসেন, হানিফ, নুরুল ইসলাম, আনসার মিয়া, মোহাম্মদ দিলু, তৈয়ব আলী, তুষার, হেলাল উদ্দিন, খলিলুর রহমানসহ অন্তত ৫০ জন। তাঁরা সবাই রূপনগর থানা, স্থানীয় ৬ নম্বর ও ৯২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজ্জব হোসেনের লোক বলে এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

তবে ৯২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন অর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আওয়ামী লীগের কেউ নন। আগে তাঁরা যুবদল করতেন, এখন যুবলীগ করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বস্তিবাসী বলেন, এই বস্তিতে মাদক কেনাবেচা হতো। বস্তির নিয়ন্ত্রণকারীরা মাদক কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘বস্তিকেন্দ্রিক মাদক ব্যবসা তো হয়।’ তবে মাদক দমনে পুলিশ তৎপর আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর আমি উপস্থিত থেকে পুলিশকে দিয়ে ঝিলপাড় বস্তিতে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়েছি। এরপর সেখানে মাদক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। বস্তিতে বৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। তবে গ্যাস সংযোগ বৈধ না অবৈধ তা আমি জানি না।’

ঝিলপাড় বস্তিতে থাকতেন হাজেরা বেগম। তিনি বলেন, ৩৫ বছর আগে তিনি ঝিলপাড়ে ঘর তুলে থাকতে শুরু করেন। পরে তিনি আরও তিনটি ঘর তুলে ভাড়া দেন। প্রথম দিকে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ ছিল না। পরে দুলালসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের অনেক নেতা বস্তিতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দেন। প্রতি মাসে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জন্য তিনি দুলালকে দুই হাজার করে টাকা দিতেন।

বস্তির আরেক বাসিন্দা আবদুল মালেক বলেন, বস্তিতে তাঁর তিনটি ঘর আছে। একটিতে তিনি থাকেন, অন্য দুটি দুই হাজার টাকা করে ভাড়া দেন। তাঁর দাবি, তিনি পানির বৈধ সংযোগ নিয়েছেন। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের জন্য তিনি দুলালকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে দিতেন।

অন্য কয়েকজন বস্তিবাসী বলেন, বস্তিতে হানিফ, নুরুল ইসলাম, আনসার মিয়া, দিলু, তৈয়ব আলী, খলিলুর রহমানসহ স্থানীয় অনেক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর ঘর আছে। প্রতিটি ঘর থেকে তাঁরা নিজেরা এসে প্রতি মাসে টাকা নিয়ে যান। আবার অনেকের লোক আছে। তাঁরা সময়মতো এসে টাকা তুলে নিয়ে যান।