‘কৌতূহল’ মেটাতে পারেনি এবি পার্টি

ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

নতুন দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময় আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি) রাজনৈতিক মহলে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। ধারণা করা হয়েছিল, জামায়াতে ইসলামীর অনেকে এ দলে চলে আসবেন। কিন্তু দুই বছরেও জামায়াতকে সেভাবে টানতে পারেনি এবং রাজনীতির মাঠেও সাড়া ফেলতে পারেনি। তবে নতুন এই দলের উদ্যোক্তারা আশা ছাড়ছেন না। তাঁরা বলছেন, অল্প সময়ে দলটির তৎপরতা নানা মহলের দৃষ্টিতে পড়েছে।

এবি পার্টির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, তাঁরা ধীরে-সুস্থে এগোচ্ছেন। এই মুহূর্তে তাঁদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন পাওয়া। এ লক্ষ্যে সারা দেশে দলের কমিটি গঠন চলছে। এখন পর্যন্ত ৪৫টি জেলা ও প্রায় ১০০ উপজেলায় এবি পার্টির কমিটি করা হয়েছে। প্রবাসীদের নিয়েও সাংগঠনিক কাজ চলছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ ১২টি দেশে প্রবাসীদের নিয়ে কমিটি
হয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শুরু করলে এবি পার্টিও আবেদন করবে।

দলীয় সূত্র জানায়, সাংগঠন গোছানোর পাশাপাশি এবি পার্টি বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের কাজ করছে। ইতিমধ্যে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমানকে (মঞ্জু) বিএনপির অঙ্গসংগঠন কৃষক দলের ইফতার অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের ইফতার অনুষ্ঠানেও দলটিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

দুই বছর আগে ২০২০ সালের ২ মে এবি পার্টির আত্মপ্রকাশ হয়। এর উদ্যোক্তা জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের একদল সংস্কারপন্থী নেতা-কর্মী, যাঁরা একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা না চাওয়া এবং দলটির বাস্তবভিত্তিক সংস্কারের পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ কারণে রাজনৈতিক মহলে অনেকের ধারণা ছিল, জামায়াত থেকে অনেকে এবি পার্টিতে যোগ দেবেন। ওই সময় জামায়াতের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সাংসদের নামও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু গত দুই বছরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক ও কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য সাবেক সচিব এ এফ এম সোলায়মান ছাড়া উল্লেখযোগ্য কেউ যোগ দেননি। যদিও ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার, রংপুর, গাজীপুর, জামালপুর, শেরপুরসহ বিভিন্ন জেলায় জামায়াত এবং ছাত্রশিবিরের মধ্যম ও মাঠপর্যায়ের কিছু নেতাকে পাশে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন এবি পার্টির নেতারা।

এবি পার্টির কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারার কথা স্বীকার করেছেন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এর দুটি কারণ। প্রথমত, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা। দ্বিতীয়ত, এবি পার্টির নিবন্ধন না থাকা। তাঁর মতে, গত ১৪ বছরে যে রাজনৈতিক নিপীড়ন হয়েছে, এর ফলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে একধরনের ভীতি জেঁকে বসেছে। নতুন দলে যোগ দিয়ে আবার বিপদে পড়তে হয় কি না—এমন শঙ্কাও আছে কারও কারও মতে। এবি পার্টি নিবন্ধন পেলে শঙ্কা কেটে যাবে।

‘বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি নতুন রাজনীতি, মধ্য ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। যে দলের কাজের মধ্যে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন হবে। সে হিসেবে মনে করি, এবি পার্টি সঠিক পথে যাত্রা শুরু করেছে।’
আবদুর রাজ্জাক, লন্ডনে অবস্থানরত এবি পার্টির প্রধান উপদেষ্টা

যদিও রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রার শুরুতেই গত বছরের অক্টোবরে ভাঙনের মুখে পড়ে এবি পার্টি। দলের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আকস্মিক দল ছেড়ে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিতে যোগ দেন। এর পেছনে জামায়াতের পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন এবি পার্টির নেতারা।

জামায়াত থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করার পর এখন এবি পার্টির নেতারাও বলছেন, জামায়াত থেকে আশানুরূপ নেতা-কর্মী তাঁরা পাননি। এ বিষয়ে তাঁদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, এবি পার্টির আত্মপ্রকাশের পর জামায়াত ভাঙন ঠেকাতে দলে সংস্কারপন্থী হিসেবে আলোচিত বেশ কয়েকজন নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসায়। একই সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলায় দলীয়ভাবে কঠোর সতর্ক পদক্ষেপ নেয় জামায়াত। অনেকের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেয়। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান নেতা-কর্মীদের একাধিক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে এবি পার্টির নেতাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ না রাখার জন্য সতর্ক করেন। এমনকি আবদুর রাজ্জাককে এবি পার্টির গঠনপ্রক্রিয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্য জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতা লন্ডনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেন। যদিও এবি পার্টির বিষয়ে জামায়াতের নেতারা প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না।

জানা গেছে, গত বছর আবদুর রাজ্জাক এবি পার্টির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন স্থানে দলকে সংগঠিত করা ও তহবিল সংগ্রহে কাজ করছেন।

‘আমরা এবি পার্টিকে একটি অরগানিক রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে। কোনো হাইব্রিড প্রক্রিয়া অনুসরণ বা সাময়িক চমক সৃষ্টি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এই মুহূর্তে এবি পার্টির অগ্রাধিকার হচ্ছে দলের নিবন্ধন অর্জন।’
মজিবুর রহমান, এবি পার্টির সদস্যসচিব

এ বিষয়ে লন্ডনে অবস্থানরত এবি পার্টির প্রধান উপদেষ্টা আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি নতুন রাজনীতি, মধ্য ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। যে দলের কাজের মধ্যে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলন হবে। সে হিসেবে মনে করি, এবি পার্টি সঠিক পথে যাত্রা শুরু করেছে।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শুরুতে এবি পার্টিতে সাবেক জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকদের প্রাধান্য থাকলেও সম্প্রতি ভিন্নধারা বা দল থেকেও যোগ দিতে দেখা গেছে। এর মধ্যে অতীতে জাতীয় পার্টি, ছাত্রদল, যুবদল, জাসদ ও বাম রাজনীতি করেছেন, এমন রাজনৈতিক কর্মীও আছেন। গত মাসে এবি পার্টির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ কমিটির আহ্বায়ক করা হয় বি এম নাজমুল হককে। যুব পার্টির সমন্বয়ক করা হয় এ বি এম খালিদ হাসানকে। এই দুজনই একসময় জাতীয় পার্টি করতেন। এ ছাড়া অনেকে নতুন করেও এবি পার্টিতে যুক্ত হয়েছেন।

এ বিষয়ে এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এবি পার্টিকে একটি অরগানিক রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে। কোনো হাইব্রিড প্রক্রিয়া অনুসরণ বা সাময়িক চমক সৃষ্টি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এই মুহূর্তে এবি পার্টির অগ্রাধিকার হচ্ছে দলের নিবন্ধন অর্জন।’