কোটা আন্দোলনের নেতা থেকে ডাকসুর ভিপি

গত বছরের ৩০ জুন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মারধরের একপর্যায়ে গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক জাবেদ আহমদের পা জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করেন নুরুল হক। ফাইল ছবি
গত বছরের ৩০ জুন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মারধরের একপর্যায়ে গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক জাবেদ আহমদের পা জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করেন নুরুল হক।  ফাইল ছবি
>

• নুরুলের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপার প্রত্যন্ত গ্রামে
• ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাবির ইংরেজি বিভাগে ভর্তি
• প্রথম বর্ষ থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন নুরুল
• কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রথম সারির নেতা নুরুল
• মামলা-হামলা এখনো পিছু ছাড়েনি নুরুল হকের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সদ্য নির্বাচিত সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হকের জন্ম পটুয়াখালীর গলাচিপার এক প্রত্যন্ত চরে। শৈশব কেটেছে সেখানেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুক্ত হন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। গত বছর কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে প্রথম সারির নেতা ছিলেন নুরুল। ছাত্রলীগের হাতে বেধড়ক পিটুনির পরও আন্দোলনে অনড় থাকায় ছাত্রদের নজর কাড়েন তিনি।

তবে মামলা-হামলা এখনো পিছু ছাড়েনি নুরুল হকের। ডাকসুর নির্বাচনের দিনও একটি মামলার আসামি হয়েছেন। এদিন রোকেয়া হলে ভোটের অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে মারধরের শিকার হন। তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগে মামলাও হয়েছে। আর নির্বাচিত হওয়ার পরদিন গতকাল মঙ্গলবার ছাত্রলীগের ধাওয়া খেয়েছেন।

নুরুলের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপার এক প্রত্যন্ত চর বিশ্বাস গ্রামে। তাঁর বাবা ইদ্রিস হাওলাদার চর বিশ্বাস বাজারে একটি খাবারের দোকান চালান। মা নিলুফা বেগম ১৯৯৩ সালে মারা যান। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর বড় ভাই ঢাকায় ব্যবসা করেন, ছোট ভাইও সেই ব্যবসায় যুক্ত। বিয়ে হয়েছে দুই বোনের। নুরুলও বিবাহিত। স্ত্রী মরিয়ম আক্তার ঢাকার কবি নজরুল কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী। পাশাপাশি তিনি উত্তর চর বিশ্বাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।

গতকাল কথা হয় নুরুলের বাবা মো. ইদ্রিস হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন নুরুল। পরিবারের টানাপোড়েনের কারণে নুরুলকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে এক চাচাতো বোনের কাছে। গাজীপুর থেকে নুরুল এসএসসি এবং ঢাকার উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। মুহসীন হল ছাত্রলীগে যোগ দেওয়ার পর মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক উপসম্পাদকের পদ পান।

মুহসীন হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাসুদ রানা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নুরুল প্রথম বর্ষের শুরু থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। স্পষ্টভাষী হওয়ায় তিনি জ্যেষ্ঠদের নজর কাড়েন। সবকিছু যাচাই–বাছাই করেই তাঁকে পদ দেওয়া হয়েছিল।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের একাধিক হামলার শিকার হন নুরুল হক। গত বছরের ৩০ জুন ছাত্রলীগের হাতেই বেদম মার খেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন এক শিক্ষকের পা। সেই চরম পরিস্থিতিতে অসহায় নুরুলের ছবি সারা দেশে আলোচিত হয়। গত বছরের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি হয়। এরপর সেই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহযোগীদের নিয়েই ডাকসুতে লড়তে আসেন নুরুলেরা।

 চর বিশ্বাস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পর এলাকায় নুরুলের খুব একটা যাতায়াত ছিল না। তবে তিনি ভিপি হওয়ায় তাঁর জন্য গ্রামবাসীও সম্মানিত বোধ করছে।

মামলার প্রতিবাদ ও রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ

গত সোমবার ডাকসু নির্বাচন চলাকালে রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষকে লাঞ্ছনা ও হলের ভেতর নির্বাচন ব্যাহত করার অভিযোগে মারজুকা রায়না নামে হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী নুরুলসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত আরও ৩০-৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার অন্য ছয় আসামিরা হলেন লিটন নন্দী, খন্দকার আনিসুর রহমান, উম্মে হাবীবা বেনজির, শেখ মৌসুমী, শ্রবনা শফিক ও আকতার হোসেন। তাঁরা সবাই ডাকসু নির্বাচনের বিভিন্ন পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। মামলায় দণ্ডবিধির যেসব ধারার উল্লেখ রয়েছে, তাতে কোনো নারীর শালীনতা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে হামলা, নির্বাচনে অযৌক্তিক প্রভাব প্রয়োগ, নির্বাচন সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতিদানের কথা উল্লেখ আছে।

মামলার বিষয়ে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘আসামিদের পুলিশ খুঁজছে বা পেলেই গ্রেপ্তার করবে এমন কিছু না। এখন সেই মামলার তদন্ত চলছে।’

দুপুরে টিএসসিতে নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হককে বরণ করে নেয় ছাত্রলীগ। সন্ধ্যায় ফলাফল বাতিল করে ডাকসুর পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নুরুল হক। ছবি: ফোকাস বাংলা

রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদা গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, নুরুল ও অন্য প্রার্থীরা হঠাৎ করে রোকেয়া হলে ঢুকে অশ্রাব্য ভাষায় তাঁকে ও তাঁর অন্য নারী সহকর্মীদের গালিগালাজ করেন। হলের ২৫ জন আবাসিক শিক্ষক ওই লাঞ্ছনার প্রতিকার চেয়ে তাঁর কাছে চিঠি দিয়েছেন। প্রতিকার না পেলে তাঁরা একযোগে পদত্যাগ করবেন বলেও জানিয়েছেন। তিনি নুরুলদের বিরুদ্ধে ব্যালট ছিনতাইয়েরও অভিযোগ আনেন।

যদিও এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ব্যালট ছিনতাইয়ের কোনো অভিযোগ উল্লেখ করা হয়নি। মামলার বাদী মারজুকা রায়না প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা (নুরুলসহ অন্যরা) হলের প্রাধ্যক্ষ ও অন্য শিক্ষকদের উদ্দেশ করে প্রচুর বাজে কথা বলছিলেন। বিষয়টি তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত দিয়েছে বলে তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি করেছেন।

তবে নুরুল হক এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা একটা মিথ্যা মামলা। এটা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক আছেন, যাঁরা দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির কারণে জনপ্রিয় শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন।’

নুরুল হকসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদ ও রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে গতকাল রাতে বিক্ষোভ করেছেন হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তাঁদের অভিযোগ, ‘ছাত্রলীগের ইন্ধনেই’ ওই মামলা করা হয়েছে।

বিক্ষোভের বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী ও রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদাকে ফোন করা হলেও তাঁরা ধরেননি৷