আর মাত্র দুই দিন পর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ভোট। শেষ মুহূর্তের কৌশল নির্ধারণ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী এবং নেতা-কর্মীরা। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। আর ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত পোলিং এজেন্ট পৌঁছানো ও ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত এজেন্ট রাখার চ্যালেঞ্জ সামলাচ্ছে বিএনপি।
চট্টগ্রামে নৌকার জয় নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। তাই বিদ্রোহী কাউন্সিলরদের মাঠে রেখেই নির্বাচন শেষ করতে চায় দলটি। কেন্দ্রের চাপে স্থানীয় সব নেতাও সক্রিয় হয়েছেন। আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন চসিক প্রশাসক। চট্টগ্রামে থেকে নির্বাচন পরিচালনা করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের কয়েকজন।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৭৩৫টি কেন্দ্রের জন্য নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে কেন্দ্র কমিটি করা হয়েছে আগেই। কেন্দ্রের আয়তন, ভোটারসংখ্যা বিবেচনায় এসব কমিটিতে ৪১ থেকে ১০১ সদস্য পর্যন্ত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি কেন্দ্রের সামনে দায়িত্ব পালন করবে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্র কমিটি। এর বাইরে প্রতি ওয়ার্ডে স্ট্রাইকিং বাহিনী হিসেবে থাকবে বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা নেতা-কর্মীরা।
প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য অন্তত ১০ জনের একটি সমন্বয় কমিটি করেছে মহানগর যুবলীগ। এদের পরিচালনার জন্য মহানগর ও ওয়ার্ড নেতাদের একটি কমিটি আছে প্রতি ওয়ার্ডে। ৭ থেকে ১৫ সদস্যের কেন্দ্র কমিটি করেছে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ। ওয়ার্ড সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এসব কমিটি পরিচালনা করবেন। একই সঙ্গে সব কেন্দ্রের সামনেই থাকবেন ছাত্রলীগের কর্মীরা। ছাত্রলীগের কর্মীদের সমন্বয় করতে প্রতিটি কেন্দ্রে ৫ থেকে ৭ জনের একটি সমন্বয় কমিটি করা হয়েছে। তিন সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, নির্বাচন পরিচালনায় গঠিত কেন্দ্র কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে ভোটারদের বিভিন্ন সহযোগিতায় এসব কমিটি কাজ করবে।
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, নগরের বাইরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকে স্থানীয় সাংসদদের পাঠানো নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে থাকবেন। জরুরি প্রয়োজনে তাঁরা রাস্তায় নামবেন। এর আগে ২০১৫ সালের নির্বাচনের সময় ফেনী, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আস্থাভাজন কর্মী এনেছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী নাছির উদ্দীন। এবার নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীও আস্থাভাজনদের দায়িত্ব দিচ্ছেন বিভিন্ন ওয়ার্ডে। তাঁকে পেছন থেকে সহায়তা করছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
এদিকে গতকাল রোববার থেকে নৌকা-সমর্থিত পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। ৭৩৫টি কেন্দ্রের ৪ হাজার ৬৮৬টি ভোটকক্ষের এজেন্টদের এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আজ সোমবার শেষ হবে।
বিএনপির অভিযোগ, কেন্দ্রের সামনে শত শত নেতা-কর্মী উপস্থিত রেখে আতঙ্ক তৈরি করে রাখবে আওয়ামী লীগ। এর আগের বিভিন্ন সিটি নির্বাচনেও এমন দেখা গেছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ভোটারদের সহায়তায় দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে কেন্দ্র কমিটি করা হয়, তাঁরা স্থানীয় ভোটার। বাইরে থেকে কাউকে কেন্দ্রে রাখা হচ্ছে না। বিএনপিও চাইলে তাদের নেতা-কর্মীদের দিয়ে এটি করতে পারে। বিএনপির মামলা, আটকের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলে যদি সব সন্ত্রাসী রাখে, আটক তো হবেই।
নৌকার পক্ষে ঐক্যের মহড়া
চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের বিবদমান অংশকে ঐক্যবদ্ধ করতে সবাইকে চাপে রাখছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। গত শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এক মঞ্চে আসেন চট্টগ্রামের আলোচিত নেতারা। নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক মেয়র নাছির উদ্দীন ও আবদুচ ছালাম ছিলেন মঞ্চে। মহানগরের সভাপতি, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও ছিলেন মঞ্চে। আর মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছিলেন মহিবুল হাসান চৌধুরী। এর আগে বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে নিজের সমর্থনের কথা জানান মনোনয়নের আরেক দাবিদার খোরশেদ আলম সুজন। এরপর শনিবার প্রেসক্লাবে ইশতেহার ঘোষণার মঞ্চেও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের শীর্ষ নেতারা।
তবে বিবদমান মূল দুই অংশের নেতারা বলছেন, নেতারা সবাই মাঠে থাকলেও অনুসারীরা সবাই মাঠে নেই। মহিবুল হাসান অংশের অনুসারী এক নেতা বলেন, নাছির উদ্দীন নিজে মাঠে থাকলেও তাঁর অনুগত অধিকাংশ নেতা-কর্মী সক্রিয় নেই। আর নাছির উদ্দীন অংশের এক নেতা উল্টো অভিযোগ করে বলেন, এটা আস্থার সংকট। নাছির উদ্দীন নৌকার জয়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন। তাই তাঁরাই বরং বেশি কাজ করছেন মাঠে।
এখানে কোনো আলাদা ধারা নেই। মারামারি-কাটাকাটি হয়, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যাঁরা দল করেন, তাঁদের সবার নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্ত মানতে হবে।নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী
এ বিষয়ে নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এখানে কোনো আলাদা ধারা নেই। মারামারি-কাটাকাটি হয়, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যাঁরা দল করেন, তাঁদের সবার নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্ত মানতে হবে। প্রচারে নগরের সবাই একযোগে কাজ করছেন। সবার সমর্থন পেয়ে তিনি সন্তুষ্ট।
বাসার বাইরে ধানের শীষের এজেন্টরা
তথ্য সংগ্রহের কাজে শনিবার মধ্যরাতের দিকে নগর যুবদলের এক নেতার সঙ্গে আধা ঘণ্টার মতো আলাপ হয়। ওই সময় বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে একের পর এক ফোন আসতে থাকে ওই নেতার কাছে। সবার একই অভিযোগ, বাসায় পুলিশ তল্লাশি করছে। পরিবারের লোকদের হয়রানি করছে। যুবদলের ওই নেতা তাঁর সঙ্গে থাকা একটি ট্রাভেল ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, রাতে কোথায় থাকবেন, ঠিক নেই। আটকও হয়ে যেতে পারেন যেকোনো সময়। তাই জামাকাপড় সঙ্গে নিয়ে প্রস্তুত থাকেন।
বিএনপির নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির নেতারা বলছেন, প্রতিনিয়ত মামলা হচ্ছে। বাসায় বাসায় গিয়ে তল্লাশির নামে হয়রানি হচ্ছে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে এজেন্ট ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। নির্বাচন থেকে বের করে দিতেই এসব ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে।
তবে আওয়ামী লীগের অভিযোগ, সব কেন্দ্রে এজেন্ট দেওয়ার মতো কর্মী নেই বিএনপির। তাই নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে তারা সারাক্ষণ সরকারি দলের দিকে অভিযোগ তোলে।
বিএনপির প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আবুল হাশেম বক্কর প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতায় থাকলে এমন কল্পকাহিনি বলা সহজ। ৪ হাজার ৮৮৬ জন এজেন্টের তালিকা তৈরি করা আছে। এটি প্রকাশের আগে থেকেই ধরপাকড় শুরু হয়ে গেছে। বিকল্প কর্মীও প্রস্তুত রাখা আছে। আওয়ামী লীগের চেয়ে মাঠে বেশি বাড়াবাড়ি করছে পুলিশ প্রশাসন।
আটক, তল্লাশি ও বর্জনের গুঞ্জন
চট্টগ্রাম নগর পুলিশ সূত্র বলছে, নির্বাচনের প্রচারে হামলা, ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে গত কয়েক দিনে পাঁচটি মামলা হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। শুক্রবার পর্যন্ত ১৪ জনকে আটক করে পুলিশ। গত দুই দিনে আরও ১০ জনকে আটক করা হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ভোট থেকে বিএনপির সরে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। শনিবার রাতে ঢাকায় গিয়ে গতকাল দুপুরের আগে চট্টগ্রামে ফিরে এসেছেন বিএনপির প্রার্থী। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতেই তিনি ঢাকায় গেছেন বলে জানা গেছে। বিএনপির নেতারা বলছেন, ভোট থেকে সরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বরং নেতা-কর্মীদের এলাকা ছাড়া করে ভোট থেকে সরিয়ে দেওয়ার তৎপরতা চলছে। গতকাল বিএনপির প্রার্থীকে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে নগর পুলিশ।
বিএনপির প্রার্থী শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গায়েবি মামলায় আসামি করে আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে। তবু নির্বাচন পর্যন্ত এজেন্ট ধরে রাখার চেষ্টা করছি।’ তিনি বলেন, আগামী দুই দিনেও সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার সুযোগ আছে।
ইসি ও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ
বিএনপির নেতারা বলছেন, মানুষের আগ্রহ দেখে সরকার ভয় পাচ্ছে। তাই বিএনপির নিরীহ নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়নে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পুলিশ। সরকারি দলের লোকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না তারা, বরং গণসংযোগ থেকেও বিএনপির কর্মীদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, ঢালাওভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। নির্বাচনসংক্রান্ত কয়েকটি মামলা হয়েছে। গুরুত্ব বুঝে, সংশ্লিষ্টতা আছে, যাচাই করে এমন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।
অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্থানীয় নির্বাচন কমিশনের প্রতিও ক্ষোভ আছে প্রার্থীদের। সব প্রার্থী মিলে এখন পর্যন্ত ৬৬টি অভিযোগ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে। বিএনপির অভিযোগ, বারবার অভিযোগ দিলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গতকাল চট্টগ্রামে এসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)।
বৈঠক শেষে নেতা-কর্মী ও পোলিং এজেন্টদের হয়রানি সম্পর্কে বিএনপির প্রার্থীর অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসি কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের বলেন, এ অভিযোগ সঠিক নয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিষ্প্রয়োজনে হয়রানি করছে এমন কোনো অভিযোগ নেই। যাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আছে এবং আদালতের ওয়ারেন্ট আছে; পুলিশ তো অবশ্যই গ্রেপ্তারের চেষ্টা করতে পারে।
তবে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সভাপতি মুহাম্মদ সিকান্দার খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিসের লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড? লেবেলও নেই, প্লেয়ার তো অনেকেই মাঠছাড়া। সিইসির আসা-যাওয়াটা কেবল চোখে দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের মাঠের কোনো পরিবর্তন নেই। সিইসি আসার আগেও কোনো অভিযোগের হিল্লা হয়নি। এখনো হচ্ছে না।’