কুমিল্লার নির্বাচন: শেষ ৪৫ মিনিটে কী ঘটেছিল?

কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী
ফাইল ছবি

কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের শেষ মুহূর্তের একটি ফোনকলে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে—পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হকের (সাক্কু) বরাত দিয়ে এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ নিয়ে নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই কথিত বক্তব্যের সূত্র ধরে একটি পক্ষ বলছে, শেষ চারটি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণায় দেরি করার পেছনে বিশেষ কারণ ছিল। আবার কয়েকটি গণমাধ্যমে একটি ফোনকলে ফলাফল বদলে যাওয়ার খবরও প্রকাশিত হয়।

ফলাফল ঘোষণার একপর্যায়ে সেখানে আসেন মনিরুল হক

গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে তিনটা থেকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার স্থান জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক ছিলেন। রাত সাড়ে নয়টার পর ফলাফল ঘোষণা শেষ হলে শিল্পকলা একাডেমি থেকে রাত ১০টার দিকে এই প্রতিবেদক সেখান থেকে বের হন।

প্রথম আলোর এই‌ প্রতিবেদক মনিরুল হককে তেমন বক্তব্য দিতে শোনেননি।

পরে ‘কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা’ শিরোনামে ভোটের ফল বদলে যাওয়াসংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রথম আলোর হাতে আসে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মনিরুল হক এ ধরনের কোনো বক্তব্য দেননি। ফলাফল ঘোষণার সময় তাঁর পাশে বসে থাকা এক ব্যক্তি এ অভিযোগ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যিনি এ অভিযোগ করেছেন, তিনি মনিরুল হকের ছোট ভাই কাইমুল হক।

গতকাল দিনভর ভোট গ্রহণ শেষে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে ফলাফল ঘোষণা শুরু করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ তিনি মোট ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ৯৯টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করেন।

এর কিছুক্ষণ পর রাত পৌনে নয়টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক তাঁর অনুসারী নেতা–কর্মীদের নিয়ে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার স্থানে (শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তন) আসেন। এ সময় হলরুমে সবাই মনিরুল হকের প্রতীক টেবিলঘড়ি মার্কার স্লোগান দিতে থাকেন। হলরুমে হট্টগোল তৈরি হওয়ায় মনিরুল হকের অনুসারীদের একটা অংশকে পুলিশের সদস্যরা মিলনায়তন থেকে বের করে দেন।

অবশ্য মনিরুল হক শিল্পকলা একাডেমিতে আসার আগেও টেবিলঘড়ি (মনিরুল হকের প্রতীক) মার্কার স্লোগান দিয়ে কয়েক শ নেতা–কর্মী মিলনায়তনে প্রবেশ করেন। সে সময় আরও তিনটি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করা হয়।

মনিরুল হকের উপস্থিতিতেই রিটার্নিং কর্মকর্তা এরপর আরও তিনটি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করেন। এরপর রাত নয়টার দিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হকের (রিফাত) অনুসারীরা নৌকার মিছিল নিয়ে মিলনায়তনে প্রবেশ করেন। ততক্ষণে সব কেন্দ্রের ফল আলাদা করে ঘোষণা হয়েছে এটা কেউ বুঝতে পারেননি। এর কারণ রিটার্নিং কর্মকর্তা কেন্দ্রের নম্বর উল্লেখ করে ফলাফল ঘোষণা করেছিলেন। কেন্দ্রের ক্রমিক ধরে ফলাফল ঘোষণা করেননি।

কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছেন নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক

এ সময় আরফানুলের সমর্থকেরা নৌকা মার্কার স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের সঙ্গে টেবিলঘড়ি প্রতীকের সমর্থকদের ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হলে সেখানে থাকা পুলিশের সদস্যরা সবাইকে হলরুম থেকে বের করে দেন। তখন মিলনায়তনের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে পড়ে।

এ ঘটনার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের ফলাফল বানচাল করতেই মিলনায়তনে নৌকার প্রার্থীরা এসেছেন। ফলাফল ঘোষণা না নিয়ে তিনি সে স্থান ত্যাগ করবেন না। পরে সেখানেই তিনি অবস্থান করেন।
এর খানিক পর সাড়ে নয়টার দিকে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হককে ৩৪৩ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

সরেজমিনে সেখানে অবস্থান করে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক দেখেছেন, রাত ৮টা ৪৫ মিনিট থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দুই মেয়রের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি স্লোগান ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ উত্তেজনা আশপাশের রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়ে।

ফলাফল ঘোষণার আগপর্যন্ত ফলাফল কেন্দ্রের সামনে নৌকার হাজারো সমর্থক রাস্তা দখল করে স্লোগান দিতে থাকেন।

এমন পরিস্থিতিতে সাড়ে নয়টার দিকে মোট ১০৫টি কেন্দ্রের ফলাফল একসঙ্গে ঘোষণা করা হয়।

এর আগে চারটি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণায় যখন দেরি হচ্ছিল, সে সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা মাইকে ঘোষণা করেন, চারটি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা বাকি আছে। এসব কেন্দ্রের ফলাফল তাঁর হাতে এসে পৌঁছায়নি। তিনি তখন কাউন্সিলর প্রার্থীদের ফলাফল ঘোষণার কথা বলেন।

তাঁর এ ঘোষণার পর মিলনায়তনে উপস্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হকের অনুসারীরা হইচই করেন, স্লোগান দেন। তাঁরা এ সময় মেয়র প্রার্থীর ফলাফল ঘোষণার দাবি জানান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে। এ সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা তাঁদের আশ্বাস দেন, মেয়র প্রার্থীর ফলই আগে ঘোষণা করা হবে।

পরে মেয়র প্রার্থীদের ফলাফল ঘোষণার পর সংরক্ষিত ও সাধারণ ওয়ার্ডের বিজয়ী কাউন্সিলর প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন তিনি।