লোহার ফটকে অস্ত্র হাতে বেশ কয়েকজন পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্য। ফটক পেরোতেই চোখে পড়ল ঝকঝকে তিন তলা ভবন। হয়তো মাস কয়েক আগে নতুন করে হলদে রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। এ ভবনেই ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আগুনের লেলিহান শিখা ছোবল মেরেছিল। তখন পুরো ভবনটির রং কালো হয়ে যায়। তিনতলা ভবনটি হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট পল্লী বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যালয়। সরকারি খাতা–কলমে যার নাম ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, শিবগঞ্জ জোনাল অফিস’।
ভবনটির পাশে রয়েছে পোড়া কাঠের বড় বড় গুঁড়ি। গুঁড়িগুলোর পাশে রাখা বিদ্যুতের পোড়া কেব্ল।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজা দেওয়ার পর কানসাট পল্লী বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার ঘটনা ঘটে। আগুন ধরানো হয়। দুদিন ধরে পুড়েছিল বিশাল এলাকাটি। ক্ষতি হয় ২০০ কোটি টাকার। এর ধকলে কানসাটসহ শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় টানা চার মাস বিদ্যুৎ ছিল না। ধান চাষের মৌসুমেও সেচের জন্য পানির পাম্প সচল ছিল না। তাই আবাদের জন্য পানি মেলেনি। যে কারণে উৎপাদন হয়নি ফসল।
কানসাট পল্লী বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে আবুল কালাম আজাদ নামে মধ্যবয়সী একজনের সঙ্গে কথা হয়। ব্যবসা করেন তিনি। দোকান রয়েছে তাঁর সোনামসজিদ স্থলবন্দর এলাকায়। এই এলাকায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হালচাল জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘হামরা ভোট দিব। সক্কাল বেলাই শীতের মধ্যে টুক টুক কইরা ভোট দিবার যাব।’
আরও অনেক কথা বললেন তিনি।
শেষ কথা। আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘হামরা ভোটের মঙ্গল পরিবেশ চাই। ভোটের দিন মঙ্গল পরিবেশ না থ্যাইকলে ২০১৩ সালের মতো অরাজকতা হইবে।’
৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রায় ২০ দিন ধরে কানসাট পল্লী বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসন এলাকার মধ্যে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক মো. মাইনউদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০১৩ সালের হামলার ঘটনার পর সরকারের স্পর্শকাতর স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এরপর থেকে পাঁচজন করে আনসার সদস্য সব সময় এখানকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন। এবারের সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ৫ ডিসেম্বর থেকে বাড়তি ১০ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। টহল পুলিশের দল কিছুক্ষণ পরপর এখানে ঘুরে যায়। এ ছাড়া ২৬ ডিসেম্বর থেকে র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে।
পল্লী বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরাপত্তার জোরদার করা নিয়ে কানসাট এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েনি; বরং উৎসবে মেতে উঠেছে। বিশাল এই ইউনিয়নে ৩১ হাজার ভোটারের মন জয় করতে দিনরাত চলছে প্রচার। সকাল না হতেই ইজিবাইক, ভ্যানগাড়িতে করে শুরু হয় মাইকিং। নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থী জন্য ভোট চেয়ে পল্লিগীতি, আধুনিক গান শোনানো হচ্ছে। আর গ্রামের মোড়ে মোড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর অসংখ্য প্রচারণা কেন্দ্র তো আছেই।
এই উৎসব আমেজেও উদ্বেগ রয়েছে পুরো কানসাট ইউনিয়নে। শহীদুজ্জামান নামের এক যুবক বলেন, প্রচারে নৌকা এগিয়ে। কিন্তু ধানের শীষের পক্ষে লোকজন মিছিল করতে নামলে পড়তে হয় হয়রানিতে। ২২ ডিসেম্বর রাতে বিএনপির মিছিল শেষ হওয়ার পর কয়েকজন যুবককে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। শীতের রাতে এমন ঘটনা ঘটলে কে কাকে বাঁচাতে যাবে।
বেশ কয়েকজন ভোটার জানান, পুরো কানসাট ইউনিয়নে ১ লাখ মানুষের বাস। এর মধ্যে ৩১ হাজার ভোটার। সীমান্তের কাছে এই গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক বেশি। এরপর রয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থান। অন্য দলগুলোর চেয়ে জামায়াত–শিবিরের লোকজন বেশ সংগঠিত। দলীয় প্রার্থী না থাকলেও ভোটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে সুযোগ নিতে পারে জামায়াতের লোকজন। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন ধরানোর মতো ঘটনা হয়তো ঘটবে না। কারণ এর ধকল কেমন হতে পারে, সেটি কানসাটবাসী হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে।
এই আসনের বিএনপির প্রার্থী শাহজাহান মিঞা বলেন, ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের লোকেরা বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুন দিয়েছিল।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামিল উদ্দিন আহমেদের দাবি, জামায়াত ও বিএনপির লোকজন রাতে চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ আগে সংগঠিত ছিল না। এখন তারা বেশ শক্তিশালী।
জামায়াতে ইসলামীর প্রাধান্য থাকলেও ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে কানসাটে জয় পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেনাউল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০ বছরে কানসাটে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। তবে এই এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক বেশি। তারা এখন আগের মতো অ্যাকটিভ নেই। কিন্তু ওরা গোপনে কিছু কাজ করছে। এসব কিছুর পরও কানসাটে ১০ বছর পর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাই এখানকার ভোটাররা ভোট দিতে মুখিয়ে আছেন।