>
- আ.লীগের ধারণা, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন একটু আলাদা হবে
- কারণ, এবার জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে মোকাবিলা করতে হবে
- বি. চৌধুরীর বিকল্পধারার পিছুটান ঐক্যকে দুর্বল করে দিয়েছে
- সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন
- নির্বাচন হবে সংবিধান মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে
- দ্বিতীয় অগ্রাধিকার বেশি সম্ভব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত
- তৃতীয় অগ্রাধিকার হচ্ছে নির্বাচনকে সংঘাতমুক্ত রাখা
বিরোধীদের ঐক্যের প্রতি সতর্ক নজর রাখার পাশাপাশি নিজেদের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে বেশি মনোযোগ থাকবে আওয়ামী লীগের। দলটি মনে করছে, বিরোধীদের ঐক্য হবে জোড়াতালির। তাই নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নিজেদের উন্নয়নের প্রচার এবং বিরোধীদের জোর সমালোচনার নীতি নিয়ে এগিয়ে যাবে সরকারি দলটি।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটু আলাদা হবে। কারণ, এবার ড. কামাল হোসেন ও বিএনপির যৌথ নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে মোকাবিলা করতে হবে। তবে এ উদ্যোগ রাজনীতিতে আলোচনার জন্ম দিলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারার পিছুটান ঐক্যকে দুর্বল করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের যে ছক, তাতে বেশ কিছু অগ্রাধিকার রয়েছে। প্রথম অগ্রাধিকার হলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটা নির্বাচন। এই নির্বাচন হবে সংবিধান মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে এবং একটি নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে। এর পরের অগ্রাধিকার হচ্ছে, যত বেশি সম্ভব দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। তৃতীয় অগ্রাধিকার হচ্ছে নির্বাচনকে সংঘাতমুক্ত রাখা। এবারও আওয়ামী লীগ ও জোটের জয়ী হওয়ার ব্যাপারে কেউ বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, বিরোধীদের ঐক্য নিয়ে তাঁদের খুব মাথাব্যথা নেই। কারণ, এই ঐক্য এমন সময় হয়েছে, যখন জনগণের কাছে যাওয়ার সময়ই নেই। দাবি আদায় কিংবা ভোট নিজেদের পক্ষে আনা তো পরের কথা। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতি অনেক আগেই শুরু করেছে। এখন চূড়ান্ত পরিণতি দেওয়ার কাজ চলছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় রায়ের টুকিটাকি বিষয় ছাড়াও আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়েও প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। ওই দিন আগামী নির্বাচনের জন্য দলীয় ইশতেহার তৈরির লক্ষ্যেও প্রথম বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় বিরোধী দল, ঐক্য প্রক্রিয়া ও নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করছেন, গ্রেনেড হামলা মামলার রায়, ভূরাজনৈতিক অবস্থা, প্রশাসনের ওপর সরকারের এখন পর্যন্ত যে নিয়ন্ত্রণ, তাতে নিজেদের প্রস্তুতি ঠিক থাকলে নির্বাচনে কেউ বাধা হতে পারবে না।
নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে এখন চারটি বিষয় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে করছেন দলীয় নেতারা। এগুলো হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি, দলীয় কোন্দল মোকাবিলা করে প্রার্থী ঠিক করা এবং বর্তমান জোট অক্ষুণ্ন রেখে প্রয়োজনে তা সম্প্রসারণ। তবে বিএনপিসহ বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করলে বেশিসংখ্যক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টিও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতিতে রয়েছে। এ ব্যাপারে দলীয় নেতাদের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও তৎপর আছে।
নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির জন্য দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাককে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১০ অক্টোবর এ–সংক্রান্ত সভায় আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম, আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মসিউর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ দলীয় নেতা ও পেশাজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। ইশতেহার প্রণয়নে এটাই প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক।
ওই বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানায়, সবাইকে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে দেওয়া দুটি ইশতেহার পর্যালোচনা করে আরও কী কী অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে নিজেদের বক্তব্য তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়। বৈঠকের পর আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কিছু শিক্ষক, সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
ইশতেহার সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তাঁরা কাজ করছেন। এখনো সবকিছু চূড়ান্ত হয়নি।
নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সময় ও আকার কী হবে, সেটা প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করছে। যদিও দলীয় নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা আছে। কেউ কেউ মনে করেন, নির্বাচনকালীন সরকার তফসিল ঘোষণার পর হতে পারে। কারও মত, আগেই হতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকারের আকার কত ছোট হবে, এটা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। কারও কারও মত, সরকারের সদস্যসংখ্যা ২৫–এর মধ্যে রাখা হতে পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারে শরিক ও মিত্র দলগুলো থেকে কিছু নতুন মুখ আসতে পারে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিরা নিজ নির্বাচনী এলাকায় গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন। ফলে কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখা হবে, এ নিয়ে একটা জটিলতা আছে।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের একটি সূত্র জানায়, দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হচ্ছে। প্রথমত, বিএনপিসহ বিরোধীরা নির্বাচন বর্জন করছে কি না। নিজেদের জোট সম্প্রসারণ হচ্ছে কি না। আর আগে আগে মনোনয়ন দিয়ে দিলে দলের কোন্দল আরও বেড়ে যেতে পারে কি না। সব দিক বিবেচনা করে মনোনয়ন শেষ মুহূর্তে নিশ্চিত করা হবে।
কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আত্মপ্রকাশ এবং নির্বাচনে অধিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ জোট সম্প্রসারণ, মিত্র তৈরি এবং আসন সমঝোতার মতো নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এর অংশ হিসেবে বাম ঘরানার ও ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে ইসলামিক ফ্রন্টের সঙ্গে প্রকাশ্যেই বৈঠক হয়েছে। প্রয়াত মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর ছেলে আবুল হাসানাত আমিনীর ইসলামি ঐক্যজোটের সঙ্গে কথা চলছে। জাতীয় যুক্তফ্রন্টের শরিক বা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত দলগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করছে আওয়ামী লীগ। এর বাইরে ব্যক্তিপরিচিতি আছে, এমন নেতা–সর্বস্ব কিছু দলকেও সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে রাখতে তৎপর আওয়ামী লীগ।