সাংসদেরা দলীয় কাঠামোর বাইরে নিজস্ব অনুসারী গোষ্ঠী তৈরি করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। যারা স্থানীয়ভাবে ‘এমপি লীগ’ নামে পরিচিত।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে মাদারীপুর আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে বিভক্তি ও কোন্দল আবার সামনে এসেছে। দলীয় মনোনয়নে তিন সাংসদদের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তৃণমূলের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সাংসদেরা দলীয় কাঠামোর বাইরে নিজস্ব অনুসারী গোষ্ঠী তৈরি করে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন। যারা স্থানীয়ভাবে ‘এমপি লীগ’ নামে পরিচিত।
মাদারীপুর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমপি লীগের কাছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অনেকটা কোণঠাসা।
মাদারীপুরে চারটি উপজেলা নিয়ে তিনটি সংসদীয় আসন। তিনটিতেই ১৯৯১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে আসছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাত নেতার বাড়ি মাদারীপুরে। তাঁদের মধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুস সোবহান (গোলাপ) দুটি আসনের সাংসদ। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সাবেক সাংসদ। বাকি চার কেন্দ্রীয় নেতা স্থানীয় রাজনীতিতে তেমন আলোচনায় নেই। এর বাইরে অন্য আসনের সাংসদ হলেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূরে আলম চৌধুরী। এ ছাড়া সাবেক সাংসদ ও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বাড়িও মাদারীপুরে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, নূরে আলম চৌধুরীর এলাকা শিবচর উপজেলার দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রায় সবাই তাঁর অনুসারী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনে হওয়ায় প্রভাবশালী এ নেতার এলাকায় অন্য কেউ মাথাও ঘামায় না। তিনিও অন্য এলাকার রাজনীতি নিয়ে হস্তক্ষেপ করেন না।
জনপ্রিয় হয়ে লাভ নেই, এমপি-প্রিয় হতে হবে।মশিউর রহমান, সাবেক সভাপতি, কালকিনি উপজেলা ছাত্রলীগ
তবে সবচেয়ে বেশি কোন্দল মাদারীপুর সদর নিয়ে। ১৯৯১ সালে জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে আসেন শাজাহান খান। এর পর থেকে সদর আসনে টানা ছয়বারের সাংসদ তিনি। কিন্তু গত ৩০ বছরেও তাঁর সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধ দূর হয়নি। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের এখন দুটি কমিটি। একটি চলছে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে, আরেকটি সাংসদের নিজস্ব কার্যালয়ে বসে কার্যক্রম চালায়। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ‘অবৈধ’ বলে থাকে। দুই পক্ষই প্রতিটি ইউনিয়নে আলাদা কমিটি দিয়েছে। যুবলীগ-ছাত্রলীগেও একই বিভক্তি রয়েছে। স্থানীয় নির্বাচনে দুই পক্ষের আলাদা প্রার্থী থাকে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারিয়েছেন শাজাহান খানের ভাই ওবাইদুর রহমান খান।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মাদারীপুরে নৌকা প্রতীক ছিল। এবারের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক না দিতে তিন সাংসদ মিলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে চিঠি দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত কালকিনি ও ডাসার উপজেলায় নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছে। শিবচর ও সদর উপজেলায় দেওয়া হয়নি।
বাহাউদ্দিন নাছিমের ভাই এবং মাদারীপুর পৌর মেয়র ও জেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. খালিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নৌকার বাইরে ভোট দেওয়ার অভ্যাস তৈরি করলে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর শাজাহান খানের চাচাতো ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফিক খান বলেন, কোন্দলের কারণে মূল আওয়ামী লীগ হারিয়ে যাচ্ছে।
জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, যাঁরা আওয়ামী লীগ করেন, তাঁরা নৌকায় ভোট দিতে চান। বিএনপি-জামায়াতের লোক তো নৌকায় ভোট দেবে না। কিন্তু তাদের মধ্যে সাংসদের অনুসারী আছে। তাই নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করেছেন সাংসদ। তারপরও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে দলীয় মনোনয়নের তালিকা পাঠানো হয়। কারণ, দল মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। এই নেতাদের মতে, এখানে দল, প্রতীক গুরুত্ব পাচ্ছে না, সবই ব্যক্তি অনুসারী তৈরি হচ্ছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নেতা-কর্মীদের মধ্যে নৌকা প্রতীকের চাহিদা ছিল। এটি না পাওয়ায় তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এমপিরা কি দলের চেয়েও পাওয়ারফুল?’ তিনি বলেন, সাংসদের অনুসারীরা নৌকা পাবেন না বলেই তিনি প্রতীক দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে কয়েক দিন ধরে বেশ কয়েকবার শাজাহান খানকে ফোন করা হয় এবং খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। তাঁর অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এজাজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মাদারীপুর আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত অঞ্চল। ইউনিয়নে দলীয় প্রতীক দিলে বিভক্তি তৈরি হয়।
কালকিনির রমজানপুর ইউনিয়নে গতবার নৌকা প্রতীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সাংসদ আবদুস সোবহানের ভাই মো. ইউনুস আলী। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে চেয়ারম্যান হওয়া সাংসদের ভাই গত পাঁচ বছরে ব্যাপক বিতর্কিত হন। এবার তাঁর আরেক ভাই বি এম মিল্টন ইব্রাহিমকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এনে নৌকার মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভাইকে জয়ী করতে স্বতন্ত্র আলী নূর তালুকদারকে জোর করে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে তিনি অভিযোগ করেন। আলী নূর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে এনে এক ভাইয়ের বদলে আরেক ভাইকে নৌকা দিয়েছে। আমাকে বাড়ি থেকে জোর করে তুলে এনে মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদনে স্বাক্ষর নিয়েছে সাংসদের অনুসারীরা। দল করে আর লাভ কি?’
এর আগে কালকিনি পৌর নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমানকে গত ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ দিয়ে ঢাকায় তুলে আনার অভিযোগ আছে সাংসদের বিরুদ্ধে। মশিউর রহমান ছাত্রলীগের সাবেক উপজেলা সভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনপ্রিয় হয়ে লাভ নেই, এমপি-প্রিয় হতে হবে।’
কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূল থেকে পাঠানো দলীয় তালিকার কেউ মনোনয়ন পাননি। মনোনয়ন পেয়েছেন সাংসদ আবদুস সোবহানের অনুসারীদের করা তালিকার প্রার্থীরা। শেষ পর্যন্ত এই উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ৯টিতে নৌকার প্রার্থীরা হেরেছেন।
কালকিনির নেতাদের অভিযোগ, গত নির্বাচনে প্রথমবার সাংসদ হয়েই আলাদা সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করতে থাকেন আবদুস সোবহান। উপজেলা আওয়ামী লীগকে পাশ কাটিয়ে প্রথমে ছাত্রলীগের আলাদা কমিটি করেন। এরপর তাঁতী লীগ, সৈনিক লীগ ও মৎস্যজীবী লীগের কমিটি দিয়েছেন। এগুলো এখানে কখনো ছিল না।
এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে আবদুস সোবহানকে একাধিকবার ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তাঁর স্থানীয় প্রতিনিধি ও কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ৯টি ইউনিয়নে নৌকার হার খুব দুঃখজনক। সাংসদ উপজেলা নেতা-কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন করলে বিরোধ থাকত না।
তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংরক্ষিত আসনের সাংসদ তাহমিনা সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে কখনো দলীয় কোন্দল ছিল না। গোলাপ (আবদুস সোবহান) আসার পর নিজের হাত শক্তিশালী করার পাঁয়তারা করছে। পৌর ও ইউনিয়ন নির্বাচনে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। সবই টাকার খেলা।’