এক যুগে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে ৯৪৬ বার
আ.লীগ সভা করেছে ১৮৫টি, বিএনপি ৮৪টি
প্রতিবাদী গান, নাটকের স্ক্রিপ্ট দেখছে পুলিশ
সরকারের জাতীয় জরুরি সেবা ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল করা যাবে। এ জন্য শুধু মহানগরীতে পুলিশ কমিশনার আর জেলাপর্যায়ে পুলিশ সুপারের কাছে একটা আবেদন করতে হবে। অনুমতি পেলে দু-চার দিন পর্যন্ত পুলিশ নিরাপত্তা দেবে।
বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সংগঠনগুলো বলছে, ওয়েবসাইটে সভা-সমাবেশের অনুমতি যত সহজে পাওয়া যাবে বলে বলা হচ্ছে, আসলে তা নয়। সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগ দেওয়ার অধিকার মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু গত এক যুগে সভা-সমাবেশে বিরোধীদের সরকার দাঁড়াতেই দেয়নি। সভা-সমাবেশের অনুমতি পেলেও কৌশলে তা পণ্ড করেছে। হয় সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী, নইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সমমনা সংগঠনগুলোর সভা-সমাবেশ করার অভিজ্ঞতা ভালো ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।
দেশে সভা-সমাবেশের অধিকার কতটা, তা পর্যবেক্ষণ করে থাকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারার প্রয়োগ কতবার এবং কোনো প্রেক্ষাপটে হয়েছে, তা দিয়ে এ অধিকার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। আসকের হিসাবে, গত এক যুগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে ৯৪৫ বার।
কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, মোটাদাগে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মাঠে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে বিরোধ ঠেকাতে এ ধারার প্রয়োগ করা হতো। পরে ক্ষমতাসীন দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব ঠেকাতে এ ধারার প্রয়োগ দেখা গেছে। এ ধারার বলে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে পারেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছে গত এক যুগে সভা-সমাবেশের কতগুলো আবেদন জমা পড়ে এবং কতগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়, তার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে সবশেষ গত বছরের ২ ডিসেম্বর অনুমতি ছাড়া ঢাকা মহানগরীতে যেকোনো ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ডিএমপি। অনুমতি ছাড়া কেউ সভা-সমাবেশ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। পুলিশের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্তর সমালোচনাও হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর জন্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি দায়ী। তাঁরা ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার কথাও বলছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এ জন্য দায়ী ৯১–পরবর্তী রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি অসহিষ্ণুতার। যে দল সরকার গঠন করছে, সে দল সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে। আবার কখনো কখনো সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে—এমন ঘটনায় সভা-সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। তা ছাড়া, সরকারের অবস্থান যখন শক্ত থাকে, তখন বিরোধী দলকে সহজেই সভা-সমাবেশের অনুমতি দিয়ে দেয়।
এ বিষয়ে এর আগে মন্তব্য চেয়ে যোগাযোগ করা হলে কোনো সাড়া দেননি তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। গতকাল বুধবার আবার ফোনে যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর মেলেনি।
গত এক যুগে সভা-সমাবেশ করেছে কিংবা করার চেষ্টা করেছে—এমন রাজনৈতিক দলগুলো হলো আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও ভোটের হিসাবে তৃতীয় স্থানে থাকা চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রথম সমাবেশ করে ‘ল্যাম্পপোস্ট’ নামের একটি সংগঠন। পরে কয়েক বছর মাঠে সক্রিয় ছিল তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ আরও বেশ কয়েকটি নাগরিক সংগঠন।
এ ছাড়া গত এক যুগে তিন থেকে চারটি স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ হয়েছে ঢাকায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চ টানা তিন মাস সমাবেশ করে। এ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বরে একই বছর ৫ মে সমাবেশ ডাকে, যা পরে সহিংসতায় গড়ায়। ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার পাশাপাশি শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের মঞ্চও উঠিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর বাইরে ২০১৫ সালে অতিরিক্ত ভ্যাট বাতিলের দাবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘নো ভ্যাট’ আন্দোলন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং ওই একই বছর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন ছিল উল্লেখ করার মতো ঘটনা। এ আন্দোলনগুলোর সূত্রপাত হয় প্রতিবাদী সমাবেশ থেকে।
রাজনৈতিক দলগুলো এই এক যুগে কতগুলো সভা–সমাবেশ করেছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সভা–সমাবেশের তুলনামূলক একটি চিত্র পাওয়া যায়। ঢাকায় গত এক যুগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের ১৮৫টি সমাবেশের খবর, অন্যদিকে বিএনপি-জামাত জোটের ৮৪টি সমাবেশের খবর ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি সরকার উৎখাত ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাতের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে একযোগে ১০০টি ওয়ার্ডে এবং পরের বছর জামায়াত-বিএনপির ডাকা হরতালের প্রতিবাদে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউসহ ২২টি জায়গায় সমাবেশ হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সভা-সমাবেশ করেছে বেশি।
এ সময়ে আওয়ামী লীগকে সভা-সমিতি করায় কোনো বেগ পেতে হয়নি বলে জানিয়েছেন দলটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় অনুমতি নিয়ে সভা–সমাবেশ করে। সিটি করপোরেশন ও পুলিশ—দুই পক্ষের কাছেই আবেদন করা হয়। এমনকি ফুটপাত ব্যবহারেরও অনুমতি নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু আওয়ামী লীগ জনশৃঙ্খলা ও জনশান্তির জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী কোনো কার্যক্রমে যুক্ত থাকে না, সে কারণে দলটির অনুমতি পেতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু বিএনপি তো জনশান্তি ও শৃঙ্খলা নষ্ট করে। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র পর্যন্ত সমাবেশের সময় কেড়ে নিয়েছে। সে কারণে তাদের অনুমতির বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠনগুলোর সভা–সমাবেশ পণ্ড করতে সরকার কখনো কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। কখনো পুলিশ পিটিয়ে সভা-সমাবেশ ভেঙে দিয়েছে, কখনো সভা–সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো হয়েছে। কথা হচ্ছিল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান তুলে দেয়। এটি বহালের দাবিতে বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু দেখা যায়, ২০১২ সালে বিএনপির সভা-সমাবেশে লোক জড়ো হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা আসতে শুরু করে। সেখানেই সমাবেশ, সেখানেই একধরনের অঘোষিত কারফিউ দেওয়া হচ্ছিল। বলা যায়, সরকারই অবরোধ–হরতাল ডেকে বসছিল। হোটেল ও বাসায় অভিযান চালিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার–হয়রানি করা হচ্ছিল।
বিএনপির এই নেতা বলেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একই অবস্থা। কত কর্মসূচিতে অনুমতি পাওয়া যায়নি, তা বলা কঠিন। ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৮ সালে বিএনপি ও জোটের দলগুলো বলা যায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমাবেশের অনুমতি চেয়ে পায়নি। এমনকি ২০২০ সালের শুরুতে করোনা মহামারির আগেও এমন অবস্থা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ২০১২ সালের ১২ মার্চ ‘চল চল, ঢাকা চল’ কর্মসূচির ২৪ ঘণ্টা আগে ঢাকার সঙ্গে দেশের সড়ক ও নৌ যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সরকার। গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। চাঁদপুর, পিরোজপুর, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সঙ্গে লঞ্চ যোগাযোগ বন্ধ হয়। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীদের ভিডিও চিত্র ধারণ করতে বলা হয়। পরিচিতি নিশ্চিত না হয়ে কাউকে হোটেলে না রাখার পরামর্শ দেওয়া হয় ডিএমপি থেকে। সরকারি কাজে ব্যবহারের কথা বলে গাজীপুর, চাঁদপুর, জয়পুরহাট ও ময়মনসিংহে ১৪৫টি বাস ও লঞ্চ রিকুইজিশন করা হয়। ১১ ও ১২ মার্চ ২৮ জেলায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৯৯৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে রাজধানীতে ৪৩১ জন। পরে ১১ শর্ত মেনে বিএনপি নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত সমাবেশের অনুমতি পায়। ওই বছরের ১১ জুন আবারও মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নেয় বিএনপি। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার হন ২ হাজার ২০৫ জন।
তবে অপেক্ষাকৃত নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশ করেছে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন। দলটির যুগ্ম পরিচালক গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের আগে তাঁরা সভা-সমাবেশের অনুমতি পেয়েছেন। এখন সমস্যা হচ্ছে।
দাবি আদায়ে সমাবেশ থেকে যে ইস্যুগুলোয় বড় আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেখানে পুলিশ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে। ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক মো. রাশেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাঁদের আট নেতার বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বাসভবনে হামলা, মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ ও ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়। তিনি নিজে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যখনই সভা-সমাবেশের চেষ্টা তাঁরা করেছেন, হামলার শিকার হয়েছেন। সভা-সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন। কখনো হেলমেট পরে হাতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে, কখনো হাতুড়িপেটা করে সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া হয়। হেলমেট বাহিনী, হাতুড়ি পার্টির নামের জন্ম এই যুগেই।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এলে ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা হয়।
ধারা অব্যাহত ছিল এ বছরও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ-মিছিল ও সভা-সমাবেশ শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় মোড় নেয়। প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগ, হামলা-মামলা-গ্রেপ্তারে এর সমাপ্তি হয়।
পুলিশ অবশ্য বলছে, তারা যা কিছু করেছে, তা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায়। ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, বেআইনিভাবে কিছু করা হয়নি। ঢাকা মহানগরী পুলিশ অধ্যাদেশ অনুযায়ী, পুলিশ কমিশনার জনসাধারণের শান্তি বা নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যখনই প্রয়োজন মনে করবেন এবং যে সময়ের জন্য প্রয়োজন মনে করবেন, তখনই জনসমক্ষে উচ্চ স্বরে বক্তৃতা দেওয়া, ব্যঙ্গসূচক অঙ্গভঙ্গি করা, ছবি, প্রতীক, প্ল্যাকার্ড বা এমন অন্য বস্তু বা মালামাল প্রস্তুত, প্রদর্শন বা বিতরণ করা, যা তাঁর বিবেচনায় শালীনতা বা নৈতিকতার পক্ষে ক্ষতিকর অথবা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যাহত হয়, সেগুলো নিষিদ্ধ করতে পারেন।
ওই একই অধ্যাদেশে জনসাধারণের শান্তি বা নিরাপত্তা রক্ষার জন্য পুলিশ কমিশনার যখনই প্রয়োজন মনে করবেন এবং যত দিনের জন্য প্রয়োজন বিবেচনা করবেন, লিখিত আদেশ দিয়ে জনসমাবেশ বা মিছিল নিষিদ্ধ করতে পারবেন। সরকারি প্রয়োজনে পুলিশ কমিশনার কোনো রাস্তা বা জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থান সংরক্ষিত করার ক্ষমতাও রাখেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া ও জনসংযোগ) মো. সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত আইনি পন্থা অবলম্বন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ সাপেক্ষে ও নিরাপত্তাঝুঁকি না থাকলে সভা–সমাবেশের অনুমতি না মেলার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ পুলিশ দলমত-নির্বিশেষে সবার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে করোনা অতিমারির সময় জনস্বার্থে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় সব ধরনের সভা–সমাবেশকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
তবে নাগরিক সংগঠনগুলো বলছে অন্য কথা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক মাহা মির্জার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি গত বছরের অক্টোবরে খুলনার খালিশপুরে পাটকলশ্রমিকদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে কী ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে, তার উদাহরণ দেন। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা থেকে বেশ কিছু গানের দল এবং নাটকের দল ‘থিয়েটার বায়ান্ন’ গিয়েছিল খালিশপুরে। অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে থেকেই খুলনার গোয়েন্দা পুলিশ স্থানীয় সংগঠকদের ফোনের মাধ্যমে হয়রানি করা শুরু করে। কী ধরনের গান হবে, কী নাটক মঞ্চস্থ হবে, নাটকের স্ক্রিপ্ট ডিবি অফিসে জমা দিতে হবে—এসব ‘নির্দেশনা’র মাধ্যমে ক্রমাগত সংগঠকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। পরে নাটকের স্ক্রিপ্ট হাতে পাওয়ার পর কী কী পরিবর্তন করতে হবে, সেই ‘নির্দেশনা’র প্রিন্ট কপি হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারা বলে দেয়, ‘শিরোনামে ফাঁসের স্থলে আঁশ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হবে, টিভিতে দেহাবে বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন কোহানে হইছে সেই কথা’ বাক্যটি বিলুপ্ত হবে। ‘বড় সাব কলো, উনার বাসায় যাইয়ে যেন জাকাত–ফিতরার টাকা নিয়ে আসি আমরা। এ ছাড়া কোনো টাকা দিতি পারবে না।’ বাক্যদ্বয়ের স্থলে ‘এখন কি আমরা মানুষের বাড়ি বাড়ি জাকাত আনতি যাব’, এ পরিবর্তনগুলো করতে হবে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর তিন থেকে চার বছর নাগরিক সংগঠনগুলোই মূলত সক্রিয় ছিল এবং মারধরের শিকার হয়। ঢাকায় প্রথম সমাবেশ হয় ২০০৯ সালের ৫ জুলাই। ল্যাম্পপোস্ট নামের একটি সংগঠন টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ এবং বাংলাদেশের পরিবেশবিদদের কটাক্ষ করায় ঢাকায় কর্মরত তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীকে প্রত্যাহারের দাবিতে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে সমাবেশের উদ্যোগ নেয়। পুলিশ পিটিয়ে ওই সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে সংগঠনের দুজন কর্মী আহত হন।
পরের মাসে তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি কনকো ফিলিপস এবং তাল্লোর সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্টের বিরোধিতা করে মিছিল করে। মিছিলে বেধড়ক লাঠিপেটা করে পুলিশ। এতে অধ্যাপক আনু মোহাম্মদসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি আড়িয়ল বিলে বিক্ষোভ সমাবেশ একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু, পুলিশ–সাংবাদিকসহ শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, পরমাণুবিজ্ঞানী ফয়জুর রহমান আল সিদ্দিকীসহ ২২ হাজার স্থানীয় লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
বিরোধী দল কিংবা মতভিন্নতা আছে—এমন সংগঠনগুলোর সভা-সমাবেশ করায় বাধা অব্যাহত থাকে পরের বছরগুলোতেও।