সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার আজ বুধবার বেলা দেড়টার দিকে মারা গেছেন। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে কথা বলে আলোচনায় ছিলেন তিনি। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হয়। এর আগে তিনি প্রথম আলোকে শেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছিলেন। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রিয়াদুল করিম। সাক্ষাৎকারটি পাঠকের জন্য আবারও তুলে ধরা হলো।
প্রথম আলো: নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর কেমন কাটল?
মাহবুব তালুকদার: নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বাইরের শান-শওকত, গানম্যান, প্রোটেকশন ফোর্স, অফিস ও বাসায় জাতীয় পতাকা, গাড়িতে নিজস্ব পতাকা ইত্যাদি আমার জন্য ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নানাবিধ টানাপোড়েনে আমি বিপর্যস্ত ছিলাম। আমি নির্বাচন সম্পর্কে নীরব জনগোষ্ঠীর অশ্রুত ভাষা শ্রবণের চেষ্টা করে তাদের মনোভাব অনুযায়ী চলতে চেয়েছি। কারণ, নির্বাচনে জনমানসের প্রতিফলন অপরিহার্য। বিভিন্ন সময় মিডিয়ার সামনে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছি, তাতে নির্বাক জনগণের নীরব ভাষার আমি ছিলাম মুখপাত্র। কিন্তু বাস্তব অবস্থার টানাপোড়েন এড়াতে পারিনি।
প্রথম আলো: আপনারা দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করেছিলেন। সেটি প্রশংসিত হয়েছিল। সর্বশেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনও ভালো হয়েছে। কিন্তু মাঝখানে প্রায় সব স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এর কারণ কী?
মাহবুব তালুকদার: কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় নতুন কমিশন হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালনে বাইরে কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। প্রথম দিকে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ ছিলাম। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভেতর ও বাইরের নানা চাপের কারণে সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ ছিল না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব, এটা প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ফলে এই নির্বাচন ছিল ব্যতিক্রমী। অন্যদিকে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন আমি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এর স্বরূপ সন্ধান করি। এর বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করি আর বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমি একক দায়িত্ব পালন করেছি। অনিয়মের কারণে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন বন্ধ করতে চেয়েও সহকর্মীদের অসহযোগিতায় আমি তা পারিনি। এ দুটি নির্বাচনে কমিশনের কোনো কর্তৃত্ব ছিল বলে মনে হয় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব ছিল দৃশ্যমান। আবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল অনিয়মের মডেল। বাকি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেরও তথৈবচ অবস্থা। যেনতেন প্রকারে নির্বাচন হয়েছে।
প্রথম আলো: বরিশাল সিটি করপোরেশনের ভোট বন্ধ করতে আপনি কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন? সহকর্মীদের অসহযোগিতাটা কেমন?
মাহবুব তালুকদার: ৩০ জুলাই ২০১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন তদারকিতে আমি একক দায়িত্বে ছিলাম। নির্বাচনপূর্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রার্থী, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ, সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করি। সকাল ৮টায় টেলিভিশনে ভোটকেন্দ্রে ভিড় দেখে আমি খুবই আশাবাদী হই যে বরিশালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শান্তি ও শৃঙ্খলা পাল্টে যেতে থাকে। এরপর থেকে বিভিন্ন নেতিবাচক সংবাদ ও প্রতিবেদন আসতে থাকে। আমরা সিইসির অফিসকক্ষে বসে নির্বাচন মনিটর করছিলাম। একজন কমিশনার প্রথমে খবর দেন যে সাড়ে আটটায় নির্বাচনী কাজে ব্যবহৃত ট্যাব ছিনতাই হয়েছে। পরে আরও খবর আসে, কমিশনের একজন মহিলা সিস্টেম এনালিস্টকে নাজেহাল করা হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে বরিশালের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা হয়, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আমার অভিমতের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে সিইসিসহ সব কমিশনার একমত হন। কিন্তু কোন আইনে আমরা নির্বাচন বন্ধ করতে পারি, যুগ্ম সচিব (আইন)-কে ডেকে তা জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি নির্বাচন ম্যানুয়েল দেখে বলেন, ৯০ ধারা মোতাবেক এই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আমি আশ্বস্ত হই। এই পর্যায়ে একজন কমিশনার বলেন, যেহেতু আমি বরিশাল সিটি নির্বাচনের সার্বিক দায়িত্বে, সেহেতু আমি এতদ্সংক্রান্ত নথিতে নির্বাচন বন্ধে বিষয়টি লিখে দিলে তাঁরা সমর্থন করবেন। আমি একটি কাগজে নোটে কী লিখব, তার খসড়া লিখে দিই। সিইসি সেটা পড়ে বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে নির্বাচন বন্ধ করার বিষয়টিতে তাঁরা গড়িমসি করতে থাকেন। আমার প্রস্তাবিত সিদ্ধান্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। দুপুরবেলা একজন কমিশনার বলেন, এখন নির্বাচন বন্ধ করলে আমাদের লোকজনের ওপর হামলা হবে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। সবাই তাতে সায় দেন। অবশেষে সহকর্মীদের অসহযোগিতায় নির্বাচন আর বন্ধ করা যায়নি।
প্রথম আলো: একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মাহবুব তালুকদার: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের ব্যর্থতার গ্লানি ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। ওই নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর অস্তিত্ব ছিল না। যদিও সিইসি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে বলে দাবি করেন। জেলা প্রশাসকেরা রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সিটিং এমপিদের বিষয়ে তাঁদের নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সম্ভব ছিল বলে মনে করি না। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এতেই বোঝা যায় নির্বাচন কেমন হয়েছে? এভাবে না অবাধ, না সুষ্ঠু, না নিরপেক্ষ, না আইনানুগ, না গ্রহণযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রথম আলো: একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিরোধী দলগুলো। সিইসি বলেছেন, আদালতের নির্দেশনা না থাকায় রাতের ভোটের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করা যায়নি। আদালতের নির্দেশ ছাড়া কি ইসি তদন্ত করতে পারে না? এ বিষয়ে কি আপনাদের মধ্যে কখনো আলোচনা হয়েছে?
মাহবুব তালুকদার: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপার ভর্তি বাক্সের ছবি বিবিসির সাংবাদিক প্রকাশ করেছেন। এই অভিযোগ খণ্ডনের কোনো উপায় ছিল না। কারণ, এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। আদালতের নির্দেশ ছাড়া রাতের ভোটের তদন্ত করা যেত না, তা ঠিক নয়। নির্বাচন যথাযথ হয়নি মনে করলে কমিশন ফলাফল ঘোষণার পরও নির্বাচন বাতিল করতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। নির্বাচনের পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে সিইসি বলেছিলেন,─‘এই নির্বাচনের বিষয়ে আমি অতৃপ্ত নই, তৃপ্ত। শুধু আমি নই, পুরো কমিশনই সন্তুষ্ট। কেউ তো আমাকে তাঁর অসন্তুষ্টির কথা বলেননি।’
আমরা সবাই সফল নির্বাচনের সুখস্বপ্নে বিভোর ছিলাম বলে নিজেদের মধ্যে আলোচনার অবকাশ ছিল না।
প্রথম আলো: একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে নানা তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
মাহবুব তালুকদার: একাদশ জাতীয় নির্বাচনের যে ফলাফল পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তা মোটেই বিভ্রান্তিকর মনে করি না। ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ১ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে ৬ হাজার ৪৮৪টি কেন্দ্রে। অন্যদিকে ৮০ শতাংশ থেকে ৮৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ১৫ হাজার ৭১৯ ভোটকেন্দ্র। এসব পরিসংখ্যান তো নির্বাচন কমিশনেরই প্রদত্ত।
প্রথম আলো: সংসদ নির্বাচনের আগে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারার কারণ কী?
মাহবুব তালুকদার: সংসদ নির্বাচনের আগে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসির নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বর্তমান নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় এটাই তো স্বাভাবিক। নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানেন, নির্বাচন কমিশন সাময়িকভাবে তাঁদের ‘বস’ হলেও স্থায়ী ‘বস’ হচ্ছেন যাঁরা সংসদ সদস্যের চেয়ারে আসীন থেকে পুনরায় নির্বাচনে সংসদ সদস্য হবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষহীনতার কথা আগেই বলেছি। আমার মতে, জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত হওয়া উচিত।
প্রথম আলো: সংবিধান ও আইনে ইসিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া আছে। আপনারা সেটি প্রয়োগে ব্যর্থ হলেন কেন?
মাহবুব তালুকদার: বিদ্যমান সংবিধান ও আইনে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও ক্ষমতা প্রয়োগের মনস্তাত্ত্বিক দৃঢ়তা না থাকলে তা সম্ভব হয় না। নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সংস্কার না হওয়ায় নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা শিথিল ছিল। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান ও বিধিবিধান পরিবর্তিত হতে পারে।
প্রথম আলো: সংবিধান সংশোধন মানে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছেন?
মাহবুব তালুকদার: আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ না করলে সেই নির্বাচন ঘরে ও বাইরে গ্রহণযোগ্য হবে না। বিগত দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। এ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য হয়েছে। সংবিধান সংশোধন ছাড়া এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়।
প্রথম আলো: বিভিন্ন নির্বাচনে অনিয়ম–সহিংসতা নিয়ে আপনি বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। সিইসি বলেছেন, আপনার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে এসব বক্তব্য দিয়েছেন। আপনার ব্যাখ্যা কী?
মাহবুব তালুকদার: সিইসি ঠিকই বলেছেন, আমি এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করেছি। তবে এজেন্ডাটি আমার নিজস্ব নয়, জনগণের তথা দেশবাসীর। এই এজেন্ডা হচ্ছে সব নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, আইনানুগ ও শান্তিপূর্ণ করা। কোথাও সহিংসতা হলে তার দায় এড়াব না। সর্বশক্তি দিয়ে এর পুনরাবৃত্তি রোধ করব। আমার এজেন্ডা হচ্ছে─ভোটাধিকারের মাধ্যমে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আমার এজেন্ডা হচ্ছে─গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা, যা সংবিধানের মূল পথনির্দেশ। ‘গণতন্ত্রহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়?’
প্রথম আলো: আপনার আমলার আমলনামা বইয়ে লিখেছেন, এখনকার সিইসি কে এম নূরুল হুদা আর আপনি সংসদ সচিবালয়ে একই সঙ্গে যখন কর্মরত ছিলেন, তখন কে এম নূরুল হুদা আপনার অবাধ্যতা করেছেন। বিষয়টা ব্যাখ্যা করবেন কি?
মাহবুব তালুকদার: ঘটনাটি এ রকম: ১৯৯৮ সালে আমি জাতীয় সংসদে অতিরিক্ত সচিব পদে নিয়োজিত ছিলাম। ওই সময়ে কে এম নূরুল হুদা যুগ্ম সচিব হিসেবে সরাসরি আমার সঙ্গে কাজ করতেন। আমার যোগদানের আগে জাতীয় সংসদে দুটি অতিরিক্ত সচিবের পদ ছিল এবং দুজন কর্মকর্তা পদ দুটিতে নিয়োজিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা সংসদ নেতার অফিসের একটি অতিরিক্ত সচিবের পদ জাতীয় সংসদে সাময়িকভাবে অন্তর্ভুক্ত দেখিয়ে আমাকে সে পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব আমি কিছুই জানতাম না। তবে এ ব্যাপারে সবই আইনসিদ্ধভাবে করা হয়েছিল। ওই সময় আকস্মিকভাবে কে এম নূরুল হুদা জাতীয় সংসদের সচিবের কাছে একটি নোট পাঠিয়ে জানালেন, আমি বহিরাগত (যেহেতু আমি সংসদ সচিবালয়ের নির্ধারিত পদের অতিরিক্ত সচিব নই)। তিনি আমার নির্দেশ মানতে বাধ্য নন। তৎকালীন সংসদ সচিব কাজী মুহম্মদ মনজুরে মওলা তাঁকে ভর্ৎসনা করে বলেন যে এটা তাঁর ইনসাবর্ডিনেশনের পরিচায়ক। সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তিনি (নূরুল হুদা) ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন তুলতে পারেন না। সংসদ সচিবের এহেন নির্দেশের পর কে এম নূরুল হুদা আর উচ্চবাচ্য করেননি। তাঁকে আমার উইং থেকে অন্য কোনো উইংয়ে বদলিও করা হয়নি। উল্লেখ্য, আমার বইটি ২০০৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
প্রথম আলো: আপনি বিভিন্ন সময় নির্বাচন নিয়ে কমিশনের চেয়ে ভিন্ন সুরে বক্তব্য দিয়েছেন। অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছেন। এসব অনিয়ম ঠেকাতে বা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইসির বৈঠকে কি আপনি বক্তব্য দিয়েছিলেন?
মাহবুব তালুকদার: নির্বাচন কমিশন সভার কার্যবিবরণীতে বক্তব্য বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ হয় না। আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য কমিশন সভার কার্যবিবরণীতে স্থান পায়নি। ভিন্নমত হলে তো কথাই নেই। কয়েকটি ক্ষেত্রে আমার লিখিত বক্তব্য কার্যবিবরণীতে সংযুক্ত করতে বলেছি। তবে আমার ভিন্নমত যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য আমি অসংখ্যবার ইউ, ও নোটের (আন–অফিশিয়াল নোট) মাধ্যমে সিইসি, কমিশনারবৃন্দ ও সচিবকে জ্ঞাত করেছি। এ ছাড়া আমি ভিন্নমত পোষণ করে কয়েকবার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি। কমিশন সভায় আমাকে বক্তব্য দিতে না দেওয়ার জন্য ঘোষণা দিয়ে সভা বর্জন পর্যন্ত করেছি। কী ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছি, একটি ঘটনা তুলে ধরতে চাই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় তিন মাস আগে আমি একটি লিখিত বক্তব্য কমিশন সভায় উপস্থাপন করতে চাই। আমার বক্তব্যের শিরোনাম ছিল, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কতিপয় প্রস্তাবনা’। বিষয়টি আমি ইউ, ও নোটের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জানাই। প্রস্তাবনাটি ৩৬তম কমিশন সভায় উপস্থাপনার জন্য লিখিতভাবে আমাকে জানানো হয় ও প্রস্তাবনার কপি সব নির্বাচন কমিশনারের কাছে প্রেরিত হয়। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, প্রস্তাবনাটি আমি যাতে কমিশন সভায় উপস্থাপন করতে না পারি, সে জন্য তিনজন কমিশনারই অভিন্ন ভাষায় ইউ, ও নোটের মাধ্যমে সিইসিকে অনুরোধ জানালে তিনি সভায় প্রস্তাবনা উপস্থাপন করতে দেননি। তাঁদের অভিমত ছিল আমার বক্তব্য সংবিধানবিরোধী বা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিষয়টি আমাকে খুবই মর্মাহত করে। আমার বিপরীতে অবস্থান নেওয়া কমিশনারদের চিঠির কপি আমাকেও দেওয়া হয়েছিল। ফলে আমি এ বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ তৈরি করে সভায় উপস্থিত হই। ওই নোট অব ডিসেন্টে আমি বলি, বাক্ প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান প্রদত্ত আমার মৌলিক অধিকার। নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই আমার এই অধিকার খর্ব করতে পারে না। কমিশনের এহেন অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ আমি কমিশন সভা বর্জন করেছি।
প্রথম আলো: নির্বাচনে অনিয়ম ঠেকাতে আপনার বিশেষ কোনো উদ্যোগ ছিল কি না?
মাহবুব তালুকদার: নির্বাচনে অনিয়ম ঠেকাতে আমি সর্বদাই সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু পাঁচজনের কমিশনে একজন কমিশনার এককভাবে কিছুই করতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের কাছে আমি হেরে গেছি। অনেক সময় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কারণে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারিনি। সংখ্যাগরিষ্ঠরা আমার হ্যাঁ বা না-এর বিপরীতে অবস্থান নিয়ে জয়যুক্ত হয়েছেন।
প্রথম আলো: একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে একটি গুঞ্জন ছড়িয়েছিল যে আপনি পদত্যাগ করতে পারেন। আসলে কি এ ধরনের চিন্তা করেছিলেন? পদত্যাগ করেননি কেন?
মাহবুব তালুকদার: একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে আমি আসন্ন নির্বাচনের বেহাল অবস্থা অনুধাবন করে পদত্যাগের চিন্তা করেছিলাম। বিষয়টি সম্পর্কে গভীরভাবে ভেবে দেখেছি আমার একক পদত্যাগ সমস্যার কোনো সমাধান নয়। আমার পদত্যাগে দেশ ও জাতির কোনো উপকার হবে বলে মনে হলে আমি তা-ই করতাম। বরং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে না গিয়ে এককভাবে যুদ্ধ করাই সমীচীন মনে হয়েছে। আমি পদত্যাগ করলে ভিন্নমত প্রকাশ সম্ভব হতো না এবং জনগণ তা জানতে পারতেন না। তাতে অনেকে স্বস্তি বোধ করতেন, কিন্তু যাঁরা স্বস্তি বোধ করতেন না, সেই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে অবশেষে পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্তেই অটল থেকেছি।
প্রথম আলো: দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক আপনাদের কমিশনের বিরুদ্ধে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ, অনিয়মসহ ৯টি অভিযোগ এনে তা তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়ে ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এসব অভিযোগ নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
মাহবুব তালুকদার: দেশের বিশিষ্টজনেরা নির্বাচন কমিশনারদের বিষয়ে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, তা থেকে আমি অব্যাহতিপ্রাপ্ত নই। সুতরাং এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য বা মন্তব্য করার অবকাশ নেই।
প্রথম আলো: বর্তমান বাস্তবতায় সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রধান প্রধান অন্তরায় কী কী?
মাহবুব তালুকদার: সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান অন্তরায় নির্বাচন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা না হওয়া। এ ছাড়া নির্বাচনে ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বা ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার মনস্তাত্ত্বিক অভিলাষ দূর করতে হবে। স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন ও হস্তান্তর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা থাকা অত্যাবশ্যক। নির্বাচনকালে যে অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অরাজকতা দেখা যায়, কঠোরভাবে তা প্রতিহত করে ভোটারদের মধ্যে ইচ্ছানুযায়ী ভোট প্রদানের আস্থা ফেরানো জরুরি।
প্রথম আলো: আপনার বক্তব্যের কারণে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রীও আপনার সমালোচনা করেছেন। বক্তব্যের কারণে কি কখনো কোনো বিশেষ চাপে পড়েছিলেন?
মাহবুব তালুকদার: মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে আমার সমালোচনা করেছেন, আমার পদত্যাগ দাবি করেছেন। কিন্তু আমাকে সরকারিভাবে পরে জানানো হয়েছে, এসব বক্তব্য সরকার বা দলের সিদ্ধান্ত নয়। আমার বক্তব্যের কারণে বাইরে থেকে কোনো চাপ ছিল না, চাপ ছিল কমিশনের ভেতর থেকে।
প্রথম আলো: নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের মাপকাঠি কী হওয়া উচিত? আইন করে কমিশন গঠন করা হলেই কি শক্তিশালী কমিশন পাওয়া যাবে?
মাহবুব তালুকদার: যেহেতু ইতিমধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করা হচ্ছে, সেহেতু তাদের নিয়োগের মাপকাঠি নিয়ে কথা বলা সমীচীন নয়। আইন করে নিয়োগ করলেই শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন পাওয়া যাবে, এটা বাতুলতা মাত্র। নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা গ্রহণযোগ্য না হলে এর কার্যকারিতা থাকবে না।
প্রথম আলো: ইভিএমে ভোট নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক আছে। আপনি কি মনে করেন আগামী সংসদ নির্বাচন ইভিএমে করা যায় বা করা উচিত হবে? না হলে কেন?
মাহবুব তালুকদার: ইভিএমের আরম্ভলগ্নে আমি ইভিএমের বিরোধিতা করেছি। জনগণ অভ্যস্ত না হলে এর ব্যবহার ঠিক হবে না বলেছি। ইভিএম ব্যবহারের আগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হয়নি। অজ্ঞাত কারণে আমাদের ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তের আগেই ইভিএম কেনা হয়ে যায়। আমার কাছে ইভিএম মেশিন অপূর্ণাঙ্গ মনে হয়। নাসিক নির্বাচনে দেখেছি ইভিএমের কার্যকারিতা বেশ স্লো। ইভিএম সম্পর্কে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একটি ঐতিহাসিক নির্দেশনা আছে। তাতে বলা হয়েছে, ইভিএমে ভোটার ভ্যারিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল যুক্ত থাকতে হবে। এতে ভোটার দেখতে পারবেন, তাঁর ভোটটি ঠিকমতো দেওয়া হয়েছে কি না। বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য আমাদের ইভিএমে এটি যুক্ত করা উচিত। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার ঠিক হবে কি না, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রথম আলো: আপনি বঙ্গভবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’ লিখেছেন। আপনার আমলাজীবন নিয়ে লিখেছেন আমলার আমলনামা। নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর নিয়ে আমরা কি এ ধরনের কিছু পাব?
মাহবুব তালুকদার: নির্বাচন কমিশনের দিনগুলো নিয়ে আমি যে বই লিখেছি, তার নাম নির্বাচননামা। বইটি মূলত নির্বাচন বিষয়ে বিভিন্ন ঘটনার বিশ্লেষণ ও আমাদের কার্যকালের ডকুমেন্টেশন। ১২০০ পৃষ্ঠার এই বই আমার মৃত্যুর আগে প্রকাশ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: বিদায় বেলায় কী বলবেন?
মাহবুব তালুকদার:আগেই বলেছি, নির্বাচনে জনমানসের প্রতিফলন অপরিহার্য। জনগণকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবাধ সুষ্ঠু স্বাভাবিক ও আইনানুগ নির্বাচন আদায় করতে হবে।