গওহর রিজভী বলেছেন
আমি অস্বীকার করছি না যে গুমের কিছু ঘটনার দৃষ্টান্ত নেই।
দিন শেষে আমাদের একটি বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে এবং এটা একটা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু শব্দচয়ন দুর্বল ও অস্পষ্ট হয়েছে, যার অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছে অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
সাংবাদিক টিম সেবাস্টিয়ানের উপস্থাপনায় গত বুধবার জার্মানির গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেতে প্রচারিত টক শো ‘কনফ্লিক্ট জোন’-এ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী। তাঁদের আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, দুর্নীতি, আল-জাজিরার প্রতিবেদনসহ নানা বিষয়। ডয়চে ভেলেতে প্রচারিত আলোচনাটি পুরো তুলে ধরা হলো:
টিম সেবাস্টিয়ান: গওহর রিজভী, আপনাকে কনফ্লিক্ট জোনে স্বাগত জানাচ্ছি৷
গওহর রিজভী: ধন্যবাদ।
সেবাস্টিয়ান: আপনার দেশ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণে পরিণত হয়েছে, যা আপনার সরকার নিয়মিত অস্বীকার করে আসছে। আপনি একজন একাডেমিক, যিনি কিনা একসময় সত্য নিয়ে কাজ করতেন, এখন কেন এমন এক সরকারের জন্য কাজ করছেন, যার মধ্যে এ ব্যাপারে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে?
গওহর রিজভী: মি. সেবাস্টিয়ান, আমার মনে হয় প্রশ্নটি আরও স্বচ্ছ করার প্রয়োজন। আপনি যখন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলছেন, তখন বলতে হচ্ছে, মানবাধিকার বেশ বিস্তৃত অর্থবহ একটি শব্দ।
সেবাস্টিয়ান: তাহলে আমি আরও সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করি। আপনার সরকারের বিরুদ্ধে বিনা বিচারে আটক, নির্যাতন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করেছে জাতিসংঘ, এশিয়ার মানবাধিকার সংগঠনগুলো, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চারসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। আমি এই বিষয়ে জানতে চাইছি।
গওহর রিজভী: আচ্ছা, আমি এসব অভিযোগ পুরোপুরি মেনে নিতে পারলে নিতাম। আমি অস্বীকার করছি না যে গুমের কিছু ঘটনার দৃষ্টান্ত নেই। কিন্তু আপনি যখন নির্যাতনের কথা বলেন, আমার জানামতে এ ধরনের কোনো ঘটনার দালিলিক প্রমাণ নেই।
সেবাস্টিয়ান: দ্য ইউএন কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার কিন্তু নিশ্চিত যে নির্যাতনের ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে। সংগঠনটি একের পর এক নির্যাতনের ঘটনার কথা জানছে, যা আপনার নিরাপত্তা বাহিনী ঘটাচ্ছে, অথচ আপনি কি না আমাদের বিশ্বাস করতে বলছেন যে সেসব ঘটনা ভুল।
গওহর রিজভী: আমি এটা অস্বীকার করছি না ও এটাও বলছি না তারা ভুল জেনেছে। তবে আমি বলতে চাই, সরকার এটা জানে যে নির্যাতন অবৈধ ব্যাপার এবং নির্যাতনের ঘটনা যাতে না ঘটে, তা আমরা নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। মি. সেবাস্টিয়ান, আমি আপনার প্রশ্ন করার ধরন নিয়ে এ জন্য আপত্তি জানাচ্ছি যে বাংলাদেশে কিন্তু অনেক ভালো ব্যাপারও ঘটেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়নের এক চমৎকার উদাহরণ।
সেবাস্টিয়ান: হ্যাঁ, এবং আপনি উন্নয়নের কথা প্রচারে বেশ সফল, যেমন আপনার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং এটা হয়েছে। কিন্তু আমি আপনার কাছে সে কথা জানতে চাইছি না। আমি আপনার কাছে সেসব বিষয়ে জানতে চাইছি, যা আপনার দেশকে ভুল দিকে যাচ্ছে। যেমন আপনার সরকার দুর্নীতিতে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেছে। তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান দেশটিতে দুর্নীতির মাত্রার কথা জানাতে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, সরকার শুধু চুনোপুঁটিদের ধরছে। তিনি বলেছেন, ‘শীর্ষ পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কার্যকলাপ আমাদের ধারণারও বাইরে। আমরা সেই রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে কোনো জোরালো তদন্ত বা কার্যকর আইনি পদক্ষেপ দেখতে পাই না।’ সুতরাং ‘জিরো টলারেন্স’ ব্যাপারটি শুধু প্রতিশ্রুতিই বলে বেশি মনে হচ্ছে।
গওহর রিজভী: ঠিক আছে, আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, ৬ থেকে ৯ মাস আগে বিভিন্ন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাঁদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের তদন্ত চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টির তদন্ত করছে। দিন শেষে আমাদের একটি বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে এবং এটা একটা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। আমি বলছি না, আমাদের এই প্রক্রিয়া একেবারে নিখুঁত। আমি এটাও বলছি না যে মাঝেমধ্যে এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয়াদি বিবেচনায় আনা হয় না। এসব বিষয় সত্য। তবে আমার আপত্তির জায়গাটা হচ্ছে, মি. সেবাস্টিয়ান, আপনি একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক। কিন্তু যে ছবিটি আপনি আঁকছেন, সেটা একপক্ষীয়, যা আপনার দর্শককে ভুল বার্তা দিতে পারে।
সেবাস্টিয়ান: আসলে ছবিটা আমি আঁকছি না। আমি হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, দ্য কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ সংগঠনের বিভিন্ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এসব কথা বলছি।
গওহর রিজভী: সে ক্ষেত্রে ছবিটিতে ভারসাম্য আনতে দয়া করে আমাকেও বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরার সুযোগ দিন।
সেবাস্টিয়ান: হ্যাঁ, আপনি সেটা করছেন। তবে এসব ব্যাপারই কিন্তু প্রভাবশালীদের নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরির পথ করে দিয়েছে, যা এ মাসে আল-জাজিরা প্রকাশ করেছে। সেখানে আপনার দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বিস্মিত হওয়ার মতো দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। আর আপনার সরকারের ত্বরিত প্রতিক্রিয়ায় ওই তথ্যচিত্রকে মিথ্যা, মানহানিকর ও অপপ্রচার বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আপনারা প্রথমে তদন্ত করার কথা ভাবেনওনি। এটা একটি সৎ সরকারের প্রতিক্রিয়া নয়, তাই কি?
গওহর রিজভী: তদন্ত চলছে। তদন্ত করা হচ্ছে, তবে আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে চাই যে তথ্যচিত্রের শিরোনাম ছিল ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’। আর আমাদের বলা হলো যে এতে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে হওয়া দুর্নীতি প্রকাশ করা হবে। আপনি কি আসলেই বিশ্বাস করেন, তথ্যচিত্রটি তা করতে সফল হয়েছে? সেখানে কি এমন কোনো প্রমাণ দেখানো হয়েছে যেটা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে? সে কারণে আমি মনে করি, সচেতন একাডেমিক ও সাংবাদিক হিসেবে পেছনে ফিরে তাকিয়ে নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর জড়িত থাকার কী প্রমাণ দেওয়া হয়েছে? তারপরও এই পুরো তথ্যচিত্রে শাসনব্যবস্থা কত দুর্নীতিগ্রস্ত, তা দেখানো হয়েছে বলে বলা হচ্ছে।
সেবাস্টিয়ান: আল-জাজিরায় প্রচারিত তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে, টেলিভিশনের একটা দল হত্যার দায়ে অভিযুক্ত দুজন শীর্ষস্থানীয় পলাতক আসামির অবস্থান শনাক্তে সমর্থ হয়েছে, যাঁদের বড় ভাই আপনাদের সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। মনে হচ্ছে, আপনাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পালিয়ে থাকা ওই ভাইদের খুঁজে পায়নি, কিন্তু তারা পেয়েছে। এটা আপনাদের জন্য দারুণ অস্বস্তির, তাই নয় কি?
গওহর রিজভী: অবশ্যই। কিন্তু অন্যদিকে আবার বলছি, আমি সবকিছু ডিফেন্ড করতে যাব না। কিন্তু আপনি যেভাবে প্রশ্ন করছেন, আমার মনে হচ্ছে এটা (ডিফেন্ড করা) জরুরি। একজন মানুষকে কি তার ভাইয়ের অপরাধ দিয়ে বিচার করা উচিত? আমার মনে হয়, এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে হবে। এখন সেনাবাহিনীতে থাকা ভাইটি যদি তাঁর ভাইদের বিচার এড়াতে সাহায্য করে থাকেন, তাহলে এই অভিযোগ খুব, খুবই বৈধ হবে। যা ঘটেছে, তা এই ভদ্রলোকের সেনাপ্রধান হওয়ার অনেক আগে হয়েছে।
সেবাস্টিয়ান: ঠিক আছে, তথ্যচিত্রে জেনারেল আহমেদের ভাইদের ব্যাপারে বিস্তারিত যা দেখানো হয়েছে, তা দেখুন। তাঁদের মধ্যে দুজন, আনিস ও হারিস, ১৯৯৬ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের এক সদস্যকে হত্যায় জড়িত বলে অভিযুক্ত। তাঁরা দুজনেই পালিয়ে গেছেন। আর তৃতীয় ভাই, জোসেফও অভিযুক্ত হয়েছিলেন এবং ১০ বছরের বেশি সময় ‘ডেথ রো’তে (কনডেমড সেল) ছিলেন, জাদুবলে তাঁর ভাই আজিজের সেনাপ্রধান হওয়ার কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পান। এটা কীভাবে হলো? এটাই কি বাংলাদেশে স্বাভাবিক যে সেখানে ঠান্ডা মাথায় রাস্তায় বিরোধীদের গুলি করে হত্যা করা অভিযুক্ত হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়? এটাই করেন আপনারা?
গওহর রিজভী: আপনি যে নিশ্চিত ভাব নিয়ে কথা বলছেন, তা অনেকভাবেই আমাকে অবাক করছে এবং আপনি সেনাপ্রধান নিয়োগের সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের মুক্তিকে একসঙ্গে জড়াচ্ছেন। আপনাকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, এটা একটা স্টোরি। না, না, না, না, মি. সেবাস্টিয়ান…।
সেবাস্টিয়ান: আমার পয়েন্ট হচ্ছে, ঠান্ডা মাথায় করা হত্যার জন্য ক্ষমা পেতে আপনার ভালো যোগাযোগ থাকতে হবে, তাই না?
গওহর রিজভী: আমাকে আসল তথ্যটা দিতে দিন। তারপর আপনি সিদ্ধান্তে আসুন, প্লিজ। যে ভাইকে নিয়ে কথা হচ্ছে, তিনি প্রায় ২০ বছর জেলে ছিলেন। আমাদের দেশে একটা আইন আছে, একটা নির্দিষ্ট সময় জেলে কাটানোর পর আপনাকে প্যারোলে মুক্তি কিংবা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা দেওয়া যেতে পারে। এসব কিছু অনেক আগে ঘটেছে, অনেক মাস আগে। এমনকি সেনাবাহিনীর শূন্য পদ, যেটাতে তাঁর ভাই নিয়োগ পেয়েছেন, সেটা তৈরি হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ঘটেছে। এই লোকটি ৩৫ বছরের বেশি সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করেছেন একেবারে ক্লিন রেকর্ড নিয়ে। তাহলে কেন আমরা এ দুইটা স্টোরি একসঙ্গে যুক্ত করব ও কুৎসা রটাব? আপনাকে সময়ের দিকে খেয়াল করার জন্য অনুরোধ করছি। আপনাকে দুইটা ঘটনার টাইমলাইন (ঘটনাক্রম) খেয়াল করার অনুরোধ করছি। দুটি ঘটনার মধ্যে ৬ মাসের পার্থক্য।
সেবাস্টিয়ান: ঠিক আছে। কথা হচ্ছে, তথ্যচিত্রে এটাও দেখানো হয়েছে যে আপনাদের সেনাপ্রধান খুব ভালোভাবে জানতেন তাঁর দুই ভাই কোথায় ছিলেন, যাঁরা পালিয়ে ছিলেন। স্পষ্টই মনে হচ্ছে, তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা জানাননি। এটা কি তদন্ত করার মতো নয়?
গওহর রিজভী: এটা তদন্ত করার মতো হতে পারত। কিন্তু আমি যা জানি আপনিও তা-ই জানেন, এই দুই ভদ্রলোকই বাংলাদেশের আওতার বাইরে ছিলেন। তারপরও আমাদের কাছে যদি তাঁদের তথ্য থাকত, তবে সংশ্লিষ্ট দুই দেশের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলে তাঁদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতাম। আসলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তা করেছি এবং এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে আমরা তা করতাম না। আর আপনি খুবই সত্য যে যদি সরকারের কাছে এ তথ্য থাকত, তবে সরকার ব্যবস্থা নিত।
সেবাস্টিয়ান: আসলে, এগুলো ক্ষমতার ওপরের স্তরের অত্যন্ত কাছের ব্যাপার, যা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এটা কি বাস্তব নয় যে আপনার দেশে কেউই উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতির বিষয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। চায় কি? অনেক বেশি মানুষ গুম হয়ে যায় এবং যদি তারা ভুল কিছু বলে ও ভুল প্রশ্ন করে (তবে) একপর্যায়ে প্রাণ হারায়, তাই না? এটা আপনার দেশের একটা বাস্তবতা।
গওহর রিজভী: না, না, না। কিছু বিষয়ে আমাদের ঘাটতি থাকলেও আমরা গর্বিত। কেননা, আমাদের মুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে, যেটা নিয়ে আমরা গর্বিত। আমরা গর্বিত যে আমাদের একজন প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন, যিনি দুর্নীতি বরদাশত করেন না। আমাদের সামরিক বাহিনী বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই এটা বলা সংগত নয় যে দুর্নীতির সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের যোগসূত্র আছে।
সেবাস্টিয়ান: তাহলে এটা কীভাবে সম্ভব, যে দেশে একটি কার্যকর বিচারব্যবস্থা রয়েছে, সে দেশে আপনার সেনাপ্রধানের দুই পলাতক ভাই, আনিস ও হারিস—যাঁরা খুনের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত, ২০১৯ সালে ঢাকায় গিয়ে প্রকাশ্যে একটি পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন? এ রকম নিশ্চয়ই অনেক পলাতক খুনি নেই, যারা ক্ষমতাবানদের কোনোরকম ছত্রচ্ছায়া ছাড়াই উচ্চপর্যায়ের এক বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারে এবং সেখানে রাষ্ট্রপতি ও বিদেশি বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারে। আপনিও নিশ্চয়ই আমার মতো বিষয়টি জানেন।
গওহর রিজভী: আপনি একেবারে ঠিক। যদি এটা কেউ বুঝতে পারত যে এই ভদ্রলোকেরা বাংলাদেশে ফিরেছেন, তবে দ্রুত তাঁদের গ্রেপ্তার করা হতো। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন করারই সুযোগ নেই।
সেবাস্টিয়ান: কিন্তু তাঁদের বিয়েতে যোগ দেওয়ার ছবি রয়েছে। তাঁদের ছবি তোলা হয়েছিল।
গওহর রিজভী: আমাকে… (বলতে দিন), আমি (বলছি)।
সেবাস্টিয়ান: সেটা ছিল একটি সেনা ক্লাবে। দুজন দণ্ডিত খুনি, যাঁরা কিনা পাত্রের চাচা, অন্য সবার সঙ্গে বিয়ের উৎসবে অংশ নিয়েছেন।
গওহর রিজভী: আমরা এমন একটি ঘটনার কথা বলছি, যা ২৫ বছরের বেশি সময় আগে ঘটেছিল। এই দুই ভাই ১৯৯৬ সালে অপরাধ করেছিল। সেটা জেনারেল আজিজ ক্যাডেট হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ারও অনেক আগের ঘটনা। এখন আমরা ২৫ বছর পরের ঘটনায় ফিরে আসি। আমরা বলছি যে এ দুজন বাংলাদেশে ফিরে এসেছে এবং তারা যদি সেটা করে থাকে, মানে ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে, তবে সেটা আমাদের বিচার প্রশাসন ও ইমিগ্রেশন পুলিশের একটি বড় ব্যর্থতা—এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আপনার এটাও বুঝতে হবে, এই ব্যক্তিরা ভিন্ন নামের পাসপোর্ট জোগাড় করেছেন। সরকারের যদি সেটা জানা না থাকে এবং তাঁরা যদি নজরদারির তালিকায় না থাকেন, তবে তাঁরা অন্য হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে ঢুকতে বা বের হতে পারেন। আমি একবারও বলছি না, এটা সরকারের ব্যর্থতা নয়।
সেবাস্টিয়ান: ঠিক আছে, মুক্ত গণমাধ্যমসহ যে গণতন্ত্র বাংলাদেশে রয়েছে বলে আপনি দাবি করেছেন, তা সত্যি হলে আল-জাজিরার এসব অভিযোগ দেশটির পত্রিকা ও টিভিতে প্রচারিত হতো। কিন্তু সেটা হয়নি, হয়েছে? ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকা এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছে ‘আমাদের নীরবতার কারণ’ শিরোনামে। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি ও মানহানি আইন এই বিতর্ক নিয়ে অর্থবহ মন্তব্য করা থেকে বাংলাদেশের সব গণমাধ্যমকে দূরে রেখেছে।’ এটাই বাস্তবতা, তাই না? আপনি চাপ প্রয়োগ করে গণমাধ্যমকে নতিস্বীকার করতে ও চুপ থাকতে বাধ্য করেছেন। ফলে এটি এখন নিজের ছায়া দেখেই ভয় পাচ্ছে। আপনি কি এ জন্য গর্বিত?
গওহর রিজভী: আপনি যা বলেছেন তা যদি সত্যি হতো, তবে আমি লজ্জিত হতাম। আপনি বরং আমাকে সত্যিটা বলতে দিন।
সেবাস্টিয়ান: আপনি কি বলতে চাইছেন এই পত্রিকা মিথ্যা বলছে? আপনি কি বলতে চাইছেন পত্রিকাগুলো মিথ্যা বলছে?
গওহর রিজভী: আমাকে শুধু হ্যাঁ বা না উত্তর দিতে বলবেন না। আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন। এটা ঠিক যে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ বলে একটা ব্যাপার রয়েছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সহিংসতা, গুজব ছড়ানো ও জনগণকে উসকানি দেওয়া থেকে বিরত রাখতে করা হয়েছে এটি। তবে আইনটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, যেটি তথ্যপ্রযুক্তি আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) নামে ১৯৯৬ সালে পাস হয়েছিল। আমাদের সরকার সেটি সংশোধন করেছে এবং বর্তমানে এটির নাম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। দুঃখজনক হচ্ছে, আমরা এখন জেনেছি যে আইনটির কিছু শব্দচয়ন দুর্বল ও অস্পষ্ট হয়েছে, যার অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ জন্য এটা বলা (ঠিক নয়), গণমাধ্যমকে বাক্রুদ্ধ করা হয়েছে, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই…। আপনাকে জানানো উচিত, শুধু ঢাকা থেকে প্রতিদিন ৬০টির বেশি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।
সেবাস্টিয়ান: আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে এই আইনের আওতায় ৮ শতাধিক মামলা হয়েছে, যেখানে অনেক সম্পাদক ও সাংবাদিককে টার্গেট করা হয়েছে। এমন এক আইনের আওতায় ৮০০ মামলা হয়েছে, যা আপনার সরকার দৃশ্যত উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। মনে হচ্ছে, আপনার সরকারের এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জড়তা নেই, তাই না? আপনার আইনটি যে সমালোচকদের মুখবন্ধ করার ও বিরুদ্ধমত দমনের একটি অস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়, তা কি এখন স্বীকার করা উচিত নয়? এটাই তো সত্যি, তাই না?
গওহর রিজভী: না। আমি আপনার সমালোচনা মেনে নিতাম ও আপনার অভিযোগও মেনে নিতাম, যদি আপনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জিজ্ঞাসা করতেন যে এই ৮০০ মামলার কয়টি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে? আপনি ৮০০ বলে একটি সামগ্রিক সংখ্যা বলেছেন। আমরা যখন কোনো সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হই, আমাদের সেটার বিরুদ্ধে লড়তে হয়, কঠিনভাবে লড়তে হয়। সেই ৮ শর মধ্যে কতজন সন্ত্রাসী? সেই ৮ শর মধ্যে কতজন অপরাধী রয়েছে, যারা সহিংস কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত? কোনোরকম বাছবিচার ছাড়াই আমাকে সংখ্যাটি বলেছেন। আপনাকে দয়া করে সংখ্যাগুলোর দিকে আবারও তাকাতে চ্যালেঞ্জ করছি। আমাকে বলুন, তাঁদের মধ্যে আসলে সাংবাদিক কয়জন?
সেবাস্টিয়ান: তাহলে আমি আরও কিছু সংখ্যা আলাদা করে বলতে পারি। কেননা মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিশেষত করোনাকালে বাক্স্বাধীনতার ওপর আপনার সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, করোনা সংকট সমাধানে আপনার সরকারের উদ্যোগের বা ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করায় সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদ ও অ্যাকটিভিস্টদের আপনারা গ্রেপ্তার করেছেন। এমনকি গত জুনে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মানহানি করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছেন আপনারা। তাকে শাস্তি হিসেবে কিশোর সংশোধনাগারে রাখা হয়েছিল।
গওহর রিজভী: ঠিক আছে। তবে এবার আমাকে যতটা সম্ভব পরিষ্কার উত্তর দিতে দিন। আপনি আপনার দর্শকদের বলতে চাইছেন যে করোনাকালে সরকার নানা ধরনের ভয়াবহ কাজ করেছে। আপনি কি আপনার দর্শকদের বলেছেন যে বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের একটি, যেটি আপনার নিজের দেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের চেয়ে ভালোভাবে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পেরেছে? আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুর হার বিশ্বের মধ্যে অন্যতম কম। আমাদের দেশে আরোগ্যলাভের হার সবচেয়ে বেশি। আমরা চিকিৎসা দিতে আমাদের হাসপাতালের পরিধি বাড়িয়েছি। এসব কাজের উল্লেখ কোথাও নেই। আপনি ১৫টি উদাহরণ দিয়েছেন। আরও…।
সেবাস্টিয়ান: আমি নিশ্চিত আপনি আলোচনার বিষয় বদলাতে চাইছেন। আমি জানি, আপনি আপনার সরকারের ভালো দিক বলতে চাইছেন। কেননা আপনাকে এ জন্য বেতন দেওয়া হয়। আর এ জন্যই আপনি সরকারের একজন উপদেষ্টা।
গওহর রিজভী: না, না, না।
সেবাস্টিয়ান: কিন্তু আপনি কেন ‘ইউএন কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার’-এর উল্লেখিত বিস্তৃত এবং নিয়মিত নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতাসংক্রান্ত প্রতিবেদনের দিকে নজর দিচ্ছেন না? আপনি নির্যাতনকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালে একটি আইন পাস করেছেন। কিন্তু গত ছয় বছরে এই আইনের আওতায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে মাত্র ১৭টি এবং সেগুলোর কোনোটিরই বিচার শেষ হয়নি। এটা কি একটি সরকারের জন্য গর্ব করার মতো অর্জন, যে কিনা নির্যাতন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে বলে বলছে? তা নয়, তাই না?
গওহর রিজভী: আসলে আমাকে আবারও বলতে দিন, আপনি ঠিক এই অর্থে যে গত কয়েক বছরে নির্যাতন নিয়ে এই কয়টি মামলা হয়েছে; কিন্তু কোনোটিরই বিচার এখনো শেষ হয়নি। আমি যদি আপনার বক্তব্য সত্য ধরে নিই, তবে আমার এটা মেনে নিতে হবে যে এটা খুব ভালো কোনো রেকর্ড নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা একটা আইন সত্যি পাস করতে পেরেছি। সত্যি কথা হচ্ছে, আমরা বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করছি। আমি যেখানে বারবার আপত্তি জানাচ্ছি সেটা হলো, এ জন্য নয় যে যেমনটা আপনি মনে করছেন, আমাকে এমনটা করতে বেতন দেওয়া হয়। একই কথা আপনাকেও বলতে পারি আমি। এটা কি ঠিক নয় যে আমাকে বারবার বিষয়টিকে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে (কনটেক্সট) বিবেচনা না করে আক্রমণ করতে আপনাকে বেতন দেওয়া হচ্ছে? এখন পর্যন্ত আপনি আমাকে যত প্রশ্ন করেছেন, সবই নেতিবাচক মাত্রা নিয়েছে, এমনকি মহামারিবিষয়ক প্রশ্নও। আপনি খুব পরিষ্কারভাবে বলছেন, এসব ভয়ানক ব্যাপার ঘটেছে। আপনি আমাকে আরেকটি দেশের নাম বলুন যে আমাদের সরকারের মতো কার্যকরভাবে মহামারি মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে।
সেবাস্টিয়ান: ড. রিজভী, আলোচনার বিষয় বদলানোর খুব ভালো কৌশল এটি। তবে আমি এই আলোচনা শুধু এ জন্য ছাড়তে রাজি নই যে আপনি বলেছেন আপনার সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে উদ্যোগ নিচ্ছে। সরকার কি আপনার তথাকথিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? কেননা জাতিসংঘ বলছে, এই বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে নির্যাতন, নির্বিচার গ্রেপ্তার, ঘোষণা না দিয়ে আটকে রাখা, নিজ হেফাজতে থাকা অবস্থায় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। আপনি আমাকে আপনার দেশ যা ভালো কিছু করেছে সেই কথা বলছেন। কিন্তু র্যাব আপনার সরকারের নামে যা করছে, তা নিয়ে আপনি কি বিব্রত নন? আপনার সরকার সবকিছু ধ্বংস করছে।
গওহর রিজভী: আমাকে সততা, নম্রতা ও বিব্রতবোধ থেকে বলতে হচ্ছে, আপনি যেসব ঘটনার কথা বললেন তার কিছু সত্য। কিছু ঘটনা রয়েছে যা সরকারের মধ্যকার কেউই ডিফেন্ড করতে চাইবে না, কিন্তু…।
সেবাস্টিয়ান: প্রশ্ন এটা নয় যে তারা তাদের ডিফেন্ড করবে, নাকি করবে না, প্রশ্ন হচ্ছে, দায়িত্বটা কার?
গওহর রিজভী: মি. সেবাস্টিয়ান, আমাকে শেষ করতে দিন। আপনি আমাকে একটি প্রশ্ন করেছেন। সেটার উত্তর দিতে দিন। আপনি আপনার প্রশ্নে যেটা বলেননি তা হচ্ছে, র্যাবের কতজন সদস্যকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে? তাঁদের মধ্যে কতজনের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে ও কতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে? আপনি এগুলো উল্লেখ করেননি। এটা একটা সরকারের দায়িত্ব যে যখন এটি দেখতে পায় কোনো কারণে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হচ্ছে বা আইনের ব্যত্যয় ঘটছে, তখন সেই কারণ অনুসন্ধান করা। আমি মনে করি না, তারা সব সময় সফল হয়। তবে আমি বিরক্ত হই যখন তারা যে চেষ্টা করছে সেটার স্বীকৃতি দেওয়া না হয়।
সেবাস্টিয়ান: ঠিক আছে, ড. গওহর রিজভী, আপনাকে কনফ্লিক্ট জোনে পেয়ে ভালো লাগল। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
গওহর রিজভী: ধন্যবাদ, মি. সেবাস্টিয়ান। আপনার সঙ্গে কথা বলাটা আনন্দের ব্যাপার ও একটা অভিজ্ঞতাও বটে।
অনুবাদ: আবু হুরাইরাহ্