দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। তিনি থাকছেন যুক্তরাজ্যে। তাঁর দেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। দল ও জোটের মধ্যে আছে টানাপোড়েন। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও প্রায়ই সামনে চলে আসছে। দেশে দলের যাঁরা নেতৃত্বে আছেন, তাঁদের দক্ষতা-যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এর মধ্যেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে গিয়ে শোচনীয় পরাজয় এবং সংসদ অবৈধ আখ্যা দিয়ে আবার সেই সংসদে যোগ দেওয়া বিএনপিকে আরও কোণঠাসা করে ফেলেছে। কোনো ইস্যুতেই মাঠে জোরদার আন্দোলন করতে না পারা দলটির নেতারা সামনে কোনো ‘সুদিন’ দেখতে পাচ্ছেন না।
বিএনপি ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ক্ষমতার বাইরে। অর্থাৎ প্রায় ১৩ বছর তারা ক্ষমতার বাইরে। দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবারের কেউই দেশে বসে এখন দলটি পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। তা ছাড়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে বাধা আছে। ফলে দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কাছে বর্তমান প্রধানের কোনো বার্তা সরাসরি পোঁছানোর সুযোগ নেই।
বিএনপির রাজনীতি সভা–সেমিনারে সীমাবদ্ধ। দলের কাউন্সিল করার সময় পার হয়ে গেলেও তা কবে হবে, সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছে না। তবে ১৪ সেপ্টেম্বর দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের কাউন্সিল হচ্ছে। সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ২৭ বছর পর সংগঠনটির কাউন্সিল হতে যাচ্ছে, যা দল ও সহযোগী সংগঠনটির মধ্যে একধরনের আলোড়ন তুলেছে।
বিএনপি মনে করছে, একটা ‘বড়’ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে দলে যে সমস্যা, তা বহুলাংশেই কেটে যাবে। তবে বিএনপির নেতারা যা–ই ভাবুন না কেন, দলটির কোনো কর্মকাণ্ডকে পাত্তা দিচ্ছেন না ক্ষমতাসীনেরা। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হতে যাচ্ছে। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বিএনপি ও এর শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি এখন কঠিন সংকটের মধ্যে আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাঁরা এ-ও বলছেন, সময় খারাপ হলেও এই পরিস্থিতি বেশি দিন থাকবে না। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে পরিস্থিতির পরিবর্তন আনবে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, সময় লাগলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন আসবে। কেননা, বিএনপির বিপুল জনসমর্থন রয়েছে মাঠপর্যায়ে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি একটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—এটা সত্য। ক্ষমতাসীনেরা যেভাবে বিএনপির ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, তাতে দলটি এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। তা ছাড়া দলীয় চেয়ারপারসন জেলে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে। এটাও পরিস্থিতিকে খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। বিএনপির এই নেতা বলেন, গত ১৩ বছরে দলের ওপর অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে। কিন্তু তারপরও দলে ভাঙন হয়নি। দল ঐক্যবদ্ধ আছে। তা ছাড়া বিএনপি আগের জোট অব্যাহত রেখে নতুন জোট (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) করেছে। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে যেভাবে হারানো হয়েছে, সেটাকে তো কেউই ভালোভাবে নেয়নি। ফলে, দেশের বেশির ভাগ মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারবে না। পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।
বিএনপির বর্তমান অবস্থার বিষয়ে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি খারাপ সময় পার করছে, এটি সত্য। তবে এই সময় বেশি দিন থাকবে না। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে বিএনপি পরিবর্তন আনবে।
অবশ্য খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য বড় ধরনের কোনো আন্দোলন করতে না পারার কথা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি একে দুর্ভাগ্য বলে উল্লেখ করেছেন।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন, তাঁদের দলের নেতৃত্বে যেকোনো একটি বা একাধিক ইস্যুতে একটি ‘বড়’ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। ক্ষমতাসীন ও সাধারণ জনগণ তখন বিএনপির সামর্থ্য, শক্তি সম্পর্কে ধারণা পাবে। কিন্তু ‘বিপুল’ জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও দলটির নেতৃত্বে আন্দোলন না হওয়ায় দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিএনপি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন পায়। কিন্তু এ দুটি আন্দোলনের কোনোটিরই ‘কৃতিত্ব’ বিএনপি নিতে পারেননি। আন্দোলনের সামনের সারিতেও দলটি উপস্থিতি ছিল না। বরং হামলা ও মামলার ‘ভয়ে’ বিএনপি এখন সতর্কভাবে পথ চলছে। ফলে, সাধারণ মানুষ বিএনপির উপস্থিতি টের পাচ্ছে না।
বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী বলে পরিচিত গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপির বড় ধরনের আন্দোলনে ডাক দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটা না হওয়ায় বিএনপি ও তার জোটকে ক্ষমতাহীন, সামর্থ্যহীন বলে রাজনীতিতে মনে করা হচ্ছে, যা দলটিকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার দিকে নিয়ে গেছে।
এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বিএনপি দুই দিনের কর্মসূচি পালন করবে। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালন করবে। দলটির নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, কর্মসূচি সাদামাটা। এ ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে তৃণমূলে বা সাধারণ মানুষের কাছে তেমন কোনো বার্তা যাবে বলে মনে হয় না। এসব কর্মসূচিতে বিএনপির কারাবন্দী চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান আসবে বলে তাঁরা জানান।
বিএনপির একটি সূত্র বলছে, টানা ১৩ বছর দল ক্ষমতায় না থাকার কারণে নেতা-কর্মীরা হতাশ। দলের চেয়ারপারসনের কারাবাস নেতা-কর্মীদের হতাশা আরও বাড়িয়েছে। এ অবস্থায় করণীয় কী, তার সমাধান বের করতে দলের নীতিনির্ধারকেরা প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার বসছেন। কিন্তু কোনো সমাধান আসছে না। সবদিক থেকে সরকার এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে যে কোনোভাবেই কোনো কিছু করা যাচ্ছে না। ওই সূত্র বলছে, আন্দোলন ছাড়া বিকল্প কিছু বিএনপির সামনে নেই। এখন আর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করব বলার কোনো মানে হয় না।
ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, বিএনপি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পারলে দলটির জন্য ভালো তো বটেই, দেশের জন্যও ভালো। তবে এই সময়টা কবে আসবে, বলা কঠিন। আগামী এক-দেড় মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে রাজনীতিতে পরিবর্তন আসার পাশাপাশি বিএনপির খারাপ অবস্থানেরও পরিবর্তন আসতে পারে।