এই নিষেধাজ্ঞা বস্তুত সরকারের ওপর: আমীর খসরু

সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের মার্কিন ভিসা বাতিল এবং এলিট ফোর্স র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর দেশটির নিষেধাজ্ঞা কার্যত বাংলাদেশ সরকারের ওপর বলে মনে করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, যারা জোর করে ক্ষমতায় থাকতে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করেছে, এই নিষেধাজ্ঞার জন্য তারাই দায়ী।

বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান। সাবেক সেনাপ্রধানসহ র‍্যাব কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, দেশের রাজনীতি ও আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব, চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়াসহ আরও কিছু বিষয়ে আজ সোমবার দুপুরে বনানীতে তাঁর কার্যালয়ে কথা বলেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক সেলিম জাহিদ।
প্রশ্ন

র‍্যাবের সাবেক ডিজিসহ সাবেক–বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং সাবেক সেনাপ্রধানের ভিসা বাতিলের বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে বিএনপি?

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী: কেবল ক্ষমতায় থাকার জন্য রাষ্ট্রের কর্মচারীদের ব্যবহার করার রীতি তো একটা দেশ, একটা সরকারের, একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলতে পারে না। এর ফল ভালো হয় না। এই যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সরকার তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে, এটা দেশবাসী আগে থেকে জানে। এখন তা বিশ্ববাসীর সামনে গেছে—এটাই আমাদের জন্য লজ্জার। যারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায়, তারাই এর জন্য দায়ী।

প্রশ্ন

এর পরিণতি কী হতে পারে?

আমীর খসরু মাহমুদ: বিষয়টি হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়াকে এক সারিতে দাঁড় করানো হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কোনো গণতন্ত্র নেই, আইনের শাসন নেই। আর এসব যে নেই, তা দেশের মানুষ ভালো করেই জানে। কারণ, মানুষ তো ভুক্তভোগী। এর শেষ পরিণতি কী হবে, তা যারা দেশকে ওই জায়গায় নিয়ে গেছে, তারাই ভালো জানে।

প্রশ্ন

কেউ কেউ বলছেন, এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন রয়েছে।

আমীর খসরু মাহমুদ: শুধু তো এটার (মার্কিন নিষেধাজ্ঞা) বেলায় না, সবকিছুর বেলাতেই তো তারা এ (বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ততা) কথা বলে। যখনই সরকার কোনো রকমের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়, জবাবদিহির সম্মুখীন হয়, তখন তাদের এই একটাই উত্তর। তাদের আর কোনো উত্তর নেই এবং থাকবেও না। কারণ, অন্যায়কারীদের কাছে কোনো উত্তর থাকে না অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো ছাড়া।
কথা হচ্ছে, তারা নিজেদের দোষ অন্যের ওপর চাপায় কীভাবে? তারা ক্ষমতার জন্য, নিজেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-জিঘাংসা পূরণে রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে ব্যবহার করেনি? মুরাদ হাসানের (পদত্যাগী প্রতিমন্ত্রী) ফাঁস হওয়া ফোনালাপেই তো আছে কীভাবে তার নোংরা খায়েশ পূরণের জন্য পুলিশ, র‍্যাব, রাষ্ট্রীয় সংস্থার ভয় দেখানো হয়েছে।

প্রশ্ন

ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে, আগামী নির্বাচনে এসব ঘটনার কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন?

আমীর খসরু মাহমুদ: দেশে যখন মুক্ত নির্বাচন হয়, মানুষ ভোট দিতে পারে, তখন মানুষ সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই নিজের ভোট প্রয়োগ করে। বাংলাদেশকে আজ একটি অগণতান্ত্রিক দেশের কাতারে দাঁড় করানো হয়েছে, দেশের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হয়েছে, এটা দাগ কেটেছে মানুষের মনে। এ ঘটনা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে খুবই আঘাত করেছে।

প্রশ্ন

২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এসব ঘটনা কোনো ইঙ্গিত বহন করে কি?

আমীর খসরু মাহমুদ: যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে, এটা তারা বলতে পারবে। যারা ঘটনার শিকার, তারা তো বলতে পারবে না। যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে, এটা তাদের বুঝতে হবে এবং তাদের বুঝতে হবে তারা দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।

প্রশ্ন

আপনিই প্রথম বলেছিলেন, এবার বিএনপি নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা-সংলাপে যাবে না—এর হেতু কী?

আমীর খসরু মাহমুদ: সংলাপে তো আমরা গিয়েছি বিগত দিনে। আমরা নির্বাচনে গিয়েছি, সংলাপে গিয়েছি—সবকিছুতেই আমরা অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু নির্বাচনটা ভোটের দিনেও হতে পারেনি, আগের রাতেই করে ফেলেছে। সংলাপ-আলোচনা—সবকিছু বিফলে গেছে। বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তাই সংলাপ করে লাভটা কী? হ্যাঁ, সংলাপের সুযোগ থাকবে শুধু নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে। এর বাইরে তো সংলাপের কিছু নেইও।

প্রশ্ন

ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূতের একটি বক্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের কোনো যোগসূত্র আছে কি?

আমীর খসরু মাহমুদ: মোটেই না। এটা হচ্ছে যেহেতু বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রশ্নটি এখানে উঠে এসেছে, সেটার একটা প্রতিবাদ। কারণ, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার—এমন বেশ কিছু ন্যায্যতার প্রশ্নে। এগুলো যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, সেটা যে বা যারাই করবে, সেটার প্রতিবাদ আমরা করব। আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, প্রত্যক্ষ ভোটে বিশ্বাস করি, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, মানবাধিকারে বিশ্বাস করি—এসবের বিপরীতে যদি কোনো রকমের তথ্য কিংবা বক্তব্য আসে, সেটার প্রতিবাদ করা নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব।

প্রশ্ন

হঠাৎ চীনের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের ছন্দপতন হলো কেন?

আমীর খসরু মাহমুদ: এটা কারও সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় নয়, এটা একটা সুনির্দিষ্ট বক্তব্যের বিষয়। যখন কোনো বক্তব্য আমাদের বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চিন্তা-দর্শনের পরিপন্থী আসে—এটার প্রতিবাদ করতে হবে বাংলাদেশের সবাইকে। এখানে তো বিএনপির একক কোনো বিষয় নেই।

প্রশ্ন

এর মধ্য দিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্তিতে বাংলাদেশও কী পড়ে গেল?

আমীর খসরু মাহমুদ: আমার মনে হয় না। অন্তত বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা মনে করি, সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশের—এটা বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়—এটাই বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি এবং এটাই বিএনপি বিশ্বাস করে। আমরা এ ধারাতেই চলব।

প্রশ্ন

আপনার কী মনে হয় সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে?

আমীর খসরু মাহমুদ: আগেই বলেছি, বাংলাদেশে তো কোনো আইনের শাসন নেই। এখানে সিদ্ধান্ত যারা দেয়, তাদের সিদ্ধান্ত কী হবে, আমরা তো সেটা বলতে পারব না। যদি আইনের শাসন থাকত, বিচারব্যবস্থা নিরপেক্ষ থাকত, তাহলে তিনি (খালেদা জিয়া) তো একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে থাকার কথা আজ। তাঁকে জেলে নেওয়া হয়েছে অন্যায়ভাবে, সেটার তো কোনো প্রতিকার পাইনি আমরা। তাঁকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জোর করে জেলে নিয়ে, একটা পরিত্যক্ত ঘরে চিকিৎসা না দিয়ে এবং এখন চিকিৎসা করতে না দেওয়া—সবকিছুই তো দেশের সংবিধান, আইন, মানবতা ও শিষ্টাচার পরিপন্থী। সুতরাং যারা এ কাজগুলো করছে, তারা কী করবে, সেটা আমরা জানি না।

প্রশ্ন

এমন কথাও এসেছে যে কিছু শর্ত পূরণ না হওয়ার কারণে খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়াটা আটকে আছে। যেমন তাঁর পাসপোর্টে জন্ম তারিখ পরিবর্তন, আসলে কী?

আমীর খসরু মাহমুদ: এটা যাঁর জন্মতারিখ তিনি জানবেন। আমার জন্মতারিখ নিয়ে আরেকজনের গবেষণা করার তো কোনো প্রয়োজন নেই। যিনি দরখাস্ত দিয়েছেন, ওনার জন্মতারিখ কত, সেটা ওনারই তো জানার বিষয়। ওনার জন্মতারিখ নিয়ে তো অন্য লোকের পর্যালোচনা করার কোনো সুযোগ নেই।

প্রশ্ন

বিএনপি শুরু থেকেই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে ‘কালো আইন’ বলে এর বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু সদ্য পদত্যাগী তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় আপনার দলের নেতা-কর্মীরা এ আইনে মামলা করেছে। ব্যাপারটি সাংঘর্ষিক নয় কি?

আমীর খসরু মাহমুদ: জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন আইন তো দেশে চলছে। একটা আইন যদি অগ্রহণযোগ্যও হয়, আপনি তো সে আইনের আওতায়। একজন নাগরিক হিসেবে আপনাকে সেই আইন মানতে বাধ্য করা হচ্ছে। আইনটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কিন্তু আইনটা তারা অন্যায়ভাবে প্রয়োগ করছে। আমি তো সেই আইনের শিকার। তো আমাকে ওই আইনের বাইরে গিয়ে তো কিছু করার সুযোগ নেই। তবে আমাদের যখন সুযোগ থাকবে, তখন আমরা ওই আইন পরিবর্তন করব, এটা সত্য। এখন তো এ আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।