উত্তাপে পানি ঢেলে দিল আ.লীগ

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে শুধুই ‘অর্জন’ দেখছে আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করে, এই সংলাপের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তাপ সৃষ্টির চেষ্টায় ‘পানি’ ঢেলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখন অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে এই মনোভাব জানা গেছে।
নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য ছিল নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে যে কিছুটা অনিশ্চয়তা ও গুমোট ভাব ছিল, তা কাটিয়ে দেওয়া। আর বিরোধীদের দাবিদাওয়া কতটা সরকার বাস্তবায়ন করবে, সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া। এখন বিরোধী জোটের সামনে দুটি পথ খোলা—হয় তারা আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের পথে হাঁটবে, নয়তো সরকারের অবস্থান মেনে নিয়েই নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়বে। তবে বিরোধী দল আন্দোলনের পথে হাঁটবে বলে মনে হয় না। আর আন্দোলনের চেষ্টা করলে সরকার তা দমন করবে।

আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে, এটা জানাই ছিল। সংলাপে রাজি হয়ে সরকারি দল দেশে–বিদেশে এটা বোঝাতে চাইছে যে রাজনৈতিক সংকট অতটা প্রকট নয়; বরং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু উদ্বেগ আছে। এ জন্য আওয়ামী লীগ সভা–সমাবেশ করা, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, ক্ষেত্র বিশেষে রাজনৈতিক মামলার ব্যাপারে ছাড় দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। আর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে আওয়ামী লীগের খুব বেশি আগ্রহ এই নির্বাচনে নেই। ব্যাপকভিত্তিক ইভিএম ব্যবহারের জন্য নির্বাচন কমিশনেরও প্রস্তুতি নেই। ফলে বিরোধীদের ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি মেনে নেওয়া কঠিন কিছু ছিল না। আর এখনই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সাজা মওকুফ বা তাঁদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া যে সম্ভব নয়, তা বিএনপিও বোঝে। এ পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সংসদ ভাঙবে না, সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে দায়িত্ব না দেওয়া—এই তিন বিষয় ঠিক থাকলে আওয়ামী লীগের আর কিছু প্রয়োজন নেই।

ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা তাঁদের কোনো দাবির পক্ষেই অনড় বা দৃঢ় অবস্থান নেননি। তাঁদের পূর্বপ্রস্তুতিও ছিল বলে মনে হয় না। সমন্বয়েরও ঘাটতি দেখা গেছে। ঐক্যফ্রন্টের বড় একটা অংশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। তাঁরা বারবার শুধু এটা বোঝাতে চেয়েছেন যে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান কতটা ওপরে চলে যাবে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা নানা উপায়ে বিএনপির নেতাদের কৌশলে লক্ষ্যবস্তু বানান। ফলে তাঁরাও একপর্যায়ে কিছুটা হাল ছেড়ে দেন।
সংলাপে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা জানান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কারাগারে আছেন, বিএনপি শুধু মাঠে এই প্রচার করছে। কিন্তু সংলাপে তারেক রহমানের মামলার প্রসঙ্গ কেউ সেভাবে তোলেননি। খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়টিও তুলেছেন বিএনপির নেতারাই। বিএনপির কয়েকজন নেতা খালেদার জামিনের দাবির বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনেকটা অনুনয়ের সুরে উপস্থাপন করেন। ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শক্তি বিএনপি। কিন্তু সংলাপে দলটির এমন দুর্বল উপস্থাপনা আওয়ামী লীগের বড় অর্জন।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ড. কামাল হোসেন ছোট্ট পরিসরে আরও সংলাপ করার প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে রাজিও হন। ৮ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দলের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সংলাপ আছে। এর মধ্যে তফসিল ঘোষণা হয়ে যাবে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবারের সংলাপে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, এরপর সংলাপের বিষয়ে জোটের নেতারা কতটা একমত হতে পারবেন, এটা নিয়ে সন্দেহ আছে। সংলাপ আর না হওয়ার পেছনে যুক্তি হিসেবে ওই সূত্র বলছে, বৃহস্পতিবারের সংলাপে মাহমুদুর রহমান মান্না তফসিল পেছানোর দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তা নাকচ করে দিয়ে বলেন, এটি নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।
গতকাল শুক্রবার রাতে গণভবনে সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে বিকল্পধারা বাংলাদেশের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারি জোটের নেতারা। কাল রোববার জাতীয় পার্টি (জেপি) ও সোমবার এরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গে সংলাপ হবে। সংলাপ হবে আটটি বাম দলের জোট বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গেও।

গতকাল মুন্সিগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দীর্ঘদিনের দূরত্ব রাতারাতি ঘোচানো সম্ভব নয়। তবে কিছু বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে শুধু রাজনৈতিক কারণে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদের তালিকা পাঠাতে বলা হয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী সুষ্ঠু তদন্ত করা হবে। সংলাপে শুরুটা ভালো হয়েছে। এখানে ব্যর্থতার কিছু নেই।