ইসি গঠনে ঐকমত্য কতটা, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে

নির্বাচন কমিশন গঠনে যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির সঙ্গে গতকাল শনিবার সুপ্রিম কোর্টের কনফারেন্স কক্ষে বিশিষ্ট নাগরিকদের বৈঠক হয়। অনুসন্ধান কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যোগ্য ব্যক্তিদের নাম চাইলেও বিএনপিসহ ১৫টি দল তাতে সাড়া দেয়নি
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মূল কাজ হচ্ছে দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা। আর এ কাজে ইসির বড় অংশীজন রাজনৈতিক দল। এ জন্য ইসি গঠনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ করা একধরনের রীতিতে পরিণত হয়েছে। ইসি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোকে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে তাদের কাছ থেকে সম্ভাব্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্য কমিশনারদের নামের তালিকাও নিচ্ছে অনুসন্ধান কমিটি। তবে ২০১৭ সালের সঙ্গে তুলনা করলে এবার ইসি গঠনে রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ কমেছে। বিশেষ করে বিরোধী দলগুলো এবার রাষ্ট্রপতির সংলাপ এবং অনুসন্ধান কমিটিতে নাম দেওয়ার প্রক্রিয়া বর্জন করেছে।
বর্তমানে জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত ভোট হচ্ছে দলীয় প্রতীকে। অর্থাৎ এখন আর দলনিরপেক্ষ নির্বাচন খুব একটা হচ্ছে না। ফলে ভোটের আগে-পরের পরিবেশ নিয়ে ইসির প্রতিটি পদক্ষেপ রাজনৈতিক দলগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে। ভালো হলে বাহবা দেয়, খারাপ হলে সমালোচনা করে।

সারা বিশ্বেই ইসি গঠনে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার একটা চেষ্টা থাকে। এবার রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে সংলাপে অংশ নিয়ে বেশির ভাগ দল রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথা বলেছে। ইসি গঠনের আইন পাসের সময় সংসদে বিরোধী দলগুলো এবং বাইরে নাগরিক সমাজও একই পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু ইসি গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার কারণে সেই ঐকমত্য কতটা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো নতুন ইসিকে কতটা গ্রহণ করবে, ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা কীভাবে অর্জন করবে—এ আলোচনা আগামী দিনগুলোতে আরও জোর পাবে।

এবার নতুন আইনের ভিত্তিতে ইসি গঠন হচ্ছে। ২০১৭ সালে বর্তমান ইসি গঠনের সময় আইন ছিল না। এখন প্রশ্ন হলো আগেরবারের তুলনায় এবার প্রক্রিয়াগত বড় কোনো পার্থক্য এসেছে? এখন পর্যন্ত বড় পরিবর্তন দেখা যায়নি।

২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেন। এরপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। এতে সরকারি কর্মকর্তার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক ছিলেন। এবার আইন অনুসারে, ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি হয়েছে।

সরকারি কর্মকর্তার বাইরে দুজন ব্যক্তিত্ব আছেন। তাঁরা হলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন এবং সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নাম নিয়েছিল অনুসন্ধান কমিটি। এবারও তাই করেছে। এরপর নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিল। গতকাল শনিবার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে অনুসন্ধান কমিটি। আজ রোববারও হবে।

দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে ৩৯টি। এবার সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১০টি করে নাম চেয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। বিএনপিসহ ১৫টি দল নাম দেয়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, তাদের জোট ১৪ দলের শরিকেরা সবাই নাম দিয়েছে। এর বাইরে সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এমন দলের মধ্যে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) ও বিকল্পধারা বাংলাদেশ অনুসন্ধান কমিটিতে নাম দিয়েছে। মোট ২৪টি দল নাম জমা দিয়েছে। অর্থাৎ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৬১ দশমিক ৫৪ শতাংশ ইসি গঠনে অংশীদার হয়েছে।

অনুসন্ধান কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তারা জানিয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো ১৩৬ জনের নাম দিয়েছে। এর বাইরে পেশাজীবীদের কাছ থেকে ৪০ জনের, ব্যক্তিগতভাবে ৩৪ জনের এবং বিভিন্ন ই–মেইলের মাধ্যমে ৯৯ জনের নাম এসেছে। সব মিলিয়ে মোট ৩০৯ জনের নাম পেয়েছে অনুসন্ধান কমিটি।

অনুসন্ধান কমিটিতে নাম দেওয়া কয়েকটি দলের নেতারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ১০টি নাম দেওয়ার মতো লোক তাঁরা খুঁজে পাননি। আর নিজেদের পছন্দের নাম দিলেই যে সেই নাম চূড়ান্ত তালিকায় থাকবে, তা আশা করাও কঠিন। এ জন্য ক্ষমতাসীন দল বা সমমনা দলগুলো যেসব নাম দিয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে মিল রেখে যতগুলো পারা গেছে, নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁরা।

২০১৭ সালে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আগে ইসি গঠনে ৩১টি রাজনৈতিক দলকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং বিরোধী দল বিএনপিসহ সব দলই সংলাপে অংশ নিয়েছিল। সংলাপ শেষে যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়, সেই কমিটিও রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর কাছে পাঁচটি করে নাম চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ ২৬টি দল তাদের নামের তালিকা জমা দিয়েছিল। এর মধ্যে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের নিবন্ধিত সাতটি দলই নাম জমা দিয়েছিল। ২০১৭ সালে ৮৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ রাজনৈতিক দল অনুসন্ধান কমিটিকে নাম দিয়ে ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছিল। অর্থাৎ, আগেরবারের চেয়ে এবার রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ কমেছে ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

২০১৭ সালে দুই দিনব্যাপী ১৬ জন বিশিষ্ট নাগরিকের মতামত নেয় অনুসন্ধান কমিটি। তবে রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে কোনো নাম সংগ্রহ করেনি। সবগুলো দলের কাছ থেকে সব মিলিয়ে ১২৮টি নাম পাওয়া গিয়েছিল। সেখান থেকে অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নামের তালিকা পাঠিয়েছিল। সে হিসেবে এবার ১৮১টি নাম বেশি জমা পড়েছে।

এবার ইসি গঠনে গত ২০ ডিসেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। প্রথম দিন অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। ২০১৭ সালে প্রথম দিন অংশ নিয়েছিল বিএনপি। এবার ৩২টি দলকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

কিন্তু অংশ নেয় ২৫টি দল। বিএনপিসহ সাতটি দল সংলাপে অংশ নেয়নি। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপেও ২০১৭ সালের চেয়ে কম রাজনৈতিক দল সাড়া দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ এবং অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠনের ধারা শুরু হয়েছে ২০১২ সালে। প্রথমবার অনুসন্ধান কমিটি তাদের চূড়ান্ত করা ১০ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে দিয়েছিল। ২০১৭ সালে অনুসন্ধান কমিটির কাছে একই দাবি করেছিলেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। কিন্তু সর্বশেষ অনুসন্ধান কমিটি তাদের প্রস্তাব করা নামের তালিকা প্রকাশ করেনি। এবারও অনুসন্ধান কমিটির করা নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়ার আগে প্রকাশ করার দাবি উঠেছে। শেষ পর্যন্ত কমিটি তা প্রকাশ করে কি না তা দেখার অপেক্ষায় থাকা যায়।