নির্বাচন কমিশন

ইসির সংলাপ আজ শুরু, সংশয় থাকছেই

প্রথম দিন সংলাপ হবে শিক্ষাবিদদের সঙ্গে। কেউ কেউ যাচ্ছেন না। তাঁরা বলছেন, আগের সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি।

  • আজকের সংলাপে অংশ নিতে ৩০ জন শিক্ষাবিদকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

  • নির্ধারিত কোনো আলোচ্যসূচি থাকছে না।

  • কেউ কেউ বলছেন, আস্থা তৈরিতে সংলাপ দরকার আছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সংলাপ শুরু করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আজ রোববার শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হবে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অংশীজনদের মতামত নিয়ে একটি কর্মপন্থা নির্ধারণের লক্ষ্যে ইসি সংলাপের আয়োজন করছে।

অবশ্য এই সংলাপ শেষ পর্যন্ত কতটুকু সফলতা বয়ে আনবে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সংশয় আছে। ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ইতিমধ্যে বলেছে, ইসি নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এদিকে প্রথম দিনের সংলাপে আমন্ত্রিত শিক্ষাবিদদের অনেকে যাচ্ছেন না। তাঁদের কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও অতীত অভিজ্ঞতায় তাঁরা মনে করছেন, এই সংলাপ অর্থবহ কিছু হবে না। আগেও এ ধরনের সংলাপ হয়েছে, কিন্তু তাতে আসা গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ইসি। এটি একটি লোক দেখানো প্রক্রিয়া। এ কারণে তাঁরা সংলাপে যাচ্ছেন না। এর বাইরে ব্যক্তিগত কারণ, অসুস্থতা ও দেশের বাইরে থাকায়ও কেউ কেউ আজ সংলাপে যাবেন না।

ইসি সূত্র জানায়, আজ সংলাপে অংশ নিতে কমিশন ৩০ জন শিক্ষাবিদকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বেলা তিনটায় নির্বাচন ভবনে এই সংলাপ শুরু হবে। এতে নির্ধারিত কোনো আলোচ্যসূচি থাকছে না। আমন্ত্রিত ৩০ জন শিক্ষাবিদের মধ্যে গতকাল শনিবার ১০ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। পাঁচজন জানিয়েছেন, তাঁরা সংলাপে যাচ্ছেন না। একজন বলেছেন, তিনি যাবেন কি না, সিদ্ধান্ত নেননি। বাকি চারজন জানিয়েছেন, তাঁরা ইসির সংলাপে অংশ নেবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেতে পারছেন না। পূর্বনির্ধারিত ক্লাস থাকায় ইসির আজকের সংলাপে অংশ নিতে পারবেন না শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এর বাইরে অধ্যাপক আসিফ নজরুল, নুরুল আমিন ব্যাপারী ও দিলারা চৌধুরী মনে করছেন, এই সংলাপ কার্যকর কিছু হবে না। যে কারণে তাঁরা যাচ্ছেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংলাপের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কম্পোজিশন (গঠন) দেখে মনে হয়, গিয়ে কোনো লাভ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যে দৃঢ়তা, মানসিকতা এবং যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, সেটা এই কমিশনের আছে কি না, সন্দেহ আছে। নিরপেক্ষতা, দৃঢ়তা যদি কমিশনের থাকে, তাহলে আমি মনে করি, ওনারা খুব ভালো করেই জানেন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কী করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে সিনিয়র ব্যুরোক্র্যাটরা (জ্যেষ্ঠ আমলা) আছেন, নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব আছেন, ভুয়া নির্বাচন প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন, কাজেই ওনারা জানেন কী করতে হবে। মনে হয় এই সংলাপ করা হয় লোক দেখানোর জন্য। এ জন্য যাচ্ছি না।’

এর আগে দশম সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন এবং একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কে এম নূরুল হুদা কমিশন অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করেছিল। কিন্তু ওই দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক আছে। নূরুল হুদা কমিশন বেশ আয়োজন করে সংলাপ করেছিল। কিন্তু সংলাপে উঠে আসা সুপারিশগুলো বই আকারে ছাপানোর বাইরে তেমন কোনো ব্যবস্থা তারা নেয়নি।

অতীতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংলাপের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কম্পোজিশন (গঠন) দেখে মনে হয়, গিয়ে কোনো লাভ নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যে দৃঢ়তা, মানসিকতা এবং যোগ্যতার প্রয়োজন হয়, সেটা এই কমিশনের আছে কি না, সন্দেহ আছে। নিরপেক্ষতা, দৃঢ়তা যদি কমিশনের থাকে, তাহলে আমি মনে করি, ওনারা খুব ভালো করেই জানেন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কী করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল

ওই সংলাপে অংশ নিয়েছিলেন অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী। এবারও তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত কমিশনের সময় তিনি সংলাপে অংশ নিয়ে একটি ‘ফর্মুলা’ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো মতামত আমলে নেওয়া হয়নি। যে কারণে হতাশা ও অনীহা কাজ করছে। তিনি মনে করছেন, এই সংলাপে গিয়ে কোনো লাভ নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশনে ফেরেশতা দিয়ে রাখলেও ভোট সুষ্ঠু হবে না। তাই তাঁরা যত সুন্দর প্রস্তাবই দেন না কেন, তাতে কোনো লাভ হবে না, বরং অবৈধ প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়া হবে, এ কারণে তিনি যাবেন না।

নূরুল হুদা কমিশনের বিদায়ের পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন শপথ নেয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা বলে আসছেন, গত দুটি কমিশন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ভোট এবং ইসির প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংলাপ মানুষের আস্থা অর্জনে ইসির জন্য সহায়ক হতে পারে।

আলাপ-আলোচনায় অনেক প্রস্তাব, পরামর্শ আসবে। ইসি যদি সে পরামর্শগুলো মেনে কাজ করে, তাহলে তা খুব ভালো হবে।
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ইসির সংলাপে যাবেন কি না, গতকাল পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তবে তিনি মনে করেন, সংলাপের মাধ্যমে আস্থা অর্জনের পথ সুগম হবে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সবাইকে আস্থার মধ্যে আনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সংলাপের বিকল্প নেই। শুধু আলাপ করলে হবে না, ইসিকে কাজের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ইসিকে সবাই পর্যবেক্ষণে রাখবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, তিনি সংলাপে গিয়ে নারীর অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধি রাখার বিষয়ে জোর দেবেন।

এর আগে নূরুল হুদা কমিশন যে সংলাপ করেছিল, তা শুরু হয়েছিল নির্বাচনের রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণা করার পর। ইসি সূত্র জানায়, এবার রোডম্যাপ করার আগেই সংলাপ করা হচ্ছে। পরবর্তী ধাপে ২২ মার্চ বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে সংলাপ হবে।

সংলাপে যেতে না পারলেও এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলাপ-আলোচনায় অনেক প্রস্তাব, পরামর্শ আসবে। ইসি যদি সে পরামর্শগুলো মেনে কাজ করে, তাহলে তা খুব ভালো হবে।’