ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের পঞ্চম দফার ভোট হয়ে গেছে। নির্বাচনে সহিংসতায় ৭০–এর বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। শাসক দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা অনেক ইউনিয়নে ধরাশায়ী হয়েছেন। এ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। কথা বলেছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
প্রথম আলো: ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা অনেক জায়গায় জয় পাচ্ছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও জিতছেন। কোনো কোনো ইউপিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ৪০ থেকে ৫০ ভোট পাচ্ছেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্থানীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাতেই ভুল প্রার্থী বাছাই আর দুরবস্থা।
মাহবুব উল আলম হানিফ: আগে থেকেই দেখা গেছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গোষ্ঠী বা পারিবারিক প্রতিপত্তির একটি প্রভাব থাকে। পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাব আছে—এমন ব্যক্তিরাই সাধারণত নির্বাচনে অংশ নেন। আমরা যখন আগের নির্বাচনে প্রথমবার দলীয় প্রতীক দেওয়া শুরু করলাম, তখন মনে কষ্ট পেলেও দলীয় মনোনয়ন মেনে নিয়েছিলেন। গতবার বিদ্রোহী কিছু ছিল, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ততটা নেওয়া হয়নি। এর একটা প্রভাব এবার পড়েছে। এর পাশাপাশি এ মনোনয়নের জন্য তথ্য সংগ্রহকারীদের দেওয়া তথ্যের মধ্যে গরমিল ছিল বলে আমার মনে হয়। সঠিক তথ্যগুলো হয়তো আসেনি। হয়তো এমন অনেকেই মনোনয়ন পেয়েছেন, যাঁদের সামাজিক অবস্থান ভালো নয়। দুর্বল প্রার্থী কিছু জায়গায় মনোনয়ন পেয়েছেন।
প্রথম আলো: তার মানে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ভালো হয়নি?
মাহবুব উল আলম হানিফ: সব ক্ষেত্রে বলব না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনোনয়ন ভালো হয়নি, এর জন্য বিদ্রোহীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এই বিদ্রোহীরা আওয়ামী লীগের একটি অংশের ভোট তো পাচ্ছেনই, সঙ্গে আবার বিএনপির কিছু ভোট পাচ্ছেন; যেহেতু তারা নির্বাচনে আসেনি। আরেকটি বিষয় আছে; আমরা বারবার বলে আসছি, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হতে পারবেন না। কিন্তু বিএনপি তো নেই। অন্য বড় দলও নেই। তাই এলাকার পরিস্থিতির কারণেই হয়তো অনেক জায়গায় চাইতে হয়েছে যে আমাদের আরও প্রার্থী থাকুক, যাতে কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না জেতেন। তাই কেউ যখন চাইছেন বিদ্রোহী প্রার্থী হতে, তখন তা হয়ে যাচ্ছে। আর ভোটারেরা সাধারণত অপেক্ষাকৃত ভালো প্রার্থীকেই পছন্দ করেন। অনেক জায়গায় তিন–চারজন প্রার্থী আছেন। সেখানে নৌকার প্রার্থী তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী যাতে জিততে না পারেন, তখন অন্য প্রার্থীকে সমর্থন দিচ্ছেন। তখন নৌকার ভোট আরও কমে যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী যে এত কম ভোট পাচ্ছেন, সেটার কারণ এটাই। তাই এর অর্থ এই নয় যে আওয়ামী লীগের ভোট কমে গেছে বা নৌকার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমেছে।
প্রথম আলো: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, গণতান্ত্রিক পরিবেশের অভাবে দলীয় কমান্ড নাজুক হয়ে গেছে। তার কারণেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের অনেক জায়গায় এমন হাল।
মাহবুব উল আলম হানিফ: না, এর সঙ্গে আমি একমত নই। দলীয় কমান্ড আছে। রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল কোনো করপোরেট হাউস নয়। সংগঠন এখানে আদর্শের জায়গা। সেখানে সবাই রাজনীতি করেন আদর্শকে ধারণ করে। নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের কোনো অভাব নেই। অনেক ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে অনেকেই স্থানীয় পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে সেই নির্দেশ হয়তো মানতে পারেন না।
প্রথম আলো: আপনার নির্বাচনী এলাকা কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০টিতেই বিদ্রোহীরা জয়ী হয়েছেন।
মাহবুব উল আলম হানিফ: এ প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু বলতে চাই না।
প্রথম আলো: স্থানীয় নির্বাচনে মাঠপর্যায়ে বিদ্রোহ, বিপর্যয়—এসব নিয়ে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন বা উদ্বিগ্ন কি না? আর আগামী নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে কি না।
মাহবুব উল আলম হানিফ: আগামী নির্বাচনের আগেই ইউপি নির্বাচন নিয়ে কিছু বিরোধ যে সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো আমরা ঠিক করব। আমাদের জাতীয় সম্মেলনের আগেই ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বৈঠক হচ্ছে, সেগুলোর মাধ্যমে এসব সমস্যা মিটবে। জাতীয় নির্বাচনে এবারের নির্বাচনের কোনো প্রভাব পড়বে না। তৃণমূল পর্যায়ে আমরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছি।
প্রথম আলো: মুরাদ হাসান ফোন–কাণ্ডে পদত্যাগে বাধ্য হলেন। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব ও পররাষ্ট্র বিভাগ র্যাবের সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। এভাবে দেশে ও দেশের বাইরেও বড় ধরনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হলো না?
মাহবুব উল আলম হানিফ: সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের অরুচিকর কথাবার্তায় দলের ভাবমূর্তি নিঃসন্দেহে ক্ষুণ্ন হয়েছে; এটা দলের জন্য বিব্রতকর বিষয়ও বটে। তবে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গেই দায়িত্ব থেকে এবং দল থেকেও অপসারণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সম্পর্কে মানুষের মধ্যে খারাপ মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি এটিও প্রমাণিত হয়েছে, কোনো ধরনের আপত্তিকর কথা বললে, রুচিহীন আচরণ করলে সরকার ও দল, কেউ তা সহ্য করে না। মানুষের মধ্যে এ মনোভাব তৈরি হয়েছে যে আওয়ামী লীগ বা সরকার এ ধরনের অনৈতিক কাজকে সমর্থন করে না। আমি মনে করি, সরকারের এ পদক্ষেপ সাধারণ মানুষ ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে।
প্রথম আলো: কিন্তু মুরাদ হাসান কানাডায় যাওয়ার চেষ্টা করলেন, তাঁকে ঢুকতেই দিল না। আপনিও সেখানে গিয়েছিলেন, আপনাকে কেউ বাধা দেয়নি। এভাবে দেশের এক সদ্য পদত্যাগী প্রতিমন্ত্রীর দেশের বাইরে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়া দেশের জন্য লজ্জাজনক নয়?
মাহবুব উল আলম হানিফ: দেখুন, এখানে হয়তো কিছু তথ্যগত ত্রুটি আছে। একটি বিষয়ে জানতে হবে, কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পরে এখন যেকোনো দেশে ভিসা থাকলেই যাওয়া যায় না। এর জন্য একটি প্রাথমিক অনুমোদন দরকার হয়। আমি গত বছর কানাডায় গিয়েছিলাম, সেখানে আমার মেয়ে স্কুলে পড়ে। সেখানে স্কুলের মাধ্যমে কানাডার ইমিগ্রেশন সেন্টারে যাওয়ার জন্য অনুমতি চেয়েছিলাম। ইমিগ্রেশন অফিস থেকে অনুমোদন দেওয়ার পর আমি যেতে পেরেছিলাম। আমার ধারণা, মুরাদ হাসানের এমন পূর্বানুমোদন ছিল না। দ্বিতীয়ত হতে পারে, আমি শুনেছি, তিনি ২০১৯ সালে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ার সময় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, যখন পাঁচ মাসের মধ্যেই কানাডায় স্বাস্থ্যবিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য ভিসা নিয়েছিলেন। এটা কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য যে ওদের যদি সরকারি ভিসা হয়, তবে সরকারি কাজেই কিন্তু যেতে পারবে। পর্যটক ভিসা হলে তাঁকে নতুন করে ভিসা নিতে হবে। মুরাদ হাসান প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় ভিসা নিয়েছিলেন। কিন্তু যখন মন্ত্রিত্ব নেই, তখন পর্যটক হিসেবে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি হয়তো সেটার কারণেই যেতে পারেননি। আমি ঠিক জানি না, এ ধরনের সমস্যা ছিল কি না। এ ব্যাখ্যা মুরাদ হাসানই দিতে পারবেন। আমার ধারণা, এ দুটির যেকোনো একটি হবে। হয় তাঁর কানাডার ইমিগ্রেশনের পূর্বানুমোদন ছিল না, নয়তো তাঁর ভিসার জটিলতা ছিল।
প্রথম আলো: মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে বলুন।
মাহবুব উল আলম হানিফ: এ ব্যাপারে কিন্তু মানুষের মধ্যে ভিন্ন একধরনের প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ করেছি। আমাদের ধারণা, এখানে কোনো তথ্যগত ভুল করা হয়েছে। আর এর কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত আসেনি। যদি র্যাবের প্রধান হিসেবে কারও বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তবে এটা তো অনেক আগেই করা উচিত ছিল। ২০০৫ সালের ৫ জুন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ফজলুল বারী। উনি মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যে ক্রসফায়ার আছে, ক্রসফায়ার চলবে। ক্রসফায়ার আমাদের অপরিহার্য। ২০০৫ সালে দুই শতাধিক ক্রসফায়ার হয়েছিল। দায়িত্বশীল ওই ব্যক্তি ১/১১–এর সময় তাঁর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মধ্যেই দেশ ছেড়ে চলে যান। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকে তো ওই ব্যক্তিকে আগে অভিযুক্ত করার কথা। তিনি কীভাবে ওভাবে থাকতে পারেন? দ্বিতীয়ত, আরেক বিষয় হলো ১৯৭১ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারী হিসেবে আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত দুজন যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মঈনুদ্দীন, আশরাফুজ্জামান। তাঁদের মধ্যে আশরাফুজ্জামান আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁরা আদালতের মাধ্যমে দণ্ডপ্রাপ্ত। বঙ্গবন্ধু হত্যার দণ্ডিত অপরাধী মেজর নূরও যুক্তরাষ্ট্রে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কাউকে যদি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, তবে তো আদালতের মাধ্যমে দণ্ডপ্রাপ্তদের আগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত। মানবাধিকারের কথা বলে কিছু ব্যক্তিকে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে, আবার কিছু ব্যক্তিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আশ্রয় দিচ্ছে, তখন কিন্তু জনগণের কাছে প্রশ্ন তৈরি হয়।
প্রথম আলো: এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ কি চাপ অনুভব করছে না?
মাহবুব উল আলম হানিফ: আমাদের চ্যালেঞ্জ সব সময় ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলা থেকে রেহাই পেতে এবং একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে আন্দোলন শুরু করেছিল জামায়াত-বিএনপি। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচালের চেষ্টায় শুরু হয়েছিল জ্বালাও-পোড়াও। সরকারকে অস্থিতিশীল করতে সব সময় চেষ্টা হয়েছে। নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ হয়ে তারা এখন বিদেশিদের সহায়তা নিচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই জননেত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে যাচ্ছেন এবং যাবেন। উন্নয়ন–অগ্রগতির পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে বড় শর্ত। সেটি অর্জিত হয়েছে এবং তা টিকে থাকবে।