নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দীর্ঘ ২৮ বছর ১০ মাস পর আজ সোমবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘মিনি পার্লামেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হল সংসদের নির্বাচন।
নির্বাচনে প্রচার পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশ থাকলেও শেষ মুহূর্তে অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে (স্টিলের বক্স) ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানানো, ভোটকক্ষে প্রার্থীদের এজেন্ট না রাখাসহ বেশ কিছু অভিযোগের কারণে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য প্রায় সব প্রার্থী সুষ্ঠু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও নানা ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। এর বড় কারণ, আবাসিক হলগুলো কার্যত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হলগুলোতে ভোট কেমন হবে, সে বিষয়ে তাঁরা এখনো আশ্বস্ত হতে পারছেন না।
আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থী ও প্রার্থীর আশঙ্কা, জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব পড়তে পারে ডাকসু নির্বাচনেও।
যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, নির্বাচন নিয়ে যেসব আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, তা ঠিক নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।
আর ছাত্রলীগ নেতাদের ভাষ্য, কোনো কোনো সংগঠনের প্রার্থীরা পরাজয়ের আশঙ্কা থেকেই নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে এবং নির্বাচন থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রাব্বানী গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, আনন্দঘন পরিবেশে নির্বাচনের জন্য যত ধরনের নিরাপত্তা প্রয়োজন, তা নেওয়া হয়েছে। কেউ যদি কোনো ধরনের শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করে, তাহলে নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার স্বার্থে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রক্টরিয়াল বডি তা নেবে।
ডাকসুর মেয়াদ এক বছর হলেও সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৯০ সালের ৬ জুন। এরপর কখনো কখনো নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া এলেও বাস্তবে তা হয়নি। অবশেষে মামলা-মোকদ্দমা ও আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আজ এই নির্বাচন করতে যাচ্ছে।
নির্বাচনে প্রায় সব ছাত্রসংগঠন অংশ নিচ্ছে। ডাকসুতে ১৩টি প্যানেল দিয়ে নির্বাচন করছে বিভিন্ন সংগঠন। এগুলো হলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাম সংগঠনগুলোর জোট প্রগতিশীল ছাত্রঐক্য, কোটা আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, স্বতন্ত্র জোট, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ-বিসিএল, ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র মুক্তিজোট, জাতীয় ছাত্রসমাজ ও বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন। এর বাইরে একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচন করছেন।
ডাকসুতে মোট ২৫টি পদের বিপরীতে নির্বাচন করছেন মোট ২২৯ জন প্রার্থী। এর মধ্যে ভিপি পদে লড়ছেন ২১ জন, জিএস পদে ১৪ ও এজিএস পদে ১৩ জন। এ ছাড়া একেকটি আবাসিক হলে ১৩টি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই হিসাবে ১৮টি আবাসিক হলে ২৩৪টি পদে নির্বাচন হবে। এগুলোতে মোট প্রার্থী ৫০৯ জন। মোট ভোটার ৪৩ হাজার ২৫৬ জন।
ভোট নিয়ে যত শঙ্কা
গতকাল বিভিন্ন প্রার্থী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক কালে জাতীয় ও স্থানীয় বেশ কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কারণে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে এমনিতেই তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। এর মধ্যে স্টিলের অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রার্থীদের দুশ্চিন্তা বেড়েছে। বাক্সগুলো গতকালই হলগুলোতে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য প্রার্থীদের ক্ষুব্ধ করেছে।
ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যদের দাবি ছিল আবাসিক হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র করা। সেই দাবি উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলেই কেন্দ্র রেখেছে। এক দিকে ছাত্রলীগ মূলত হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, আরেক দিকে সেখানে অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্স পাঠানো হচ্ছে, তাও আগের রাতে। কেন্দ্রে প্রার্থীদের এজেন্ট না থাকাটাও শঙ্কার বড় কারণ।
একাধিক প্রার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক বলেন, শুরু থেকেই যেসব শিক্ষক নির্বাচনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের নেতা বা সমর্থক। উপাচার্য নিজেও নীল দল থেকে শিক্ষক সমিতিতে নির্বাচন করে একাধিকবার জয়ী হয়েছেন। ১৫ সদস্যের যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছে, তার মধ্যে ১৩ জনই নীল দলের। এ ছাড়া গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য গঠিত ৫ সদস্যের কমিটি, আচরণবিধি প্রণয়নের জন্য ছয় সদস্যের কমিটি, কেন্দ্রীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ছয়জনের পাঁচজনই ছিলেন নীল দলের সদস্য।
বিএনপিপন্থী সাদা দলের শিক্ষকেরা গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বিরোধী মতের কোনো শিক্ষককে সম্পৃক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন। সাদা দলের আহ্বায়ক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম লিখিত বক্তব্যে বলেন, ১৮টি হলে প্রশাসন-সমর্থক ছাড়া ভিন্নমতের একজন প্রাধ্যক্ষ বা হাউস টিউটর নেই।
বিদ্যমান নির্বাচনপ্রক্রিয়ার ওপর বেশির ভাগ প্রার্থী আস্থা রাখতে পারছেন না। এর মধ্যে আবার ভোটের দিন গণমাধ্যমের ওপর একধরনের কড়াকড়ি আরোপ করে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
গতকাল বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর দুই মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য, স্বতন্ত্র জোট, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ ও বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থীরা উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে এসব বিষয়ে প্রতিকার চেয়েছেন। তাঁরা অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্সের পরিবর্তে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট গ্রহণ, ভোটের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স পাঠানো, গণমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি প্রত্যাহারসহ ছয় দফা দাবি জানিয়েছে। বিকেলে বাম ছাত্রজোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী, ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক, স্বতন্ত্র জোটের ভিপি প্রার্থী অরণী সেমন্তী খান, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদের জিএস প্রার্থী এ আর এম আসিফুর রহমান, ছাত্র ফেডারেশনের জিএস প্রার্থী উম্মে হাবিবা বেনজীরসহ আরও কয়েকজন প্রার্থী ও সমর্থক উপাচার্যের কার্যালয়ে যান। তাঁরা প্রথমে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে কিছুক্ষণ ‘নীলনকশার নির্বাচন মানি না’ ইত্যাদি স্লোগান দেন। উপাচার্য তখন দপ্তরে ছিলেন না। এরপর উপাচার্য যখন এই পথ দিয়ে তাঁর দপ্তরে প্রবেশ করেন, তখনো স্লোগান চলছিল। তবে উপাচার্যদের যাওয়ার জন্য পথ করে দেন প্রার্থীরা। উপাচার্য দপ্তরে গেলে প্রার্থীরা তাঁর সঙ্গে দেখা করে দাবিগুলো তুলে ধরেন।
পরে আবার বিক্ষোভস্থলে দাবিগুলো তুলে ধরেন বাম জোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী। উপস্থিত অন্য প্রার্থীরাও বক্তব্য দেন। তাঁরা সবাই নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। তবে ভোটারদের প্রতি ভোট দিতে আসার অনুরোধ করেছেন তাঁরা।
এর আগে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ভিপি প্রার্থী নুরুল হকসহ তাঁদের কয়েকজন প্রার্থী সিনেট ভবনে স্থাপিত এই নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে গিয়ে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করা, কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট রাখাসহ ছয় দফা দাবি জানিয়ে লিখিত আবেদন জানান। এ বিষয়ে নুরুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আমরা হতাশ ও উদ্বেগের মধ্যে আছি।’
ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল মধুর ক্যানটিনের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, প্রশাসন শুরু থেকেই ছাত্রলীগের পক্ষে ‘অন্ধভাবে’ কাজ করছে। নির্বাচনে অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করা প্রশাসনের ‘নীলনকশার’ অংশ।
অবশ্য এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন ছাত্রলীগের এজিএস প্রার্থী ও সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন ঘিরে অনেক ছাত্রসংগঠন দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। ছাত্রদল নির্বাচন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নিরাপদ প্রস্থান খুঁজছে। আমরা বিশ্বাস করি, ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের “ম্যান্ডেট” নিয়ে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হতে যাচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেই মনে করেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখবে ছাত্রী এবং হলের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের ভোট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক বিবরণী অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৫৪ হাজার ৬৯৪ জন। এর মধ্যে আবাসিক ২২ হাজার ৬৬৬ শিক্ষার্থী। এর সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের আরও বেশ কিছু শিক্ষার্থী হলে থাকেন। তবে এখনো বড় একটি অংশ হলের বাইরে থাকে। আর মোট ভোটের মধ্যে ছাত্রী ১৬ হাজার ৩১২ জন। ছাত্রীদের হলে এবং যাঁরা বাইরে থাকেন, তাঁদের ওপর ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এই দুই ধরনের শিক্ষার্থীই জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখবেন।