অনুসন্ধান কমিটি গঠন

আ.লীগ বলছে সুন্দর, আগ্রহ নেই বিএনপির

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে রয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক।

জাতীয় সংসদে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন পাস করার আট দিন পর আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি সর্বোচ্চ ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করবে।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অনুমোদনের পর গতকাল শনিবার অনুসন্ধান কমিটি গঠনের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটির অপর পাঁচ সদস্য হলেন হাইকোর্টের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন এবং কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

অনুসন্ধান কমিটি সুন্দর ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে আওয়ামী লীগ। দলের যুগ্ম সাধারণ সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গঠিত নির্বাচন কমিশন দিয়ে বাংলাদেশে একটি সুন্দর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেমনটি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হয়েছে।

তবে অনুসন্ধান কমিটিকে অর্থহীন বলে মন্তব্য করেছে বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমরা মনে করি অনুসন্ধান কমিটি, নির্বাচন কমিশন—সবই সরকারের অধীন। এগুলো নিয়ে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই। এটা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।’

গত ২৭ জানুয়ারি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। এরপর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সম্মতির ভিত্তিতে ৩০ জানুয়ারি বিলটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ এটি আইনে পরিণত হয়।

অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, আইন ও সংবিধান অনুসারে তিনি দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করবেন। আজ রোববার বা আগামীকাল সোমবার কমিটির প্রথম বৈঠক হতে পারে বলে জানান তিনি। সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে বৈঠক হবে।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের আগে ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি যে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিলেন, এর সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তখন তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন।

কমিটিতে যাঁরা এলেন

আইন হওয়ার পর থেকেই ছয় সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ জন্য কয়েক দিন ধরে নাম বাছাই করা হয়। আইন অনুযায়ী, অনুসন্ধান কমিটি গঠনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। অবশ্য অনুসন্ধান কমিটির জন্য রাষ্ট্রপতি শুধু দুজন বিশিষ্ট নাগরিককে সদস্য হিসেবে মনোনীত করতে পারেন। বাকি চারজনই সাংবিধানিক পদধারী।

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ২০০৯ সালে হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১১ সালে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে তাঁর নিয়োগ স্থায়ী করা হয়। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২০ সাল থেকে তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়।

অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া হাইকোর্টের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান এর আগে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে আসা এস এম কুদ্দুস জামান জেলা জজের দায়িত্বও পালন করেছেন। তাঁর বাড়ি রাজবাড়ীতে।

আইন অনুসারে আপিল বিভাগ থেকে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানকে যথাক্রমে সভাপতি ও সদস্য হিসেবে অনুসন্ধান কমিটির জন্য মনোনীত করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রস্তাব পাঠান দেশের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

সাংবিধানিক পদধারী হিসেবে সদস্য হওয়া বাকি দুজনের মধ্যে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী সাবেক অর্থসচিব। ২০১৮ সাল থেকে তিনি মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামে।

পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন সোহরাব হোসাইন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে অবসরের পর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সরকার তাঁকে পিএসসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়। সোহরাব হোসাইন চাকরিজীবনে বিসিএস প্রশাসন একাডেমির রেক্টরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রপতির মনোনীত কমিটির দুজন সদস্য হলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন ও কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক।

ছহুল হোসাইন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গঠিত নির্বাচন কমিশনের সদস্য (কমিশনার) ছিলেন। তিনি ২০০৭-২০১২ মেয়াদে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। এই কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর বাড়ি সিলেটে। নির্বাচন কমিশনার হওয়ার আগে চাকরিজীবনে তিনি বিচারক ছিলেন।

ছহুল হোসাইন ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ (সদর) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তাঁর নামে সিলেট-১ আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহও করেছিলেন সমর্থকেরা। যদিও তিনি মনোনয়ন পাননি।

প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক কথাসাহিত্যিক হিসেবেও দেশে জনপ্রিয়। তাঁর স্বামী প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।

গত কমিটিতে কারা ছিলেন

গত ইসিও গঠন করা হয়েছিল অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে (তখন আইন ছিল না)। ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আপিল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের (পরে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন) নেতৃত্বে ছয় সদস্যের এই কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান (এবারের কমিটির সভাপতি), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মাসুদ আহমেদ, পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সহ-উপাচার্য শিরীণ আখতার (বর্তমানে উপাচার্য)।

অনুসন্ধান কমিটির কাজ কী

অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে যোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করতে হবে অনুসন্ধান কমিটিকে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা কয়েক দিন আগে প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধান কমিটি চাইলে ১৫ কার্যদিবসের আগেও ইসি গঠনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করতে পারবে।

আইন অনুযায়ী, অন্যূন তিন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির কোরাম গঠিত হবে। কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। ভোট সমান হলে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।

অনুসন্ধান কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও কমিশনারদের প্রতিটি পদের জন্য ২ জন করে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে। এই ১০ জনের মধ্য থেকে সিইসিসহ ৫ জনকে দিয়ে ইসি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি।

অনুসন্ধান কমিটির কাজ সম্পর্কে আইনে বলা হয়েছে, এই কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করা হবে।

আইনে সিইসি ও ইসি নিয়োগে যোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিক এবং বয়স ন্যূনতম ৫০ বছর হতে হবে। এ ছাড়া কোনো গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, বিচার বিভাগীয়, আধা সরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত পদে বা পেশায় অন্যূন ২০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এবারই প্রথম আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হচ্ছে। বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। নতুন ইসি গঠনে করা অনুসন্ধান কমিটির সবাই ভালো লোক বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন অনুসন্ধান কমিটি নির্বাচন কমিশন গঠনে কাদের নাম প্রস্তাব করবে, সেটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছে দেশবাসী।