কুমিল্লা সিটি নির্বাচন

আ.লীগের ১৩ নেতা নীরব, বিএনপির অনেকে প্রকাশ্যে

আওয়ামী লীগের সেই ১৩ নেতা গতকালও মাঠে নামেননি। বিএনপির অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বহিষ্কৃত দুই নেতার পক্ষে সক্রিয়।

মনিরুল হক, আরফানুল হক
মনিরুল হক, আরফানুল হক

আর দুদিন পর ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। ঢাকায় ডেকে নেওয়া আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত সেই ১৩ নেতা এখনো নীরব। তাঁরা গতকাল পর্যন্ত দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামেননি। আজ রোববার তাঁরা একজোটে শহরে ‘প্রদর্শনমূলক’ একটা কিছু করবেন বলে জানা গেছে।

এদিকে নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই মেয়র পদে ‘ঘড়ি’ ও ‘ঘোড়া’ প্রতীকের দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে–অপ্রকাশ্যে নেমেছেন বিএনপির সাবেক ও বর্তমান নেতাদের কেউ কেউ।

গতকাল শনিবার ঘোড়া প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন নিবাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহানগর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক খলিলুর রহমান ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আমিরুল পাশা সিদ্দিকী। বাদুড়তলার যে ঘরে নিজাম ইশতেহার ঘোষণা করেন, সেটি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুর রশিদ ইয়াছিনের কার্যালয়।

দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নিবাচনে অংশ নেওয়ায় নিজাম উদ্দিন ও মো. মনিরুল হককে (সাক্কু) আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে বিএনপি। মনিরুল হক বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর নিজাম উদ্দিন কুমিল্লা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি ছিলেন।

বহিষ্কৃত দুই নেতার সঙ্গে সংস্রব না রাখতে এবং নির্বাচনী কাজে অংশ না নিতে কেন্দ্রীয়ভাবে বিএনপি থেকে কড়া নির্দেশনা রয়েছে দলীয় নেতা–কর্মীদের প্রতি। এ নির্দেশনা অবশ্য অনেকে মানছেন না।

‘মনোনয়ন না পাওয়া দলীয় নেতারা এখনো মাঠে নামেননি। শুনেছি সন্ধ্যার পর তাঁরা বৈঠক করে প্রচারে অংশ নেবেন।’
আরফানুল হক (রিফাত), আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী

জানা গেছে, নির্বাচনী প্রচারের কাজে নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য শফিউল আলম, মহানগর আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মনিরুল ইসলাম, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আমিরুল পাশা সিদ্দিকী ও সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম শাহেদকে দেখা যাচ্ছে।

আমিরুল পাশা সিদ্দিকী প্রচারে অংশ নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। তবে তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকে ঘোড়া প্রতীকের পক্ষে শুভপুর ও সংরাইশ এলাকায় বড় শোডাউন হয়েছে।’

আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হকের পক্ষে কাজ করছেন দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক। তাঁকে প্রায়ই মনিরুল হকের বাসায় দেখা যায়। এ ছাড়া কুমিল্লা শহর বিএনপির সাবেক দুই সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম ও হুমায়ুন কবির, দক্ষিণ জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নজরুল হক ভূঁইয়া, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মুজিবুর রহমানকেও নিবাচনী প্রচারে দেখা গেছে।

গত রাতে নজরুল হক ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি ঘোষণার আগেই আমি সাক্কুর ভাইয়ের পক্ষে প্রচারণায় নেমেছি। ৩০ মে আহ্বায়ক কমিটিতে আমার নাম দেখার পর ফেসবুকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছি।’

ইতিমধ্যে দুই প্রার্থীর পক্ষে নিবাচনী কাজে অংশ নেওয়ায় পাঁচজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মুজিবুর রহমানও রয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নোটিশের জবাব দেওয়ার চেয়ে এই মুহূর্তে সাক্কু ভাইয়ের পক্ষে কাজ করাটা জরুরি মনে করছি।’

এ ছাড়া কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এবারের নির্বাচনে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির তিনজন যুগ্ম আহ্বায়ক ও ছয়জন সদস্য কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে দলীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

‘আমরা ১৩ জন রাত আটটায় (শনিবার) বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেব, কীভাবে প্রচারণা শুরু করব।’ তবে রাত পৌনে নয়টা পর্যন্ত বৈঠকে আঞ্জুম সুলতানা, তাঁর ভাই মাসুদ পারভেজ খান ও আরেক মনোনয়নবঞ্চিত সফিকুল ইসলাম শিকদার ছাড়া কেউ উপস্থিত হননি।
আঞ্জুম সুলতানাও, কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি

আ.লীগের ১৩ নেতা আজ নামতে পারেন

মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েও পাননি যে ১৩ জন নেতা, তাঁরা গতকাল পর্যন্ত নৌকা প্রতীকের পক্ষে মাঠে নামেননি। গত শুক্রবার তাঁদের ঢাকায় ডেকে নিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গতকাল শনিবার রাত পর্যন্ত এই ১৩ জনের কেউ প্রচারে নেমেছেন, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক (রিফাত) প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনোনয়ন না পাওয়া দলীয় নেতারা এখনো মাঠে নামেননি। শুনেছি সন্ধ্যার পর তাঁরা বৈঠক করে প্রচারে অংশ নেবেন।’

ওই ১৩ জন নেতার অন্যতম কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আঞ্জুম সুলতানাও প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ১৩ জন রাত আটটায় (শনিবার) বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নেব, কীভাবে প্রচারণা শুরু করব।’ তবে রাত পৌনে নয়টা পর্যন্ত বৈঠকে আঞ্জুম সুলতানা, তাঁর ভাই মাসুদ পারভেজ খান ও আরেক মনোনয়নবঞ্চিত সফিকুল ইসলাম শিকদার ছাড়া কেউ উপস্থিত হননি।

মনোনয়নপ্রত্যাশী কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক নূর উর রহমান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এক আত্মীয় ঢাকায় অসুস্থ। সে জন্য প্রচারণায় নামতে পারেননি। আজ রোববার থেকে নামবেন।

আরফানুল ও মনিরুলের গণসংযোগ

আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় গণসংযোগে বের হন। তিনি প্রথমে নগরের কমলাপুর এলাকায় ফরিদ গ্রুপের কারখানার শ্রমিকদের কাছে ভোট চান।

বেলা ১১টায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিত্সক, নার্স ও কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। দুপুর ১২টায় নগরের ভাটপাড়া এলাকায় গণসংযোগ করেন। বিকেল পাঁচটায় ঢুলিপাড়ায় উঠান বৈঠক করেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নগরের উত্তর ঠাকুরপাড়া কালীমন্দির ও রাত সাড়ে আটটায় শাসনগাছা রেলগেট এলাকায় উঠান বৈঠক করেন।

স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মো. মনিরুল হক নগরের রানীরবাজার, গোবিন্দপুর, খলিফাবাড়ি ও অশোকতলা এলাকায় গণসংযোগ এবং উঠান বৈঠক করেন। স্বতন্ত্র আরেক মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন ইশতেহার ঘোষণার পর গতকাল বিকেলে শহরের রাজগঞ্জ এলাকায় গণসংযোগ করেন।

বাহাউদ্দিন–আরফানুলের বিরুদ্ধে মনিরুলের অভিযোগ

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক ও কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে গতকাল রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক।

মনিরুল হক অভিযোগ করেন, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ও সংলগ্ন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও মসজিদের ইমামদের নৌকা প্রতীকের প্রচারে অংশ নিতে নির্দেশ দেন।

সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আচরণবিধি লঙ্ঘন করি না। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিই না।’ আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক দাবি করেন, নৌকার পক্ষে গণজোয়ার দেখে অসত্য অভিযোগ করা হচ্ছে।

রিটার্নিং কর্মকর্তাকে দেওয়া আরেক চিঠিতে মনিরুল হক অভিযোগ করেন, আরফানুল ও বাহাউদ্দিনের নির্দেশে সিটি করপোরেশনের আওতাবহির্ভূত এলাকার জনপ্রতিনিধি, দলীয় কর্মী, বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে জনসমাগম, মিছিল ও শোডাউন করছেন। নির্বাচনের দিন বহিরাগতদের দ্বারা জনসমাগম ঘটিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করবেন বলে জনশ্রুতি আছে।

রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।