সরকারি কর্মকর্তারাই রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি শেখান বলে নিজ বইয়ে লিখেছেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান আবদুল কাদের মির্জা। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে নিজের লেখা ‘সত্য যে কঠিন’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি। সেখানেই তিনি এ কথা বলেন।
এ বইয়ে আমলাদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘আমরা প্রায়ই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দুর্নীতির খবর পড়ি। দুর্নীতির দায়ে সাবেক মন্ত্রী, এমপি পর্যন্ত শাস্তি ভোগ করেন। কিন্তু কোনো সরকারি আমলাকে শাস্তি ভোগ করতে দেখি না বা খবর পাই না। কোনো সাবেক মন্ত্রী যদি দুর্নীতির দায়ে জেল খাটেন, তাহলে ওই মন্ত্রণালয়ের সচিবেরও জেল হওয়া উচিত। কারণ, সচিব ছাড়া একজন মন্ত্রীর পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। আমি মনে করি, আমলারাই রাজনীতিবিদ অথবা জনপ্রতিনিধিদের দুর্নীতি শেখান।’
এ প্রসঙ্গে কাদের মির্জা আরও লিখেছেন, ‘সরকারের পরিবর্তন হলে সচিবেরা খোলস পাল্টে সরকারের খাস লোক হওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে সচিবেরা বেঁচে যান। এটা আমাদের রাজনীতিকদের দুর্বলতা। আমরা দুর্নীতিবাজ সচিবদের সুযোগ না দিলে তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারেন না। কানাডার বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়া–সিঙ্গাপুরে যে সেকেন্ড হোমের কথা বলা হয়, সেখানে কজন রাজনীতিক আর কজন সাবেক আমলার বাড়ি আছে? আমরা কেউ কি তার খবর রাখি? সবাই হইচই করে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের নিয়ে কিন্তু আমলাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলে না। আমরা বলি, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। অথচ রাষ্ট্রে জনগণের কোনো মূল্য নেই। যাঁরা জনগণের সেবা করার জন্য সরকারি চাকরিতে আসেন অথবা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তাঁরা জনগণকে কোনো মূল্য দেন না। কিন্তু বলার সময় ঠিকই বলেন, “জনগণই রাষ্ট্রের মালিক।”’
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর বসুরহাটে নিজের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় নিজ দলের সাংসদদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন কাদের মির্জা। ওই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীতে তিন-চারটা আসন ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা পালানোর দরজা খুঁজে পাবে না। এটাই হলো সত্য কথা। সত্য কথা বলতে হবে। আমি সাহস করে সত্য কথা বলছি।’ তাঁর এই বক্তব্য সারা দেশে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে।
বইয়ের মোড়ক উন্মোচন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন আবদুল কাদের মির্জা। যে বক্তব্য দিয়ে কাদের মির্জা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় এসেছিলেন, সেই বক্তব্যের সঙ্গে তিনি এখনো একমত কি না, জানতে চাইলে তিনি এখনো ওই বক্তব্যে অনড় আছেন বলে জানান।
বইটির ১৬৭ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন, ‘অনিয়মকারী, দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, রাজনীতি পুঁজি করে যারা অবৈধপন্থায় অর্থ সম্পদের পাহাড় করতে চায়, তাদের রাজনীতিবিদ বলা যায় না। কিছু অর্থ ও অস্ত্র পুঁজি করে অনেকে রাজনীতিতে জায়গা করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। এই কলাগাছগুলোর জাঁতাকলে পড়ে অসহায়–নিঃস্ব হয়ে গেছে দলের দুঃসময়ের কাণ্ডারি ত্যাগী নেতা–কর্মীরা। আওয়ামী লীগের প্রাণ হলো এই কর্মী-সমর্থকেরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কালের বিবর্তনে কর্মীর মূল্যায়ন যেন ধারাবাহিকভাবে কমতেছে। আওয়ামী লীগের জন্য জীবন-যৌবন উৎসর্গ করা কর্মীরা যখন ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না, তখন একরামের (নোয়াখালী–৪ আসনের সাংসদ মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী) মতো অপরাজনীতির হোতারা দেশ-বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের স্তুপ করেছে।’
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নিয়ে বইটির ৭৫ নম্বর পৃষ্ঠায় কাদের মির্জা বলেন, ‘জেলখানায়ও টাকাওয়ালার জন্য কিছুর অভাব নেই। আপনার টাকা আছে তো আপনি বাঘের দুধও পাবেন। আর টাকা নেই আপনার দাম নেই, জেলখানা মানে টাকার কারবার। ওখানে টাকা ছাড়া কেউ কথা বলে না। বাংলাদেশের দুর্নীতির আরেক লীলাক্ষেত্র জেলখানা, জেলখানায় যে খাবার দেওয়া হয় তা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে খাওয়া অসম্ভব। জানি না এখন কী ধরনের খাবার দেওয়া হয়। জরুরি ভিত্তিতে খাবার ও থাকার পরিবেশ উন্নত হওয়া উচিত।’
বইয়ে কাদের মির্জা আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলায় প্রচুর মানুষ জেলে বন্দী থাকে। সকল রাজনৈতিক নেতা–কর্মীর শপথ নেওয়া উচিত—মিথ্যা, হয়রানিমূলক ও প্রতিহিংসামূলক মামলা পরিহার করা। কী লাভ দুই দিনের জীবনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার। রাজনীতি হলো নীতির সঙ্গে নীতির লড়াই, আদর্শের সঙ্গে আদর্শের লড়াই। রাজনীতি মোকাবিলা করতে হবে রাজনীতি দিয়ে। একে অপরকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা, জেলে বন্দী রাখা রাজনীতিবিদদের নিজের পায়ে কুড়াল মারা।’