সাংসদ হওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে নেই আইনজীবীরা। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের শতাধিক আইনজীবী। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের পাশাপাশি তরুণ আইনজীবীরাও মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। আইনজীবীদের অভিযোগ, আগের সংসদগুলোতে আইনজীবীদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু বর্তমানে দলগুলো থেকে আইনজীবীদের মনোনয়ন কম দেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা কয়েকজন আইনজীবী প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা আইনজীবী হিসেবে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখার জন্য সাংসদ হতে চান। মনোনয়ন পেলে অবশ্যই জিতবেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী আইনজীবীরা দলকে বোঝাচ্ছেন যেহেতু সংসদে আইন প্রণয়ন হয়, তাই সাংসদ হিসেবে আইনজীবীদের প্রাধান্য থাকা উচিত।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে অন্যান্য দল এবং প্রধান দুই দলের সঙ্গে জোটভুক্ত হওয়া দলগুলোর অনেক আইনজীবী নেতাও প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ফলে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে এবারের নির্বাচনে অর্ধ শত আসনে আইনজীবীরা মনোনয়ন পেতে পারেন। সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদে আইনজীবীর সংখ্যা ছিল ৫১ জন।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আগে থেকে বলে আসছিলেন, এবার তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে তিনি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, আইনজীবীরা আইন প্রণয়নে সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। সংসদে আইনজীবীদের প্রাধান্য থাকা উচিত।
আইন সম্পর্কে যাঁরা জ্ঞান রাখেন, তাঁদের আইনপ্রণেতা হওয়া উচিত বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম। রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। আইনজীবী হিসেবে সংসদে ভূমিকা রাখতে চান।
যাঁরা সৎ, যাঁরা যোগ্য রাজনীতিক, দলগুলো তাঁদের ঠিকমতো মূল্যায়ন করছে না বলে অভিযোগ মনোনয়নপ্রত্যাশী আইনজীবী বিএনপির আইন সম্পাদক কায়সার কামালের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের আরও অনেক আইনজীবী বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
আ.লীগের মনোনয়ন চান যেসব আইনজীবী
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। তিনি মুন্সিগঞ্জ-২ আসন (টঙ্গিবাড়ী ও লৌহজং) থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। কয়েক বছর আগ থেকে এলাকায় গণসংযোগ করে আসছেন তিনি। বর্তমানে সেখানে সাংসদ হিসেবে আছেন আওয়ামী লীগের বেগম সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি।
আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিমের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুরে। তিনি পিরোজপুর-১ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। এ আসনে বর্তমান সাংসদ হলেন এ কে এম আবদুল আওয়াল। আগে থেকে এলাকায় গণসংযোগ করে আসছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক।
বার কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য আবদুল বাসেত মজুমদার ঢাকা-১৭ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজনীতি করেন জনসেবা করার জন্য। আইনজীবী হিসেবে সব সময় মানুষের পাশে দাঁড়ান। আইন পেশা থেকে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা দিয়ে আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে চান তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কাজী নজিবুল্লাহ হিরুর জন্ম পুরান ঢাকায়। তিনি ঢাকা-৭ আসনে প্রার্থী হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। প্রথম আলোকে বলেন, দল মনোনয়ন দিলে তিনি জিতবেন।
দুদকের কৌঁসুলি (পিপি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মোশাররফ হোসেন কাজল। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দুদকের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন তিনি। কাজল ঢাকা-১৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সাইদুর রহমান মানিক আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। নেত্রকোনা-৩ আসন থেকে মনোনয়ন চান সাইদুর রহমান।
তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এলাকার উন্নয়ন এবং আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখার জন্য তাঁর এই নির্বাচন বাসনা।
মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে লড়ার জন্য আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আবদুল মান্নান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।’
ঢাকা-১৮ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন আইনজীবী মমতাজ উদ্দিন মেহেদি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। মমতাজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরা এলাকায় তিনি বসবাস করেন। মানুষের পাশে থাকতে চান।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মোখলেসুর রহমান বাদল কিশোরগঞ্জ-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
ভোলা-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগেকার সংসদগুলোতে আইনজীবীদের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে আইনজীবীদের মধ্য থেকে সাংসদ কম হচ্ছেন। আইনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের সংসদে আনা উচিত। তিনি সংসদে আইনজীবীসহ পেশাজীবীদের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি করেন।
এ ছাড়া আইনজীবী থেকে সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, আবদুল মতিন খসরু, সাহারা খাতুন, নুরুল ইসলাম সুজন, শেখ ফজলে নূর তাপস, মাহবুব আলী ও শামসুল হক টুকু। তাঁরাও নিজ দল থেকে মনোনয়ন ফরম জমা সংগ্রহ করেছেন।
বিএনপির মনোনয়ন চান যাঁরা
বিএনপির আইন সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সানাউল্লাহ মিয়া বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তিনি নরসিংদী-৩ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। সানাউল্লাহ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আগে থেকে এলাকার মানুষের পাশে আছেন। মনোনয়ন পেলে তিনি জেতার ব্যাপারে আশাবাদী।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বরিশাল-৫ আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন। এর আগে ২০০৮ সালে তিনি ঢাকার একটি আসন থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছিলেন। আলাল প্রথম আলোকে বলেন, আগে যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতেন, তাঁদের গুরুত্ব ছিল অনেক। আইনজীবী ছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবী লোকজন সাংসদ হতেন। যাঁদের অর্থ আর পেশিশক্তি আছে, তাঁদের গুরুত্ব এখন বেশি।
বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তিনি বরিশাল সদর আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। মাসুদ আহমেদ তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি নির্বাচন করতে চান।
বিএনপির আইন সম্পাদক কায়সার কামাল নেত্রকোনা-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। তিনি মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বরগুনা-২ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন বরিশাল-৩ আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন খোকন নোয়াখালী-১ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।
বিএনপির সহসভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী মাগুরা-১ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। ঝালকাঠি-১ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহজাহান ওমর।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুহম্মদ জমির উদ্দিন সরকার এবার নির্বাচন করছেন না। তবে তাঁর ছেলে আইনজীবী নওশাদ জমির পঞ্চগড়-২ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মওদুদ আহমদ নোয়াখালী-৫ আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
চট্টগ্রাম-৫ আসন থেকে বিএনপির মনোননয়ন ফরম কিনেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী বিএনপি নেতা মীর মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে আইনজীবীদের সংখ্যা বেশী থাকা দরকার। কারণ, আইনজীবীরা আইন সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখেন।
এ ছাড়া বরিশাল-৩ আসন থেকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনিরুজ্জামান, চট্টগ্রাম-৫ আসন থেকে শাকিলা ফারজানা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আমিনুল হক, তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপি থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজনের প্রতিবেদন বলছে, বর্তমান দশম জাতীয় সংসদে সাংসদদের মধ্যে ব্যবসায়ী আছেন ১৭৫ জন। আর আইনজীবী আছেন ৫১ জন।
বরগুনা-২ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারী খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সংসদে আইনজীবীদের প্রাধান্য থাকা উচিত। সংসদ থাকে আইন প্রণয়ন করার জন্য। বর্তমানে সংসদে আইনজীবীদের বড় অভাব। সংসদে আইনজীবীর সংখ্যা যদি বেশি থাকে, তাহলে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা যাবে।