ব্যবসায়ীদের চাপে ফেলে হয়রানি করা, সিটি করপোরেশনের কাজে প্রভাব খাটানোসহ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ছিল।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর ২০১৪ সালে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা এবং দলের সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ দেওয়া হয়।
জাহাঙ্গীর আলম গতকাল বলেছেন, যদি তাঁকে সরকার গ্রেপ্তার করতে চায়, তবে প্রকাশ্যে বললেই হবে। তিনি আত্মসমর্পণ করবেন।
জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মেয়রের পদ ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের চাপে ফেলে বিভিন্ন সময় হয়রানি করার অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগের কথা সরকার ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকেও জানিয়েছিলেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের অনেকে। এর মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগ ওঠে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে গত শুক্রবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে একজন নেতাও জাহাঙ্গীরের পক্ষে কথা বলেননি। এ বৈঠকেই তাঁর ‘ভাগ্য’ নির্ধারিত হয়।
সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের রাস্তা সম্প্রসারণে বিনা ক্ষতিপূরণে জমি অধিগ্রহণের জন্য লিখিত অঙ্গীকারনামা দিতে কারখানা কিংবা জমির মালিকদের অনেকটা বাধ্য করতেন মেয়র জাহাঙ্গীর। অঙ্গীকারনামা না দিলে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন না করাসহ নানা ধরনের ঝামেলায় ফেলতেন। একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এ রকম একটি অঙ্গীকারনামা নেওয়া হয়। বিষয়টি তিনি মন্ত্রিসভার এক সদস্যকে জানান এবং অঙ্গীকারনামার অনুলিপিও দেন।
ওই অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ ছিল, ওই ব্যবসায়ীর কারখানার পাশের রাস্তাটি ভবিষ্যতে ৪০ ফুট থেকে ৮০ ফুট সম্প্রসারণ করা হলে বিনা ক্ষতিপূরণে তিনি কারখানার জমি ছেড়ে দেবেন তিনি। কোনো স্থাপনা থাকলে নিজ খরচে অপসারণ করে নেবেন। কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন না।
দলীয় সূত্র বলছে, বিভিন্ন কারখানার বিরোধ মেটানোর নাম করেও ব্যবসায়ীদের হয়রানি করতেন মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। এ ছাড়া গাজীপুরে প্রচুর ওয়াজ মাহফিল হয়। এসব মাহফিলের অনেকগুলোতে সরকারের নীতিবিরোধী বক্তৃতা দেওয়া হতো। এসব ওয়াজ মাহফিল আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন জাহাঙ্গীর। এসব বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জাহাঙ্গীরের বিতর্কিত বক্তব্যের অডিও ক্লিপ গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশ পাওয়ার পর সরকার ও দলের ভেতর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জোরালো হয়।
দলীয় সূত্র বলছে, জাহাঙ্গীর মনে করেছিলেন কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত তাঁকে রক্ষা করবেন। সম্প্রতি দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের এক সভায় দু-একজন দায়িত্বশীল নেতা জাহাঙ্গীরকে একবার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে শীর্ষ নেতৃত্বকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার অনড় মনোভাবের কারণে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে আর এগোননি। গত শুক্রবার দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে ২০ জনের বেশি নেতা বক্তব্য দেন। সবাই একবাক্যে জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার, এমনকি মেয়র পদ থেকে অপসারণের বিষয়ে মত দেন।
এর আগে ২০১৪ সালে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রিসভা এবং দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর দলের সাধারণ সদস্যপদ থেকেও তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এর জেরে তিনি সংসদ সদস্যপদও হারান।
মন্ত্রিসভার একজন প্রভাবশালী সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনেক জনপ্রতিনিধি ও দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ‘আমলনামা’ রয়েছে। সময় এলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন প্রধানমন্ত্রী। আবার পরিস্থিতি বুঝে কখনো–কখনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতেও দেরি করেন না। মন্ত্রিসভার ওই সদস্য বলেন, জাহাঙ্গীর আলম অল্প বয়সে অনেক কিছু পেয়েছেন, টাকার মালিক হয়েছেন। এ জন্য কোনো কিছুই পাত্তা দিতে চাননি। তাঁর ধারণা ছিল, তাঁকে রক্ষায় কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে। কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্ব রুষ্ট হলে কেউ এগিয়ে আসবে না—এটা হয়তো তাঁর মাথায় ছিল না।
দলীয় সূত্র বলছে, জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুরের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটা পক্ষের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী আজমতউল্লাহ খানের পরাজয়ের পেছনে জাহাঙ্গীরের ভূমিকা নিয়ে দলে আলোচনা ছিল। কিন্তু এরপরও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১৫ সালে তাঁকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করার পেছনে কেন্দ্রীয় নেতাদের একটা অংশের জোর তৎপরতা ছিল। ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীর আলম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বড় ধরনের আঘাত করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যে শাস্তি হয়েছে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তিনি বলেন, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ন্যায়পাল। তাঁর কাছে ন্যায্য বিষয় তুলে ধরলে ন্যায়বিচার হবেই।
দল থেকে বহিষ্কারের পর জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদও হারাচ্ছেন বলে সরকার ও দলের সূত্রগুলো এমনটাই বলছে। তবে এটা কোন প্রক্রিয়ায় হবে—এটা নিয়ে নীতিনির্ধারকেরা কাজ করছেন। একটি মত হচ্ছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা সংবিধান লঙ্ঘনের মামলা করা হবে। দু-এক দিনের মধ্যেই এ প্রক্রিয়া শুরু হবে। তখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁকে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত করবে।
জাহাঙ্গীর মনে করেছিলেন কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত তাঁকে রক্ষা করবেন। সম্প্রতি দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের এক সভায় দু-একজন দায়িত্বশীল নেতা জাহাঙ্গীরকে একবার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে শীর্ষ নেতৃত্বকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার অনড় মনোভাবের কারণে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে আর এগোননি।
এরই মধ্যে গ্রেপ্তার–আতঙ্কে ভুগছেন জাহাঙ্গীর আলম। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আইনের ফাঁকফোকরে যদি আপনারা কোনোভাবে আমাকে অ্যারেস্ট (গ্রেপ্তার) করতে চান, তবে প্রকাশ্যে বলবেন। আমি নিজেই আপনাদের কাছে সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করব। তা–ও অনুরোধ করব, আপনারা আমাকে মিথ্যা কোনো কলঙ্ক দিয়েন না।’
জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কারের পর গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, মহানগর কমিটির ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এখন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করবেন। মহানগরের ওয়ার্ডগুলোর আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। থানা কমিটি হওয়ার পর সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হবে।
এদিকে দল থেকে বহিষ্কারের পর প্রাথমিক সদস্যপদ টিকিয়ে রাখার আকুতি জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছেন, বাকি জীবন আওয়ামী লীগের সাধারণ সদস্য ও সমর্থক হয়ে থাকতে চান। কথা বলার একপর্যায়ে তিনি কাঁদতে থাকেন।
ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে উঠে আসা জাহাঙ্গীর পরে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও স্থান পান। এরপর গাজীপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান হন। ২০১৫ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ৩৯ বছর বয়সে ২০১৮ সালে গাজীপুর সিটির মেয়র নির্বাচিত হন।
প্রশ্নপত্রে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননার অভিযোগে ২০১৭ সালে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় চট্টগ্রামে ১৩ জন শিক্ষককে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে তাঁরা জামিনে মুক্ত হন। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়।
আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ ওঠার পর বিভিন্ন সময়ে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা যেত। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বিরোধী দলের কেউ বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করে বক্তব্য দিলে আইনি ও রাজনৈতিকভাবে কঠোর অবস্থান নেওয়া প্রশ্নবিদ্ধ হতো। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের কাছে আবেগের জায়গা।
২০১৮ সালে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় জাতির পিতাকে অবমাননার দায়ে কড়া শাস্তির বিধান রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে ওই ব্যক্তির সেটা অপরাধ হবে। এ অপরাধে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে দায়ী ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকার অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এদিকে জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর সিটি মেয়রের পদে থাকবেন কি না, এ বিষয়ে গতকাল ঢাকার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি (জাহাঙ্গীর আলম) তো এখন মেয়র আছেন। কত দিন থাকবেন, সেটা আইনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। তাঁর ব্যাপারে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়, আইনগত দিকগুলো দেখে তারপর বলা যাবে।