রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: একটি দলনিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্মের সন্ধানে

ছাত্রলীগের নির্যাতনের প্রতিবাদে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। ১৬ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে
ছবি: শহীদুল ইসলাম

শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে, তবে আশার কথা এর প্রতিবাদের রূপটিও প্রকাশমান। কিন্তু এই প্রতিবাদের মাত্রাটি অতি ক্ষীণ। কেন? এটি কি কেবলই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আত্মকেন্দ্রিকতার কারণ? এটি একটি কারণ বটে, তবে এর প্রধান কারণ হচ্ছে ভয়ের সংস্কৃতি। কিসের ভয়? কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকেও সেই দলের লেবেলে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয়। ভুল তকমা জীবনব্যাপী বহনের ভয়। শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ‘সরকার পক্ষের’ ও ‘সরকারবিরোধী’—এই দুই দলে চূড়ান্তভাবে বিভক্তকরণের প্রচেষ্টার পরিণতিতেই এই ভয়ের উদ্রেক। কোনো বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সক্রিয় কর্মী না হলে যে তার মধ্যে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সযত্নে লালিত হবে না, এই ধারণা যেমন অসত্য, তেমনই ভয়াবহ হলো তাঁকে বিরোধী দলে সমর্থক রূপে চিহ্নিত করা। এই চিহ্নিতকরণের আতঙ্ক আমাদের নতুন প্রজন্মকে ন্যায়সংগত প্রতিবাদে বিরত রাখছে।

সুদীর্ঘ শিক্ষকজীবনে দলীয় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছি, যার খেসারত মাঝেমধ্যে দিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বা জাতীয় যেকোনো সংকটে মানববন্ধন, সম্মেলনে উপস্থিত থেকেছি, তবে মাঝেমধ্যে অনুভব করেছি—প্রতিবাদের মঞ্চগুলো সব সময় রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ থাকেনি, যা ছিল আমাদের জন্য একধরনের বিভ্রান্তি। আশার কথা, এমতাবস্থায় বছর চারেক আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ গ্রুপ তৈরি হয়েছে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়নবিরোধী ছাত্র-শিক্ষক ঐক্য’ নামে। অথচ এখান থেকেও কীভাবে নিরপেক্ষতা ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে এবং তা রক্ষায় আমাদের করণীয় কী, তাই এ লেখার উপজীব্য। আমি শিক্ষার্থীদের কাছে শতভাগ নিশ্চিত হলাম, এটি রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ একটি কর্মসূচি।

যত দূর মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে তাঁদের প্রথম মানববন্ধনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক হিসেবে একমাত্র আমি ছিলাম। কিছুদিন পর তাঁদের আরেকটি মানববন্ধন হয় সিনেট ভবনের সামনে। ক্লাসের বাইরে যেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সাংগঠনিক অবস্থান থাকে (যেমন প্রথম আলো বন্ধুসভা, আবৃত্তি সংগঠন স্বনন, দেশব্যাপী বিতর্ক অনুষ্ঠান, শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্ব পালন ইত্যাদি)। আমি তাঁদের সঙ্গে কথা বলায় আগ্রহী থাকি। তাঁদের স্বপ্ন, তাঁদের জীবনসংগ্রাম, তাঁদের সমস্যা ও সংকট নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে। সেদিনও মানববন্ধনে শিক্ষক নয়, শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ একজন শিক্ষকের বক্তব্যে হতচকিত হলাম। তিনি একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনকে বকাবকি করছেন। আমরা দলনিরপেক্ষ ছাত্র-শিক্ষকেরা একটি শান্তিপূর্ণ, কল্যাণকামী কর্মসূচিতে এসেছি, কাউকে বকাবকি করার উদ্দেশ্যে নয়। আবরার হত্যাসহ শিক্ষাঙ্গনে সব হত্যা এবং সব ধরনের নিপীড়নের প্রতিবাদ করে তা বন্ধের উদ্যোগ নিতে এসেছি।

আমরা সরকারবিরোধী নই, প্রশাসনবিরোধী নই। বরং প্রশাসনের যেখানে ক্ষত রয়েছে, তা চিহ্নিত করে সেটিকে সারানোর জন্য যেকোনো প্রশাসনের পাশেই থাকতে চাই। শিক্ষাঙ্গনকে টর্চার সেলমুক্ত রাখতে, সন্ত্রাসমুক্ত রাখতে, সিট বাণিজ্যমুক্ত রাখতে প্রশাসন ও রাষ্ট্রকে সহায়তা করতে চাই।

আজ টর্চার সেলগুলোর কথা জনসমক্ষে এসেছে বলেই তা বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে। হল থেকে অছাত্র বহিষ্কার সম্ভব হচ্ছে। প্রভোস্টদের বক্তব্যে জানা যাচ্ছে, অপরাজনীতির করাল হাত কীভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালনে বাধাগ্রস্ত করেছিল। আমরা এই বাধাগুলো দূর করতে চাই। আমরা তো কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি উষ্মা প্রদর্শনের জন্য এখানে সমবেত হইনি। ফলে আমাদের স্বপ্নভঙ্গ হলো একটি রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম পাওয়ার। ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়নবিরোধী ছাত্র-শিক্ষক ঐক্য’ গ্রুপের প্রতি আমার প্রস্তাব থাকবে—এখানে হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, নয়তো যেসব শিক্ষক-শিক্ষার্থী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবেন, তাঁদের অন্তর্ভুক্তি যেন এখানে না ঘটে, তা না হলে গ্রুপটি তার নিরপেক্ষতা হারাতে বাধ্য।

আজ একজন সাহসী স্নেহভাজন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন এবং আরও সাহসী শিক্ষার্থী ফুলপরী কেবল একজন বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীই নন, তাঁরা লক্ষ লক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর দ্রোহ ও নৈতিকতার আগুনে জ্বলে ওঠার তাড়নায় অপেক্ষমাণ এক স্ফুলিঙ্গের প্রতীক। তাঁদের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ, নৈতিকতায় বলীয়ান, মেরুদণ্ড সোজা রেখে দাঁড়ানোর জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম।

আমরা আরেকবার আশাবাদী হয়েছিলাম, ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি ফোরামের আবির্ভাবে। এই গ্রুপের সদস্যরা নিজেদের গবেষণাকর্মের কথা, গবেষণাসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ পাঠানোর নিয়মনীতি, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরের বিশ্লেষণ, বৃত্তির খবরাখবর ইত্যাদি জানাতেন যা বিশেষত নবীন শিক্ষকদের জন্য সহায়ক ছিল। কিছুদিন পর দেখা গেল, এখানেও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির আস্ফালন। কেউ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও প্রশাসনের সমালোচনা করছেন, আবার কেউ অন্যায়কারী শিক্ষকদের পক্ষে তাঁদের ঢাল হয়ে দাঁড়াচ্ছেন, চাপা পড়ে যাচ্ছে মেধাবী শিক্ষকদের কার্যক্রমের খবর।

রাজনৈতিক দলের তল্পিবাহক শিক্ষকেরা ভুলে যাচ্ছেন দলাদলি ও উষ্মা উদ্‌গীরণের জন্য ফোরামটির জন্ম হয়নি। জ্ঞান বিতরণ, জাতীয় সংকট চিহ্নিতকরণ ও তার সমাধানের প্রস্তাব, শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি ও হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধারের আন্দোলন—এসব হারিয়ে গ্রুপগুলো ক্রমেই হয়ে উঠছে রাজনৈতিক দলগুলোর লিফলেটস্বরূপ।

একইভাবে ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়নবিরোধী ছাত্র-শিক্ষক ঐক্য’–এর সদস্যদের সতর্ক থাকতে হবে, ফোরামটি যেন কোনোভাবেই কোনো রাজনৈতিক দলের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত না হয়। সব রাজনৈতিক দলকে একই ছাতার নিচে নিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণের জন্য কাজ করার উদ্যোগ বহুবার নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ একটি প্ল্যাটফর্মের। এ ছাত্র–শিক্ষক ঐক্যকে কলুষিত হতে না দেওয়ার চেষ্টা এর দলনিরপেক্ষ সদস্যদের করতে হবে।

প্রশাসনকেও অনুধাবন করতে হবে, দলটি সরকার কিংবা প্রশাসনবিরোধী নয়, বরং প্রশাসনকে শক্তিশালী করার জন্য, তাকে বাইরের প্রভাবমুক্ত রেখে দায়িত্বপালনে সহায়তা দেওয়ার জন্য তাদের পাশে আছে। আমি বহু মেধাবী, সৎ, নির্লোভ শিক্ষককে প্রশাসনে সম্পৃক্ত হওয়ার পর তাঁদের এথিক্যাল ডিলেমা বা নৈতিক উভয় সংকটে থাকার মর্মপীড়া দেখেছি। দলটি তাদের নৈতিক দায়িত্ব পালনে সহায়তা দিতে পারে। প্রায় দেড় যুগ আগে প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয় বিভাগে প্রকাশিত ‘এখনই সময় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর’ (প্রথম আলো, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০৫) শীর্ষক আমার লেখাটিতে বলেছিলাম, ‘আমরা নিজেদের অজান্তে বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণের ভার তুলে দিচ্ছি অন্যের হাতে।’ এই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর একটি ঢাল হতে পারে প্ল্যাটফর্মটি। প্রশাসন একে তার ‘থার্ড আই’ রূপে কাজে লাগাতে পারে।

আজ একজন সাহসী স্নেহভাজন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন এবং আরও সাহসী শিক্ষার্থী ফুলপরী কেবল একজন বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীই নন, তাঁরা লক্ষ লক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর দ্রোহ ও নৈতিকতার আগুনে জ্বলে ওঠার তাড়নায় অপেক্ষমাণ এক স্ফুলিঙ্গের প্রতীক। তাঁদের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ, নৈতিকতায় বলীয়ান, মেরুদণ্ড সোজা রেখে দাঁড়ানোর জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম।

কেউ একজন বলেছিলেন, ‘একমাত্র শিশু ও পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নন।’ আমরা এখনো কিছু পাগল রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিমুক্ত শিক্ষাঙ্গনের স্বপ্ন দেখি বলেই উভয় দলের সরকার তাদের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময় প্রশাসনরে উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি প্রস্তাব কয়েকবার পেয়েও তা ফিরিয়ে দিতে পেরেছি। সেদিনও একইভাবে বিভ্রান্তি ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে এই মানববন্ধন থেকে বেরিয়ে এসেছি। হয়তো এসবই পলায়নপরতা। তবে একটি রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্মের স্বপ্ন এখনো দেখি, স্বপ্ন দেখি এ প্রাণের স্পন্দন জড়িয়ে আছে যে প্রিয় ক্যাম্পাসে, সেখানে সব শিক্ষার্থীর নির্ভয় পদার্পণের। স্বপ্ন দেখি দেশ গড়ার প্রত্যয়ে দীপ্ত নির্লোভ, সাহসী প্রজন্মের, যাঁরা শিক্ষাঙ্গনকে দেখবে কেবলই মেধাবিকাশের তীর্থস্থানরূপে।

  • সুলতানা মোসতাফা খানম অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়