নাগর নামে দেশে দুটি নদ আছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রকাশিত গ্রন্থে একটিকে ‘আপার নাগর’, অপরটিকে ‘লোয়ার নাগর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। আপার নাগর ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় দিয়ে প্রবাহিত। এটি বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্তীয় নদ। লোয়ার নাগর নদটি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় করতোয়া নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে নওগাঁ জেলার ওপর দিয়ে নাটোরের সিংড়া উপজেলায় গুড় নদে মিলিত হয়েছে। এ নদের উৎস ও মিলন উভয়স্থল আমি সরেজমিন ঘুরে দেখেছি। এটি গুরুত্বপূর্ণ নদ। এ নদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নওগাঁর কালীগ্রাম জমিদারি দেখার জন্য বজরা নিয়ে এ নদপথে পতিসরে যেতেন। পতিসর কাছারিবাড়ি নাগর নদের ঘাটসংলগ্ন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা যাওয়ার চার বছর আগে ১৯৩৭ সালে সর্বশেষ পতিসরে গিয়েছিলেন। সেবার জমিদারি দেখতে যাননি। গিয়েছিলেন তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। কালীগ্রাম রথীন্দ্রনাথ ইনস্টিটিউশনের উদ্বোধন উপলক্ষে যে বাণী তিনি প্রদান করেছিলেন, তার অংশবিশেষ ওই প্রতিষ্ঠানের ফলকে উৎকীর্ণ হয়ে আছে। সেখানে লেখা, ‘রথীন্দ্রনাথের নামচিহ্নিত কালীগ্রামের এই বিদ্যালয়ের আমি উন্নতি কামনা করি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকের সম্বন্ধ যেন হয় অকৃত্রিম স্নেহের এবং ধৈর্যের দ্বারা সত্য ও মধুর হয়। এই আমার উপদেশ। শিক্ষাদান উপলক্ষে ছাত্রদিগকে শাসন–পীড়নে অপমানিত করা অক্ষম ও কাপুরুষের কর্ম—এ কথা সর্বদা মনে রাখা উচিত।’
গত বছর আমি পতিসরে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক উদয় শঙ্কর বিশ্বাস এবং বাংলা বিভাগের শিক্ষক সৈকত আরেফিন। সেখানে দুদিন ধরে নাগর নদের অবস্থা দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিন্নপত্রতে এ নদের অনেক বাঁকের কথা লিখেছেন। বাস্তবেও লক্ষ করলাম, অনেক সর্পিলাকৃতির নদের তুলনায় এর বাঁক যেন কিছুটা বেশি। এক বিকেলে ভ্যানযোগে নদের পাড় ধরে কালীগ্রাম বাজারে গিয়েছিলাম। বাজারটি নদের পাড়েই গড়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১১১ বছর আগে যে বর্ণনা দিয়ে গেছেন, তার কিছু বাস্তবতা এখনো মেলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিন্নপত্রতে লিখেছেন, ‘নদী পর্যন্ত একটি গড়ানে কাঁচা ঘাট, সেখানে কেউ কাপড় কাচছে, কেউ নাইছে, কেউ বাসন মাজছে; কোনো কোনো লজ্জাশীলা বধূ দুই আঙুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে কলসি কাঁখে জমিদার বাবুকে সকৌতুকে নিরীক্ষণ করছে। তার হাঁটুর কাছে আঁচল ধরে সদ্যঃস্নাত একটি তেলচিক্কণ বিবস্ত্র শিশুও একদৃষ্টে বর্তমান পত্রলেখক সম্বন্ধে কৌতূহল নিবৃত্তি করছে। তীরে কতগুলো নৌকা বাঁধা এবং একটি পরিত্যক্ত জেলেডিঙি অর্ধনিমগ্ন অবস্থায় পুনরুদ্ধারের প্রতীক্ষা করছে।’ রবীন্দ্রবর্ণনার মতো দেখলাম, নৌকা দিয়ে এ নদ পারাপার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এতে অনেকেই স্নান করছেন, গরুকে স্নান করাচ্ছেন, কাপড় কাচছেন, বাসন মাজছেন।
এরপর নাটোরের সিংড়া উপজেলায় যাই নাগর আর গুড় নদের মিলনস্থল দেখার জন্য। সিংড়ায় আত্রাই সেতু থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে নাগর এসে গুড় নদে মিলিত হয়েছে। এ নদের উৎস ও পতিত হওয়া নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছিল। শতবর্ষ আগে যখন নদটি প্রবাহিত হতো, তখন বগুড়া থেকে এসে নাটোরে মিলিত হয়েছিল। বর্তমানে উল্টো। পতিসরে নদের প্রবাহের কথা শুনে মনে হলো—এখন উল্টো দিকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ বিষয়ের অস্পষ্টতা দূর করতে সহায়তা করেন নদী–গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘নদটির পরিচর্যা না থাকার মানবসৃষ্ট কারণে পানি অনেক স্থানে উল্টো দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এ রকম ঘটনা দেশের অনেক নদ–নদীতে ঘটে থাকে।’
পূর্ববঙ্গে থাকাকালে যে নদ–নদীগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে, নাগর সেগুলোর অন্যতম। পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নদ–নদীনির্ভর যাপিত জীবন তাঁর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। জীবনব্যাপী তার প্রভাব অনস্বীকার্য। তাঁর ছিন্নপত্র নদ–নদীকথনেরই নামান্তর। তবে ছিন্নপত্র–তেই যে নদী প্রসঙ্গ বারবার এসেছে, তা নয়। ‘নদী’ শিরোনামে তাঁর দীর্ঘ কবিতা আছে, যেখানে নদীবিজ্ঞান প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। শেষ জীবনে তিনি লিখেছেন, ‘নদীর পালিত এই জীবন আমার’।
পতিসরে দেখলাম, নদটিতে প্রকাশ্যে চলছে দখল। রবীন্দ্রর কাছারিবাড়ির কাছেই নদটির ওপর অনেক দোকান গড়ে উঠছে, ফেলা হচ্ছে অনেক আবর্জনা। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাদের কেউ কেউ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কোনো সুফল পাননি। হাল ছেড়েছেন এখন।
রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত এ নদের প্রতি সরকারের বিশেষ দৃষ্টি প্রয়োজন। নদপাড়ের জনগণেরও দায়িত্ব আছে নদটি রক্ষা করার। রাষ্ট্র, জনগণ—সবারই উদাসীনতায় নদটি কি তবে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে?
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail.com