আজ শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা। পৃথিবীর সব বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর নিকট দিনটি পরম শুভ, বিশেষ ও স্মরণীয় দিন হিসেবেই বিবেচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৩ সালে, অর্থাৎ ২ হাজার ৫০০ বছরের আগে বর্তমান নেপালের কপিলাবস্তু নগরের শাক্যবংশের এক বর্ধিষ্ণু রাজপরিবারে রানি মহামায়ার গর্ভে বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেন। এই শিশুর আনুষ্ঠানিকভাবে নাম রাখা হয় সিদ্ধার্থ আর পারিবারিক উপাধি ছিল গৌতম। এই দুই মিলে হয়েছে সিদ্ধার্থ গৌতম। যিনি পরবর্তীকালে রাজসুখ ছেড়ে একজন সাধারণ নাগরিকের মতো গভীর ধ্যান ও কঠিন তপস্যার মাধ্যমে জীবন সম্পর্কে স্বীয় জ্ঞানে, স্বীয় চিন্তায়, স্বীয় চেতনায় এমন কিছু বুঝতে ও বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং যে সত্য তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, সে বিষয়ে গৌতমের আগে অন্য কেউ ঠিক সেভাবে ব্যাখ্যা বা আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি।
যে সত্য বুদ্ধ আবিষ্কার করেছিলেন, সেখানে ঈশ্বর, দেব–দেবীর স্থান নেই, নরকের ভয় আর স্বর্গের প্রলোভন নেই, জোরজবরদস্তি নেই। বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ এবং মৃত্যু—এই তিনটি ঘটনা একই পূর্ণিমার তিথিতে একই দিনে ঘটেছে বলে দিনটি বিশেষ দিন হিসেবে বৌদ্ধরা প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় ও শ্রদ্ধাভরে উদ্যাপন করে থাকেন। সিদ্ধার্থ গৌতমের প্রচারিত মতবাদের অন্যতম কয়েকটি বিষয় হচ্ছে পৃথিবীর সব শ্রেণি-পেশার, উঁচু-নিচু, সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র সব মানুষের প্রতি অহিংসার আহ্বান, সব জীবের প্রতি করুণা, দয়া প্রদর্শন ও পৃথিবীর সবার জন্য সুখ কামনা করা।
বুদ্ধের অনেক মূল্যবান বাণীর মধ্যে এটি হচ্ছে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ—‘দ্য ধম্ম দ্যাট আই টিচ ক্যান বি আন্ডারস্টুড অনলি বাই দোজ হু নো হাউ টু থিঙ্ক।’ স্বল্প কথায় বৌদ্ধধর্ম একটি প্রতিদিনের আচরিত ও জীবনঘনিষ্ঠ মতবাদের সমাহার। যেখানে মানুষকে অকারণে ভীতি প্রদর্শন ও অযৌক্তিক প্রলোভনের আকর্ষণ—এই দুইকে পরিহার করা হয়েছে। তদুপরি মানুষের নিজের মনকে, চিন্তাকে, চেতনাকে ও উপলব্ধিকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে।
গৌতম স্বীয় চিন্তার দ্বারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন, এই জীবনে ভালো থাকার এবং অন্যকে ভালো রাখার জন্য কোনো কাল্পনিক ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখার আবশ্যকতা নেই। অলৌকিক সত্তার ভয় দেখিয়ে বস্তুত কোনো মানুষকে খারাপ কাজ থেকে নিবৃত্ত বা বিরত করা যায় না। বরং প্রথমেই মানুষের মনকে বোঝাতে হবে। ভালো বা মন্দ যা-ই হোক, তা মানুষের মনেই প্রথমে আসে। সুতরাং এই মনকে প্রথমে প্রশিক্ষিত করে নিতে হবে। এখানে যে যেমন কর্ম করবে, সে ঠিক তেমন ফলই পাবে। যেমন কেউ যদি প্রখর রোদে নিরবচ্ছিন্ন চলাচল বা দৌড়াদৌড়ি করে, তারই অসুস্থ বা জ্বর হওয়ার আশঙ্কা থাকবে, অন্য কারও নয়। ঠিক তেমনি যার হিংসা থাকবে, সে-ই হিংসার দ্বারা আক্রান্ত হবে। অপরিমিত লোভ, সীমাহীন ভোগবাদিতা মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে, অন্যায় কাজে উদ্বুদ্ধ করে। সে ক্ষেত্রে একজন আরেকজনের ওপর অন্যায়ভাবে ক্ষমতা বা জোর খাটাতে চায়।
আমাদের এই মানবজীবন মূলত দুঃখের সমষ্টিমাত্র। সিদ্ধার্থ চারটি আর্যসত্যের মাধ্যমে এভাবে এই দুঃখের ব্যাখ্যা দিয়েছেন:
ক. জীবনে দুঃখ আছে ও জীবন দুঃখময়;
খ. এ দুঃখের কারণও আছে, আর এর কারণ হলো অজ্ঞতা;
গ. এ দুঃখ থেকে নিবৃত্তি পাওয়া যায়। অজ্ঞতা দূর হলেই মানুষ এ দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে;
ঘ. দুঃখ মুক্তির উপায়ও আছে। আর এই মুক্তি মিলবে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করলে।
আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ
বর্ণিত দুঃখবাদ থেকে মুক্তির জন্য এই আটটি পথ বা মার্গই হচ্ছে সর্বোত্তম পথ:
ক. সম্যক দৃষ্টি;
খ. সম্যক সংকল্প;
গ. সম্যক বাক্য;
ঘ. সম্যক কর্ম বা আচরণ;
ঙ. সম্যক জীবিকা;
চ. সম্যক চেষ্টা;
ছ. সম্যক স্মৃতি;
জ. সম্যক সমাধি।
বর্তমানে আমাদের চতুষ্পার্শ্বে অহরহ দেখতে পাচ্ছি, মানুষ এত উন্নতি, এত অগ্রগতি, এত বিত্তবৈভবের মধ্যে থেকেও কোথায় যেন সে মনের শান্তি পাচ্ছে না। অশান্তি আর অসন্তোষের বেড়াজালে সে যেন আটকা পড়ে আছে। হিংসা আর অপরকে অবদমনের এক উদগ্র বাসনা, অন্যকে অন্যায়ভাবে শাসন–শোষণের এক উন্মত্ত ইচ্ছা, অপরকে নিচ, পদতলে রাখার অপপ্রয়াস দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে প্রযুক্তিতে, শিল্পে, শিক্ষায়, প্রগতিতে মানুষ আধুনিক হয়েও কেন যেন দিন দিন অবিবেচক আর স্বার্থপর হয়ে উঠছে। তাই আজ আমরা দেখি, এক দেশ আরেক দেশের বিরুদ্ধে, একই দেশেই এক ধর্মের লোক ভিন্নধর্মের, ভিন্নমতের ভিন্ন সম্প্রদায়ের অনিষ্ট করতে লেগে আছে। সবাই মনে করছে, সে যা করছে, একমাত্র তা-ই ঠিক ও যথাযথ আর বাকিরা হয় ভুল, নয়তোবা বিপথে রয়েছে।
মানুষের মধ্যে সহনশীলতার অভাব, পরমতের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ও অত্যাচারী দৃষ্টিভঙ্গি হানাহানি বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেন যেন নিজের মত, নিজের বিশ্বাস, নিজের ধ্যানধারণা অন্যকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া, অন্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তুলে দিলেই মনে করছে বৈতরণি পার হওয়া যাবে। এতে দিন দিন বাড়ছে হিংসা, হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত জোরজবরদস্তির ঘটনা এবং আরও কত–কী?
জীবনের সব ক্ষেত্রে ধর্মকে দিয়ে সব বিষয় বিচার-বিবেচনা করা অযৌক্তিক। তা ছাড়া ধর্মের কষ্টিপাথরে বিচার করতে গেলে নানা ক্ষেত্রে অমিল, অশান্তি, বিভেদ লেগেই থাকবে। আজকের এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে এই অস্থিরতার সময়ে সব মানুষের প্রতি মৈত্রীর আহ্বান নিয়ে, অহিংসার বাণী নিয়ে, শান্তির বারতা নিয়ে সিদ্ধার্থ গৌতমের পুনরাগমন আবশ্যক হয়ে পড়েছে। যাঁর অমিয় বাণী, অহিংস মনোভাব, সব জীবের প্রতি প্রেমের আহ্বান বিবেচনায় নিয়ে বলতে হয়, ‘তুমি বারবার এসো এ ধরণিতলে হে সিদ্ধার্থ গৌতম।’ জগতের সব প্রাণী সুখী হোক, শান্তিতে থাকুক।
ক্যাপ্টেন (অব.) অসীম বরন চৌধুরী
বাংলাদেশ নৌবাহিনী