আমাদের সেই তরুণ সময়ের এক উজ্জ্বল দিন ছিল ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২ সাল। সেদিন আইয়ুব শাসনবিরোধী সাহসী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেদিনের সেই ধর্মঘট আর মিছিলে আমিও ছিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয়েছিল, মিছিল হয়েছিল, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল। এরপর প্রায় সপ্তাহজুড়ে ঢাকা এবং সারা দেশে এই ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, ১৪৪ ধারা জারি, হল অবরোধ, নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই ছাত্র আন্দোলনের স্লোগান ছিল: সামরিক শাসন চাই না, কথা বলার অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, নির্বাচন চাই ও গণতন্ত্র চাই।
সেদিন যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল। সে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আইয়ুব সরকারের পতন হয়েছিল, শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীরা মুক্তি পেয়েছিলেন এবং সামরিক সরকার সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। তখন দেশে সামরিক শাসন থাকলেও সাহসী সাংবাদিকতা ছিল।
ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন শেষ করে ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলাম। সেটা তখন বেআইনি ঘোষিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ছিল। সে সময়ে সামরিক শাসনের মধ্যেও আমরা পত্রিকায় রাজনৈতিক অধিকার, নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলেছি। সর্বশেষ ২৫ মার্চ রাতে পৃষ্ঠাজুড়ে ‘সর্বাত্মক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হউন’ শিরোনামে পত্রিকা বের করেছিলাম। ২৬ মার্চ সে পত্রিকা আর বিলি হতে পারেনি। ততক্ষণে আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা তখন এক নতুন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে দিনরাত কাজ করেছি। আবার বাহাত্তর সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন করে সাপ্তাহিক একতা পত্রিকা বের করেছি।
আশা করেছিলাম, ১৯৭৩ সালের সংবিধান অনুযায়ী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে জরুরি আইন জারি এবং ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে শেখ মুজিব একদলীয় বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ) শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। দেশে সে সময় চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের সাপ্তাহিক একতাও বন্ধ হয়ে যায়। সেই ’৬২ সাল থেকে যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছি, স্বাধীন বাংলাদেশে সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেল। সংগঠন করার স্বাধীনতা থাকল না। গণতন্ত্রও রইল না। প্রতিষ্ঠিত হলো একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও সামরিক শাসন জারি হলে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। সারা দেশে এক অস্বাভাবিক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরে সামরিক শাসক জিয়ার শাসনামলে দেশে রাজনীতি পুনঃপ্রচলনের সময়ে একতা পুনঃপ্রকাশের অনুমতি পাওয়া যায়। ১৯৭৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথম শুক্রবার সাপ্তাহিক একতা পুনঃপ্রকাশিত হয়। আমরা নতুন উদ্দীপনা নিয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সোচ্চার হই। সেই দিনগুলোতে বহু বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অনেক সাহস নিয়ে সাংবাদিকতার কাজ করতে হয়েছে।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবার জটিল হয়ে পড়ে। শুরু হয় এরশাদের স্বৈরশাসন। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ১৫ মে এরশাদের নির্দেশে সাপ্তাহিক একতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় ১০ মাস বন্ধ থাকার পর ১৯৮৭ সালের মার্চে আবার একতা চালু হয় এবং এরশাদের পতনের গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
শেষ পর্যন্ত এরশাদের পতনের পর সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তার কিছুদিন পর ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমরা নব উদ্যমে দৈনিক ভোরের কাগজ-এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে নতুন পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করি। তখন নতুন সময়ে নতুন প্রত্যাশায় আমরা দৃঢ়ভাবে দলনিরপেক্ষ ও স্বাধীন সংবাদপত্র হিসেবে দৈনিক ভোরের কাগজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেষ্টা করি।
মনে পড়ে, ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি সরকার ভোরের কাগজ-এর সব সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছিল। কারণ, আমরা বিএনপি সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম ও দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ এবং সমালোচনা করছিলাম। সরকারি বিজ্ঞাপন ফিরে পেতে বহুমুখী আন্দোলন, এমনকি আমরা রাস্তায় মিছিলও করেছি। সে সময় আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধি ও আমার বিরুদ্ধে বগুড়া, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ অনেক জায়গায় মামলা হয়েছে। জামিন পেতে জেলায় জেলায় যেতে হয়েছে।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। তারা সরকার গঠন করে। আমরা ভোরের কাগজ পত্রিকায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখি। কিন্তু আবার আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতার কাজে বাধাগ্রস্ত হই। কারণ, ভোরের কাগজ-এর প্রকাশক তখন সরকারি দলের সংসদ সদস্য ও পরে উপমন্ত্রী হন। সরকারের চাপ তিনি আর নিতে পারেননি, শেষ পর্যন্ত ভোরের কাগজ ছেড়ে চলে আসি আমরা।
নতুন করে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে আমরা আবার শতাধিক সহকর্মী নিয়ে প্রথম আলো প্রকাশ করি এবং দৃঢ়ভাবে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতা শুরু করি। সরকারের ভালো কাজের প্রশংসা করি এবং পাশাপাশি সরকারের ব্যর্থতাও তুলে ধরার চেষ্টা করি। একই সঙ্গে বিরোধী দলের অগণতান্ত্রিক রাজনীতির সমালোচনাও করি।
২০০০ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারও প্রথম আলোর সব সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ এবং প্রথম আলো ডটকম অনলাইন সংস্করণও বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সরকারি বিজ্ঞাপন আবার চালু হয় এবং অনলাইনের জন্যও নতুনভাবে অনুমতি পাওয়া যায়।
পাঠকদের একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিই। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন ইউএনবির ফেনীর সাংবাদিক টিপু সুলতানকে ফেনীতে আক্রমণ করে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর অনুসারীরা। প্রথম আলো এ নিয়ে জোরালোভাবে সংবাদ ও মতামত প্রচার করে। আমরা টিপু সুলতানের চিকিৎসার জন্য তহবিল সংগ্রহ করি। সাংবাদিক টিপু সুলতানকে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাংককে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। তাঁর হাতে-পায়ে আটবার অস্ত্রোপচার হয়েছিল।
বিএনপি সরকারের আমলেও সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল শুরুতেই। এবং প্রথম আলোর জন্য বিজ্ঞাপন নির্ধারিত ছিল দৈনিক ১০ কলাম ইঞ্চি। তা ছাড়া তখন বিএনপির নেতারা নানাভাবে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছেন।
এসব কারণে চরম ক্ষিপ্ত হয়ে দুবার (২০০১ সালের ১২ ও ২৬ জুন) সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী প্রথম আলো ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে কুৎসিত বিষোদ্গার করেছিলেন। সেদিন সংসদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
২০০১ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তাদের সব ধরনের অগণতান্ত্রিক এবং দুর্নীতির সব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল প্রথম আলো। বিশেষ করে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়া এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়ে আমরা বহু সত্যানুসন্ধান, বিশেষ প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, মতামত, বক্তব্য, কার্টুন ইত্যাদি করেছিলাম, সেসব কথা আমাদের পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হামলাকারী হিসেবে জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে সরকার সাজানো জবানবন্দি আদায় করে। আমরা সেই সাজানো জবানবন্দি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তদন্ত নিয়েও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করি। সেই বিএনপি সরকারের আমলেও সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল শুরুতেই। এবং প্রথম আলোর জন্য বিজ্ঞাপন নির্ধারিত ছিল দৈনিক ১০ কলাম ইঞ্চি। তা ছাড়া তখন বিএনপির নেতারা নানাভাবে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছেন।
সেখানেই থেমে থাকেননি তাঁরা। সে সময়ের বিএনপি সরকারের আমলে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, সংসদ সদস্য নাসির উদ্দীন আহাম্মেদ (পিন্টু) এবং সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান খাগড়াছড়ির আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া প্রমুখের দুর্নীতি ও নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আমরা সংবাদ ও মতামত প্রকাশ করেছিলাম। তাঁরা প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। খাগড়াছড়িতে মামলা হয়েছিল ২৭টি। কিন্তু কোনো মামলা টেকেনি। আদালত সব মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। এ রকম আরও মামলা হয়েছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে।
২০১৫ সালের আগস্টে সরকার প্রায় ৫০টি বড় দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে মৌখিক নির্দেশ দিয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করতে বাধ্য করে। এর আগেই সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তারপরের ঘটনা, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও গোয়েন্দা সংস্থার সমর্থনে হিযবুত তাহরীর প্রথম আলো পত্রিকা বিক্রিতে বাধা প্রদান করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। আমাদের কয়েকজন সংবাদকর্মীকে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। একটি মহল তখন প্রথম আলো বন্ধ ও সম্পাদককে গ্রেপ্তার করার নানা রকম উদ্যোগও নিয়েছিল। সে জন্য বহু অপপ্রচার চালিয়েছিল তারা।
সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উদ্যোগে সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। এর পর থেকে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে প্রথম আলো নানা রকম চাপ, ভয়ভীতি এবং আক্রমণের মুখে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এ জন্য আমাদের ওপর নানামুখী আক্রমণ এবং অনেক মামলা করা হয়েছে। একসময় মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল এক শর ওপরে। এখন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মিলিয়ে ২৫টি মামলা কার্যকর রয়েছে।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে ২০০৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো এবং এর সম্পাদকের বিরুদ্ধে লতিফ সিদ্দিকী, শাজাহান খান, শেখ সেলিমসহ সরকারদলীয় সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তীব্র আক্রমণ করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁরা প্রথম আলোর সম্পাদককে গ্রেপ্তার এবং সংসদে উপস্থিত করে বিচার ও শাস্তির দাবি করেছিলেন। তারপর থেকে প্রথম আলোর ওপর নানামুখী চাপ অব্যাহত থাকে। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, স্থানীয় ও আঞ্চলিক প্রতিনিধিরা নানাভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হয়েছে প্রথম আলোর সাংবাদিক ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে।
২০১৫ সালের আগস্টে সরকার প্রায় ৫০টি বড় দেশি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে মৌখিক নির্দেশ দিয়ে প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করতে বাধ্য করে। এর আগেই সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, অর্থনৈতিকভাবে প্রথম আলোকে পঙ্গু করে দেওয়া।
২০১৫ সালের ২৭ মে প্রথম খবর ছাপা হয় ঝিনাইদহে ১৫টি কলের লাঙল ক্রয়ে অনিয়ম বিষয়ে। ২ জুলাই দ্বিতীয়বার ছাপা হয় ‘প্রথম আলোর খবর অসত্য নয়, এখনো ৫ জন লাঙল কেনেননি’। জুলাই মাসে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি সংস্থার দুর্নীতি নিয়ে প্রথম আলো প্রতিবেদন করলে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ‘জনস্বার্থে’ সংসদে আমাদের বিরুদ্ধে তিন দিন (১৬ জুন, ১৭ জুন, ৫ জুলাই) বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সংসদে দুটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। ওই প্রতিবেদনের জন্য প্রথম আলোর স্থানীয় সাংবাদিক ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা হয়েছিল। সেসব মামলা পরে আদালতে খারিজ হয়ে গেছে।
সর্বশেষ ২০২৩ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহজুড়ে অতিসাধারণ একটি ঘটনা, সাভার প্রতিনিধির একটি সংবাদকে কেন্দ্র করে অসত্য প্রচার করে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা হয়েছে। সরকার সমর্থক লেখক, শিল্পী, অধ্যাপক, উপাচার্যসহ বিভিন্ন পেশার লোকজনকে পরিকল্পনা করে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে মাঠে নামানো হয়েছিল। সংসদের ভেতরে ও বাইরে প্রচারণা হয়েছে। প্রথম আলোর প্রকাশনা বাতিল, সম্পাদকের গ্রেপ্তার, বিচার ও শাস্তি দাবি করা হয়েছে।
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকার এতটাই বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু।’
এই ঘটনায় সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুটি ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। শামসুজ্জামানকে জেলে যেতে হয়েছে। এর আগে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে হামলা, হেনস্তা এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
প্রথম আলোর স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা নিয়ে অসত্য প্রচার, অপপ্রচার, পত্রিকা বন্ধ, বিজ্ঞাপন বাদ দেওয়াসহ স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বা কোনো অনুষ্ঠানে প্রথম আলোর কোনো প্রতিনিধি বা কারও উপস্থিতির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ছিল। প্রায় সব সরকারি-আধা সরকারি অফিসে পত্রিকা নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সরকার এতটাই বিদ্বেষপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, প্রথম আলো গণতন্ত্রের শত্রু, প্রথম আলো দেশের মানুষের শত্রু।’ প্রথম আলোর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা বা ভিত্তি ছিল না। সাংবাদিকতাসহ প্রথম আলোর সব কর্মকাণ্ডই হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে আর গণতন্ত্র ও জনগণের কল্যাণকে কেন্দ্র করে। প্রথম আলোর সব লেখালেখি, সব প্রচার, সব অনুষ্ঠান এবং সব প্রকাশনার ক্ষেত্রেও সেটাই সত্য। সে জন্যই প্রথম আলো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরেই এ কাজগুলো আমরা ধারাবাহিক ও একনিষ্ঠভাবে করে চলেছি। এর স্বীকৃতিও আমরা পাই আমাদের পাঠকের সক্রিয় অংশগ্রহণে, পাঠকের ভালোবাসায়। প্রতিবছর প্রথম আলোর সাংবাদিকেরা পুরস্কৃত হন দেশের ভেতরে। দেশের বাইরেও বিভিন্ন পুরস্কারসহ স্বীকৃতি পেয়েছে।
অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি করে মত ও সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োজন এখন। মুক্ত আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বা উপদেষ্টারা সজাগ আছেন বলে আমরা মনে করি।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
এটাও মনে করিয়ে দিতে চাই যে প্রথম আলো রাষ্ট্রের সব আইনকানুন মেনে চলে। সরকারের কাছে দেওয়া আমাদের আয়-ব্যয়ের সব হিসাব পরিষ্কার। আর সে জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম আলো ও ব্যক্তি হিসেবে প্রথম আলো সম্পাদক আট বছর ধরেই গণমাধ্যম বিভাগে সেরা করদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
বিগত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নিপীড়ক স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন হয়েছে। প্রায় তিন মাস হতে চলেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। ভেঙেচুরে যাওয়া প্রশাসন, বিচার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এই সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। এসবের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি এবং জনজীবন বহুমুখী সংকটে মানুষের জীবন কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব থেকে দ্রুত মুক্তি নেই জেনেও মানুষ দেখতে চায় সরকার বা উপদেষ্টারা চেষ্টা করছেন এবং কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের কথা ও কাজগুলো ফলপ্রসূ হোক, সেটা দেখতে চায় মানুষ। মানুষ আশাবাদী হতে চায়।
স্বাধীনতার পর ৫০ বছরের বেশি সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় আমরা বলতে পারি, কোনো সরকারের আমলেই দেশে সাংবাদিকতা বাধাহীন ও স্বাধীন ছিল না। আমরাও স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারিনি।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
এসব রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সফল হতে হলে সমাজের সর্বত্র উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সব গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিষয়ে আরও খোলামেলা আলোচনা হতে হবে বাধাহীনভাবে। সে জন্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি করে মত ও সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োজন এখন। মুক্ত আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বা উপদেষ্টারা সজাগ আছেন বলে আমরা মনে করি। তাঁরা এসব নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা দেখছি কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচারণা চালাচ্ছেন। সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছেন। এই সবকিছুই দেশের স্বাধীন সংবাদপত্রের কাজে ও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
আসলে বিগত স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের আমলে সাংবাদিকতা, সংবাদপত্র বা প্রচারমাধ্যম নিয়ে যা চলছিল, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। সে রকম ব্যবস্থা আর চলতে পারে না।মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য আমরা বিগত স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে এসব নিয়ে কথা বলেছি। আন্দোলন করেছি। এ সময় যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষত মেরামতের চেষ্টা চলছে, তখন এ ধরনের কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এতে সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষতি ছাড়া ভালো কিছুর সম্ভাবনা নেই।
স্বাধীনতার পর ৫০ বছরের বেশি সাংবাদিকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় আমরা বলতে পারি, কোনো সরকারের আমলেই দেশে সাংবাদিকতা বাধাহীন ও স্বাধীন ছিল না। আমরাও স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারিনি। আর আমরা সব সরকারের আমলেই নির্যাতনের মুখে পড়েছি। আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। জেলায় জেলায় আদালতে যেতে হয়েছে হাজিরা দিতে। প্রথম আলো ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে এখনো প্রায় ২৫টি মামলা চলমান রয়েছে। একসময় মামলার সংখ্যা ছিল এক শর বেশি। তবে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে আমরা সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হয়েছি, বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে প্রথম আলোর সাংবাদিকতার কাজ।
এ রকম অবস্থার মধ্যে আর আমরা যেতে চাই না। আমরা পরিবর্তন চাই। সে জন্য আমাদের এখন রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় অনেক সংস্কারের কাজ করতে হবে। সে জন্য স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সাহসের সঙ্গে আমাদের সাংবাদিকতার কাজই করে যেতে হবে।
১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র ধর্মঘট আর মিছিলের কথা। সেদিন আমাদের স্লোগান ছিল—কথা বলার অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, গণতন্ত্র চাই, নির্বাচন চাই। আজ ৬২ বছর পর আবার আমাদের সেই একই দাবি তুলতে হচ্ছে; কথা বলার অধিকার চাই, সাংবাদিকের ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই। নির্বাচন চাই, গণতন্ত্র চাই।
শুধু সাইবার নিরাপত্তা আইন নয়, বিগত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার নতুন নতুন আরও চার-পাঁচটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এসবের প্রতিটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পথে বাধা সৃষ্টি করবে বলে সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশকেরা মতামত দিয়েছিলেন। সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার জন্য দাবি জানিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক সরকার তার অবস্থানে অনড় ছিল। এভাবেই বিগত স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। নির্বাসিত হয়েছে গণতন্ত্র।
আসলে বিগত স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের আমলে সাংবাদিকতা, সংবাদপত্র বা প্রচারমাধ্যম নিয়ে যা চলছিল, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। সে রকম ব্যবস্থা আর চলতে পারে না। সে জন্য বারবার মনে পড়ে যায়, সেই ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র ধর্মঘট আর মিছিলের কথা। সেদিন আমাদের স্লোগান ছিল—কথা বলার অধিকার চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, গণতন্ত্র চাই, নির্বাচন চাই। আজ ৬২ বছর পর আবার আমাদের সেই একই দাবি তুলতে হচ্ছে; কথা বলার অধিকার চাই, সাংবাদিকের ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই। নির্বাচন চাই, গণতন্ত্র চাই।
* মতিউর রহমান: প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক