মহামারি, যুদ্ধ ও জলবায়ু পরিবর্তন—এই ত্রয়ী প্রভাবে বর্তমান বিশ্ব অন্যতম প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট এবং গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা গোটা বিশ্বে দুর্ভিক্ষের সংকেত দিচ্ছে। যদিও মহামারি ও যুদ্ধ তুলনামূলকভাবে নতুন ঘটনা; জলবায়ু পরিবর্তন তো কয়েক দশক ধরে চলমান। কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন খাদ্যনিরাপত্তা, খাদ্যের গুণমান এবং পুষ্টিকে প্রভাবিত করছে, তা এই আলোচনার বিষয়।
মানহীন খাদ্য অসুস্থতা ও মৃত্যুর অন্যতম কারণ। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে প্রায় ৬৯ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৮৪ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে (এফএও–২০২০)। ২০২০ সালের হিসাবে, ৫ বছরের কম বয়সী ১৫ কোটি শিশু খর্বতার শিকার হয়েছিল এবং অপ্রতুল ও নিম্নমানের খাদ্যাভ্যাসের কারণে সাড়ে ৪ কোটি কৃশতায় আক্রান্ত ছিল। একই সঙ্গে ২০২০ সালে ৫ বছরের কম বয়সী ৩ দশমিক ৯ কোটি শিশুর ওজন বেশি ছিল (ডব্লিউএইচও ২০২১)। এসব প্রবণতা অসমতা এবং টেকসই নয় এমন খাদ্যব্যবস্থার কারণে হয়, যা সবার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা এবং পুষ্টির প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়া অন্যান্য বাহ্যিক ধাক্কা যেমন কোভিড-১৯ মহামারি খাদ্যব্যবস্থাকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে আরও বেশি মানুষকে অপুষ্টির আওতায় নিয়ে এসেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়ার ঘটনা যেমন খরা, বন্যা, দাবদাহ, মাটির নিম্ন-উর্বরতা হেতু উৎপাদন হ্রাস, বৃষ্টির অস্বাভাবিক ধরন এবং ভারী সার ব্যবহার থেকে অ্যাসিড বৃষ্টি ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্কিত। এই দুষ্টচক্র সব ধরনের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং অপুষ্টি, পরিবেশের ক্ষতি, পানির অভাব এবং নতুন নতুন মানুষ, উদ্ভিদ ও প্রাণীর রোগের উদ্ভব ঘটায়।
জলবায়ু পরিবর্তন সরাসরি মাটির উর্বরতা, বৃষ্টির ধরন, ফসলের ফলন এবং খাদ্য উৎপাদন, পুষ্টি উপাদান এবং পুষ্টির জৈব উপলভ্যতাকে প্রভাবিত করে পুরো খাদ্যব্যবস্থাকে বিরূপ করে। এসব পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহে ম্যাক্রো এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট হ্রাস করে। পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে আরও সমস্যা যেমন কীটপতঙ্গ দ্বারা খাদ্যশৃঙ্খলের বিভিন্ন পর্যায়ে নষ্ট হওয়া এবং খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ায়।
খাদ্যব্যবস্থার আওতায় উৎপাদন, সংগ্রহ, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ, বণ্টন, বাণিজ্য ও বিপণন, নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যের ব্যবহার এবং পুষ্টি ও স্বাস্থ্য, আর্থসামাজিক এবং পরিবেশের ফলাফল অন্তর্ভুক্ত।
নব্যপ্রস্তর বিপ্লবে কৃষির আবির্ভাব প্রধানত উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্যের দিকে মোড় নেয়। খাদ্যব্যবস্থা আরও বিকশিত হয়েছে নগরায়ণ, খাদ্য সঞ্চয় ও পরিবহনব্যবস্থা, বাণিজ্য রুট এবং ভোক্তা চাহিদার উন্নয়নের সঙ্গে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রক্রিয়াজাত, শক্তি ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট —ঘন খাবারের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং পরিবহনে বিপ্লব ঘটিয়েছে।
খাদ্যব্যবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে একটি পারস্পরিক এবং চক্রাকার মিথস্ক্রিয়া রয়েছে। গত ৪০ বছরের মধ্যে কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে এবং খাদ্য সরবরাহশৃঙ্খলের বিশ্বায়ন হয়েছে। ব্যাপক খাদ্য উৎপাদনের উদ্যোগ (যেমন, সার ব্যবহার, সম্প্রসারিত শস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদন) এবং বন উজাড়ের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে গেছে, যা প্রকৃতপক্ষে খাদ্য উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।
এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, শিক্ষা এবং সমৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী মাংসের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়। উচ্চ আয়ের দেশগুলো নিম্ন আয়ের দেশগুলোর তুলনায় প্রায় ৬ গুণ বেশি দুগ্ধজাত পণ্য এবং মাথাপিছু ৯ গুণ বেশি ডিম ব্যবহার করে। ২০১০ ও ২০৫০ সালের মধ্যে প্রাণিসম্পদ ও দুগ্ধজাত খাদ্যের বৈশ্বিক চাহিদা যথাক্রমে ৭০ ও ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হয়। পশ্চিমা বিশ্বে এবং ক্রমবর্ধমান আয় ও নগরায়ণের সঙ্গে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়ও প্রাণিজ উৎসের খাবার বেশি খাওয়া হচ্ছে। একই সময়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্যের সংজ্ঞা নিয়েও বিভ্রান্তি হয়েছে। বলা হয়, পশ্চিম এবং লাতিন আমেরিকান খাদ্য এশিয়া এবং সাব-সাহারান আফ্রিকার তুলনায় স্বাস্থ্যকর। কিন্তু তা বিশ্বব্যাপী অপুষ্টির দ্বৈত বোঝা বৃদ্ধি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ। কারণ, পশ্চিম ও লাতিন আমেরিকায় অতি ওজন ও স্থূলতার হার বেশি। অপর দিকে দাবি করা হয়, প্রক্রিয়াবিহীন ও নিরামিষ খাবার দীর্ঘায়ু এবং খাদ্যসম্পর্কিত অসংক্রামক রোগের নিম্নহারসহ বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যসুবিধা প্রদান করে।
৫০ বছর ধরে সীমিত ফসলি কৃষি প্রচলিত শস্য ও উদ্যানজাত ফসলের ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, যার ফলে দেশীয় ও ঐতিহ্যবাহী খাদ্যশস্যের ক্ষতি হয়েছে। আজ মানুষের খাদ্যের ৮০-৯০ শতাংশ ১২ থেকে ২০ প্রজাতির ওপর নির্ভরশীল এবং শুধু তিনটি—চাল, ভুট্টা ও গম প্রায় ৬০ শতাংশ ক্যালরি এবং উদ্ভিদ প্রোটিনের উৎস (এফএও)।
কৃষি উৎপাদনকে তাই গত অর্ধশতাব্দীর ‘সবুজ বিপ্লব’ প্রযুক্তির বাইরেও কৌশল গ্রহণ করতে হবে। যদিও এ ধরনের কৌশলগুলো ব্যাপক দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে উপকারী ছিল, কিন্তু কৃষি–রাসায়নিকের অনুপযুক্ত ও অত্যধিক ব্যবহার, অদক্ষ সেচব্যবস্থার মাধ্যমে পানির অপচয়, উপকারী জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি এবং হ্রাসকৃত ফসলবৈচিত্র্য খাদ্যব্যবস্থায় ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই–অক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যের পুষ্টি উপাদান পরিবর্তন করে মানুষের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে। উচ্চ মাত্রার কার্বন ডাই–অক্সাইডের ফলে ফসলের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে বটে, কিন্তু উদ্ভিদের প্রোটিন উপাদান এবং ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং জিঙ্কের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস হ্রাস করে। উচ্চতর কার্বন ডাই–অক্সাইড পরিবেশে উৎপাদিত হওয়া বেশির ভাগ ফসলের (ছোলা, ভুট্টা, আখ ইত্যাদি ছাড়া) ভোজ্য অংশে নাইট্রোজেন এবং প্রোটিনের ঘনত্ব হ্রাস পায়।
ক্রমবর্ধমান প্রাণিজ খাদ্য ব্যবহার এবং পরিবেশগত স্বাস্থ্যের মধ্যে একটি বিপরীত সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ প্রাণিজ খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া পরিবেশের ওপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। এটি বৈশ্বিক পুষ্টির অবস্থার উন্নতির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, কেননা প্রাণিজ উৎসের খাবার গ্রহণের সঙ্গে ছোট শিশুদের উন্নত বৃদ্ধি এবং বিকাশ যুক্ত। কারণ, প্রাণিজ খাবার থেকে প্রোটিন এবং আয়রনের মতো পুষ্টির জৈব উপলভ্যতা বেশি।
বিকল্প প্রোটিন উৎস যেমন উদ্ভিদ প্রোটিন, ভোজ্য পোকামাকড়, সামুদ্রিক শৈবাল, অণু শ্যাওলা এবং কোষ কালচারভিত্তিক প্রোটিন কম পরিবেশগত ক্ষতচিহ্ন রাখতে পারে।
কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে অপুষ্টির প্রতিকারের পূর্বের প্রচেষ্টাগুলো ক্যালরির পর্যাপ্ততা অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু কোটি কোটি মানুষ এখনো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এবং প্রোটিনের ঘাটতিতে ভুগছে। পদ্ধতিসমূহ যেমন বায়োফোর্টিফিকেশন (অর্থাৎ জেনেটিক নির্বাচনের মাধ্যমে ফসলের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট উপাদানের বৃদ্ধি), ফোর্টিফিকেশন (আনুষ্ঠানিক এবং কারখানায় সাধারণ ভোজ্য পণ্যগুলোয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সংযোজন) এবং সম্পূরক হিসেবে (ফার্মাসিউটিক্যাল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ফর্ম) জনস্বাস্থ্য পুষ্টির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটায়।
বায়োফোর্টিফিকেশন হলো একটি প্রক্রিয়া, যা প্রধান ফসলের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট উপাদান বাড়ানোর জন্য কৃষিপদ্ধতি (যেমন, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার), প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজনন এবং/অথবা জেনেটিক পরিবর্তন করে। এটি ফসল সংগ্রহের সময় উচ্চতর পুষ্টি নিশ্চিতকারী একটি খাদ্যভিত্তিক কৌশল।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টির প্রয়োজনে খাদ্য সমৃদ্ধকরণ এমন একটি কৌশল, যা বৃহৎ কেন্দ্রীভূত খাদ্য-শিল্প দ্বারা উৎপাদিত মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বাহক হিসেবে বিদ্যমান খাদ্যপণ্য ব্যবহার করে। ভুট্টার আটা, তেল, চাল, লবণ এবং গমের আটা হলো প্রাথমিক খাদ্যবাহন, যা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করতে ব্যবহৃত হয়।
তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যাদের, এমন জনসংখ্যা প্রায়ই পণ্যগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। একই সঙ্গে একাধিক পদ্ধতি একই জনগোষ্ঠীকে উদ্দিষ্ট করে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে তা সম্ভাব্য অনিচ্ছাকৃত অতিরিক্ত মাত্রার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
সর্বোপরি, উপরোক্ত সুপারিশগুলোর প্রভাব মূল্যায়ন করার জন্য জলবায়ু-উপযোগী সমাধান ও বিবেচনা প্রয়োজন। বিবেচ্য বিষয় হলো, ফসলের উচ্চফলন বনাম পুষ্টি উপাদান এবং জৈব উপলভ্যতা এবং বর্ধিত প্রাণিজ খাদ্যগ্রহণ বনাম পরিবেশগত ক্ষতচিহ্ন। আরও স্বাস্থ্যকর, টেকসই খাদ্যব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ভারসাম্যমূলক পদ্ধতি; পরিবর্তিত খাদ্য গ্রহণ আচরণের কারণে অনিচ্ছাকৃত স্বাস্থ্যপরিণতি; এবং ক্রস–কাটিং সমস্যা যেমন জেন্ডার, নগরায়ণ এবং খাদ্য অপচয় বিবেচনায় আনা জরুরি।
মো. মহসীন আলী পুষ্টি বিশেষজ্ঞ