প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। গত ৫০ বছরে এ সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন শুধু ‘তাত্ত্বিক’ বিষয় নয়, সব সময় এর একটি প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য থাকে। সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সংকট, যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা, সামরিক শাসন, সরকারগুলোর কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা—এ সবকিছুই সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে আট পর্বের এই লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রতি রোববার প্রকাশিত হচ্ছে। আজ চতুর্থ পর্ব।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর, সেদিনই তাঁর সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতির সেই দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল। সেই হিসেবে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা, কিন্তু হলেন মোশতাক আহমদ। ঘটনাক্রম থেকে ধারণা করা যায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে যুক্ত সেনা কর্মকর্তারা মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বানানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন।
মোশতাক ক্ষমতায় এসে যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন, তার প্রায় বেশির ভাগ সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন। মোশতাকের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলেও বাস্তবে তখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে যুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের নির্দেশে। ’৭৫ সালের ২০ আগস্ট মোশতাক আহমদ ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা (রেট্রোস্পেকটিভ ইফেক্ট) দিয়ে সামরিক আইন জারি করেন। এতে ১৫ আগস্ট থেকে দেশে সামরিক আইন বলবৎ হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময়টা বাংলাদেশের জন্য একদিকে যেমন ছিল ব্যাপক ঘটনাবহুল, তেমনি ছিল অনিশ্চয়তায় ভরপুর। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিন পর ২২ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৪ আগস্ট জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিতে ২৬ সেপ্টেম্বর মোশতাক আহমদ ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ জারি করেন। ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ৪ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এই অভ্যুত্থানের ফল হিসেবে ৮৩ দিন ক্ষমতায় থাকার পর মোশতাক রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারিত এবং জিয়াউর রহমান আটক হন। ৬ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে পাল্টা-অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান মুক্ত এবং খালেদ মোশাররফসহ বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। এভাবে পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থানের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।
বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি হলেও ’৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর জিয়াই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। এ বিষয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর বিএনপি: সময়-অসময় বইয়ে লিখেছেন, ‘কাগজে-কলমে বিচারপতি সায়েম যুগপৎ রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেও ক্ষমতার নাটাইটা ছিল উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়ার হাতে। জিয়া সিদ্ধান্ত দিতেন, সেই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপতির নামে প্রচারিত হতো। দেশে সামরিক আইন থাকলে, সেনাবাহিনীর হাতেই কর্তৃত্ব থাকে এবং সেনাপ্রধান সেই কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেন, এটা একটা সাধারণ ফর্মুলা।’ ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন।
জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই বছরের ৩০ মে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটের উদ্দেশ্য ছিল জিয়ার ওপর জনগণের আস্থা আছে কি না, তা জানতে চাওয়া। সেখানে তিনি প্রায় ৯৯ ভাগ ভোট পেয়েছেন বলে সরকারিভাবে দেখানো হয়। এরপর ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনের আগে তিনি তাঁর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে দিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি দল এবং আরও কিছু দলের সঙ্গে জোটভুক্ত হয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেন। ওই নির্বাচনে জিয়া বিরাট ব্যবধানে জয়ী হন। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোকে নিয়ে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করে আনুষ্ঠানিকভাবে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন এবং সেই দলকে নির্বাচনে জিতিয়ে নিয়ে আসার নজির স্থাপন করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি ২০৭টি পায়। ২ এপ্রিল সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ৬ এপ্রিল সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় এবং সেদিনই সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস হয়।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীটি এর আগের সংশোধনীগুলো থেকে ভিন্নতর। কারণ, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সরাসরি সংবিধানের কোনো বিধান পরিবর্তন, সংশোধন বা বাতিল করা হয়নি। সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন ফরমান ও আদেশবলে সংবিধানের যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সেগুলোর বৈধতা দেওয়া হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান পঞ্চম সংশোধনী বিলটি উত্থাপন করেছিলেন। পঞ্চম সংশোধনী আইনে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদ যুক্ত করে বলা হয়, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, ও অন্যান্য আইন, এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোন সংবিধানে যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা, ...কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’
পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চারটি সামরিক ফরমান (ফার্স্ট মার্শাল ল প্রক্লেমেশন) জারি করা হয়েছিল।
প্রথম ফরমান: ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমদ ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে প্রথম সামরিক ফরমান জারি করেন। এই ফরমানে বলা হয়, ১. রাষ্ট্রপতি সময়ে-সময়ে সামরিক আইন, প্রবিধান ও আদেশ (মার্শাল ল অর্ডার) জারি করতে পারবেন; ২. এই ফরমান ও ফরমান কর্তৃক প্রণীত সামরিক আইন, প্রবিধান ও আদেশ সাপেক্ষে সংবিধান বলবৎ থাকবে এবং ৩. সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, সামরিক আইন, প্রবিধান, আদেশ ইত্যাদি বলবৎ ও কার্যকর থাকবে।
দ্বিতীয় ফরমান: ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বিচারপতি সায়েমের কাছে হস্তান্তর করেন। ৮ নভেম্বর জারি করা দ্বিতীয় ফরমানের মাধ্যমে বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ও সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন। এই ফরমানের মাধ্যমে ১. সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়; ২. সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ স্থগিত করা হয়; ৩. সংবিধানের ষষ্ঠ-ক ভাগ বিলুপ্ত করা হয় এবং ৪. রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিভিন্ন সময়ে আদেশ দ্বারা এই ফরমান সংশোধন করতে পারবেন বলে বিধান করা হয়।
তৃতীয় ফরমান: ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর বিচারপতি সায়েম এক ঘোষণার মাধ্যমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব জিয়ার কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও ছেড়ে দেন। জিয়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে সামরিক আদেশ জারি করেন। এই আদেশের ফলে সংবিধানের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয়।
চতুর্থ ফরমান: ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল চতুর্থ ফরমানের মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
লক্ষণীয় হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে দেশে সামরিক আইন জারি করা হলেও সংবিধান বাতিল করা হয়নি। সংবিধানকে সামরিক আইনের ‘অধীনে’ রাখা হয় এবং বিভিন্ন সামরিক ফরমান ও আদেশের মাধ্যমে ইচ্ছেমতো সংবিধান পরিবর্তন করা হয়। সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে এসব পরিবর্তন বা সংশোধন ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। কিন্তু সংবিধানের এসব পরিবর্তন বা সংশোধন নিয়ে যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারেন; কিংবা আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারেন, সে কারণে পঞ্চম সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের তাৎপর্যপূর্ণ যে পরিবর্তনগুলো হয়েছিল, তা হলো: ১. সংবিধানের শুরুতে প্রস্তাবনার ওপরে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)’ কথাগুলো সংযোজন করা হয়; ২. ‘বাঙালি’ জাতিকে ‘বাংলাদেশি’ নামে আখ্যায়িত করা হয়; ৩. রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়ে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’কে রাষ্ট্রীয় ‘সকল কাজের ভিত্তি’ বলা হয়; ৪. রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যায় বলা হয়, সমাজতন্ত্র বলতে বোঝাবে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’; এবং ৫. সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান আনা হয়।
পঞ্চম সংশোধনী শুধু সামরিক শাসনকেই বৈধতা দেয়নি, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া সংবিধানের দার্শনিক ভিত্তি ও মূলনীতিগুলো পাল্টে দিয়েছিল। পঞ্চম সংশোধনী নিয়ে বাংলাদেশ পলিটিকস: প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ বইয়ে রওনক জাহান লিখেছেন, ‘সংবিধানের এ সংশোধনী চারটি মৌলিক আদর্শে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনে; এই মৌলিক আদর্শগুলো হলো, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সংশোধনীটির ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া থেকে বিরত হয় এবং সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার দুর্বল হয়ে পড়ে।’ রওনক জাহানের মতে, এই পরিবর্তনগুলোর উদ্দেশ্য ছিল মূলত ডানপন্থীদের সমর্থন পাওয়া। তাঁর এ কথাকে কোনোভাবেই অযৌক্তিক বলা যাবে না। কারণ, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল।
২০০৫ সালে হাইকোর্ট পঞ্চম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা ও বাতিল করেন। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কিছু পর্যবেক্ষণসহ সে রায় বহাল রাখেন। লক্ষণীয় হলো, পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত কিছু বিষয় আদালত মার্জনা করে দেন। পরবর্তী সময়ে সংসদও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কিছু বিষয় গ্রহণ করে নেয়। এর ফলে পঞ্চম সংশোধনীর কিছু বিষয় এখনো আমাদের সংবিধানে বহাল রয়েছে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সেনাবিদ্রোহে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পেলেও সংবিধান অনুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা ছিল। বিএনপির মধ্যে মতভিন্নতা সত্ত্বেও সাত্তারই শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দলটির মনোনয়ন পান। তখন এক নতুন বিপত্তি দেখা দেয়। সংবিধান অনুযায়ী লাভজনক পদে থেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ ছিল না। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর পদ লাভজনক বলা হলেও রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক কি না, সে সম্পর্কে কোনো কিছু উল্লেখ ছিল না। এ কারণে ক্ষমতায় থেকে সাত্তারের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে বৈধতার প্রশ্ন দেখা দেয়। এ রকম অবস্থায় সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘যোগ্য’ বানাতেই সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী পাস করেন বিএনপির সংসদ সদস্যরা। ষষ্ঠ সংশোধনীতে সংবিধানের ৬৬(ক) উপ-অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী হওয়ার কারণে প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলে গণ্য হবেন না।
সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি বানাতে তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ আগ্রহ ছিল। সাত্তারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচনে সাংবিধানিক বাধা এবং বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটাতে এরশাদ নেপথ্যে বড় ভূমিকা রাখেন। মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর বিএনপি: সময়-অসময় বইয়ে লিখেছেন, ‘সেনা নেতৃত্ব, বিশেষ করে জেনারেল এরশাদ ছিলেন গভীর জলের মাছ। তাঁর একটু সময়ের দরকার ছিল, দরকার ছিল দুর্বল প্রকৃতির একজন রাষ্ট্রপতি, যার ওপরে ছড়ি ঘোরানো এবং প্রয়োজনে ছুড়ে ফেলা যাবে। এ ক্ষেত্রে সাত্তার ছিলেন ১ নম্বর পছন্দের।…’
সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনীর মাধ্যমে সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি বানানোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এরশাদ তাঁর ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন। ষষ্ঠ সংশোধনী যেমন নির্দিষ্ট এক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি বানানোর জন্য সংবিধান পরিবর্তনের একটি বিরল উদাহরণ, তেমনি এটি আরেকটি সামরিক শাসনের ক্ষেত্রও প্রস্তুত করেছিল।
তথ্যসূত্র
১. রওনক জাহান, বাংলাদেশ পলিটিকস: প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ, ইউপিএল
২.মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, প্রথমা প্রকাশন