জনমিতিক লভ্যাংশের সদ্ব্যবহার হচ্ছে কি?

অর্থনীতির ভাষায়—সম্পদ সীমিত, চাহিদা অসীম। সীমিত সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমেই সর্বোচ্চ ফল সম্ভব। ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় সর্বত্রই সময় এবং সম্পদের সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব রয়েছে। একটা দেশের অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করে ওই দেশের সম্পদের সঠিক ব্যবহারের ওপর। যে জাতি যত বেশি সময় ও সম্পদের সদ্ব্যবহার করেছে, তারা তত উন্নত। আজকের বিশ্বের উন্নত দেশের দিকে তাকালে উঠে আসে তাদের সময় ও সম্পদের মূল্যায়নের বিষয়টি। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের সম্পদ রয়েছে। যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ, জনসম্পদ ইত্যাদি ।

আমাদের দেশে রয়েছে বিশাল জনসম্পদ। বিবিএসের জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২–এর সমন্বয়কৃত জনসংখ্যার চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২২ হাজার ৯১১ জন। তার মধ্যে ১৫-৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম শ্রমশক্তির সংখ্যা হলো ১১ কোটি ৭ লাখ প্রায়, যা মোট জনসংখ্যার ৬৫.২৩ শতাংশ। এর অর্থ দেশ আজ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশের সুবিধার মধ্যে যাচ্ছে। জনমিতিক লভ্যাংশ হচ্ছে যখন কর্মক্ষম জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগের বেশি থাকে। তখন ওই দেশ জনমিতিক লভ্যাংশের সুবিধা ভোগ করে। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী নয়। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি। জনমিতির হিসাবে, বাংলাদেশ ২০১২ সাল থেকে জনমিতিক লভ্যাংশের যুগে প্রবেশ করে এবং তা ২০৪০ সাল পর্যন্ত বহমান থাকবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, জনমিতিক লভ্যাংশের সুবিধা হচ্ছে শ্রমের সহজলভ্যতা, সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি বৃদ্ধি, মানবপুঁজি ও দেশীয় বাজারের সম্প্রসারণ। এই সুবর্ণ সময় কাজে লাগাতে হবে। এ সময়ের উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া আজ উন্নতির দিকে অনেক দূর এগিয়েছে। আমাদের দেশের এই বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করে দেশের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদন মোতাবেক, বাংলাদেশে বেকার জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। যা কয়েক বছরে দ্বিগুণ হতে পারে। আরেক প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে শিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ৪৭ শতাংশ, যা দেশের জনমিতিক লভ্যাংশের সুবিধা আদায় না করাকে ইঙ্গিত করে। কীভাবে কর্মক্ষম বিশাল জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া সময়ের প্রয়োজন।

২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে জনসম্পদ হতে পারে সর্বোত্তম অস্ত্র। আর সঠিক অস্ত্র উপযুক্ত সময়ে নির্ধারিত জায়গায় প্রয়োগ করতে পারলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। যদিও ইতিমধ্যে সরকার এ লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। তবু কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর যেসব খাতের সর্বাধিক গুরুত্ব রয়েছে, সেখানে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। বিশেষ করে সনদনির্ভর শিক্ষার পরিবর্তে বাস্তবমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা হওয়া উচিত দক্ষতানির্ভর ও বাজারমুখী, যা আমাদের শিখন শেখানোর পদ্ধতিতে লক্ষণীয় নয়।

শিক্ষাকে যুগোপযোগীকরণে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় প্রণোদনা প্রদান ও বাজারমুখীকরণে পদক্ষেপ নিতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিশ্বের শ্রমঘাটতি দেশের সঙ্গে শ্রমশক্তি রপ্তানির লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। উদ্যোক্তাবান্ধব নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি ব্যাংকঋণ সহজীকরণে গুরুত্বারোপ করা জরুরি। যাতে শিক্ষিত বেকারেরা শুধু চাকরির পেছনে না ছুটে নিজে কিছু করার প্রয়াস পান। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির লক্ষ্যেও পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে জোর দিতে হবে।

সর্বোপরি সুপরিকল্পিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনমিতিক লভ্যাংশের সুফল কাজে লাগানো সম্ভব। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। অতএব সময় থাকতে এ সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহারের লক্ষ্যে সুপরিকল্পিত উপায়ে এগোতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিতে হবে জোরালো পদক্ষেপ। দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরে আরও মনোযোগী হতে হবে। অন্যথা এই বিশাল কর্মক্ষম জনসম্পদ দেশের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে।

গিরেন্দ্র চক্রবর্তী

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়