প্রতিক্রিয়া

হাটহাজারীর যে তিন সমস্যা আমাদের খুবই পীড়া দেয়

হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড
হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড

হাটহাজারী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামের মানুষেরা নানা সমস্যা ও ভোগান্তি পোহাচ্ছে। আমার গ্রামের বাড়ি ও পূর্বপুরুষদের বাড়ি হাটহাজারীতে হওয়ায় সেখানে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয় সময়–সুযোগ পেলেই। হাটহাজারীর কেন্দ্রস্থলে আমার বাড়ি, সেখানে গেলেই স্থানীয় বন্ধুবান্ধব ও মুরব্বিরা তিনটি বিষয় ও সমস্যার কথা আমাকে জানান এবং পারলে কিছু করতে ও লিখতে বলেন।

বিষয় তিনটি হলো ১. সড়ক নির্মাণ: হাটহাজারী-রাঙামাটি সড়কের হাটহাজারী অংশের অসমাপ্ত কাজ। ২. হাটহাজারীর কেন্দ্রস্থলে সরকারঘোষিত মডেল মসজিদ নির্মাণ। ৩. সরকার কর্তৃক অবমুক্ত করা ও হাইকোটের রায়ে প্রাপ্ত ভূমি প্রকৃত মালিক ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের নামে নামজারি করতে গড়িমসি ও হয়রানি।

প্রথমত: চার বছর ধরে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের হাটহাজারী অংশ অর্থাৎ হাটহাজারী উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের পূর্ব দিক থেকে সত্তরঘাট পর্যন্ত কাজ অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কিন্তু সত্তরঘাটের ওপারে রাউজান অংশের কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। হাটহাজারী অংশের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ বিভিন্নভাবে ভোগান্তিতে পড়েছে। রাঙামাটি সড়কের হাটহাজারী অংশের কাজ সম্পন্ন করতে এত ধীরগতি ও অবহেলা কেন, হাটহাজারীবাসী তা জানতে চায়।

দ্বিতীয়ত: হাটহাজারীতে মডেল মসজিদ নির্মাণে অসচ্ছতা ও লুকোচুরির অভিযোগ উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করছেন। মডেল মসজিদকে কেন্দ্র করে অনেক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। হাটহাজারীতে মডেল মসজিদ হাটহাজারীর কেন্দ্রস্থলে নির্মাণ করা প্রয়োজন ছিল। মডেল মসজিদ নির্মাণের জন্য একসঙ্গে ৪৩ শতাংশ বা যে পরিমাণ ভূমি প্রয়োজন, সে পরিমাণ ভূমি হাটহাজারী উপজেলা অফিসের অদূরে অনেক ব্যক্তির একক মালিকানায় ছিল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথানিয়মে উদ্যোগ নিলে জমি হুকুম দখল করে হাটহাজারী সদর এলাকার মধ্যেই মডেল মসজিদ নির্মাণ করতে পারত। কিন্তু তা না করে অসৎ প্রকৃতির কিছু লোক প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে বলে বেড়ান, ভূমিমালিকেরা ভূমির মূল্য বাবদ যে টাকা পাবেন, সেখান থেকে একাংশ হুকুম দখল প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের দিতে হবে। এসব কথাবার্তার কারণে হাটহাজারী উপজেলা কেন্দ্রে মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়নি। হাটহাজারীবাসী উপজেলার কেন্দ্রস্থলে মডেল মসজিদ নির্মাণ দেখতে চেয়েছে, তা আর হলো না।

তৃতীয়ত: ১৯৬৭ সালে তদানীন্তন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ওয়্যারলেস ও টেলিযোগাযোগের সুবিধার জন্য ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটিং স্থাপনের লক্ষ্যে হাটহাজারীর সদর ইউনিয়নের ফটিকা মৌজার ১৬৫–এর ফসলি জমি হুকুম দখল করে। এই হুকুম দখলের মামলা নম্বর ছিল—এলএ১৫৩/ ৬৭ (১৯৬৭-১৯৬৮)। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটিং স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত ও বাতিল হয়। বেতবুনিয়া ভূ–উপগ্রহ নির্মাণের পর ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটিং স্টেশন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা পুরোপুরি বাতিল হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে যাওয়ার সময় হাটহাজারী স্কুলের সামনে যাত্রাবিরতি ও স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় পাকিস্তান সরকারের হুকুম দখল করা জমিগুলো ভূমিমালিকদের ফেরত দেওয়ার দাবি উঠলে ‘এ দেশ আর পাকিস্তান হবে না। বাংলার মানুষের জমি বাংলার মানুষকেই ফেরত দেওয়া হবে’ বলে জানান তিনি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর হুকুম দখল করা জমি অবমুক্ত করার বিষয়টি স্থিমিত হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে ডাক বিভাগ জমিগুলো প্রতি ধানি মৌসুমে কানিপ্রতি (২০ গন্ডা) ৫০০ টাকা দরে লাগিয়ত করে ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত ১০ বছরে প্রচুর টাকা আদায় করে। ১০ বছরে ডাক বিভাগের কতিপয় কর্মচারী কানিপ্রতি কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা করে আদায় করেন। ডাক বিভাগের এই অপকর্মের প্রতিবাদে ও ভূমি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ভূমিমালিক ও স্থানীয় জনগণ ১৯৭৯ সালে একটি ভূমি পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি গঠনের পর ডাক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিন বছর ধরে ভূমি পুনরুদ্ধার কমিটির অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোয় ফলপ্রসূ কোনো সমাধান না হওয়ায় ১৯৮৩ সালে কমিটির পক্ষে হাটহাজারী মুন্সেফি আদালতে মামলা (নম্বর-৫৮/ ৮৩) করলে আদালত ভূমিমালিকদের অনুকূলে রায় দিয়ে ন্যায়বিচার করেন। প্রতিপক্ষ ডাক বিভাগ মুন্সেফি আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন মামলা (নম্বর-১০২/ ৮৪) করলে শুনানির পর হাইকোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেন। ইতিমধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় ৬/৭/১৯৮৬ খ্রি. তারিখের স্মারক নম্বর: চ-৩৮/৮৫/১৮৩–এর আদেশ বলে পাকিস্তান সরকারের হুকুম দখল করা ১৬৫ একর জমি অবমুক্ত করে জমিগুলোর প্রকৃত মালিক ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ফেরত দেন।

জমিগুলো আইনগত প্রক্রিয়া ও মন্ত্রণালয়ের আদেশে অবমুক্ত করে দেওয়া হলেও স্থানীয় ভূমি অফিস ভূমিমালিকদের নামে নামজারি করতে গড়িমসি ও হয়রানি করে আসছে। নামজারির জন্য হাটহাজারী ভূমি অফিসে কয়েকটি নামজারি মামলা (নম্বর-২২১৭/ ২০০৮, নম্বর-৩১৬৯/ ২০০৯, নম্বর-১৬৯৪/ ২০১২ আরও আছে বলে শোনা যায়) করা হলেও খতিয়ান সৃজন করে নিষ্পত্তি করা হয়নি। নামজারি হলে ভূমিমালিকেরা ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা পরিশোধ করতে পারতেন। ভূমি অফিসের অসহযোগিতার কারণে ভূমিমালিকেরা ভূমি উন্নয়ন কর দিতে না পারায় সরকার বহু টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। এ ছাড়া হালদা নদীতে নির্মিত স্লুইচগেটের অব্যবস্থাপনার কারণে এই জমিগুলোসহ হাটহাজারীর বিভিন্ন এলাকার শত শত একর জমিতে চাষাবাদ বিঘ্নিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অভিযোগ আছে, স্লুইচগেট তত্ত্বাবধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিজেদের ইচ্ছামতো গেট খুলে ও বন্ধ করে শুধু মাছের লোভে। অনেক সময় তারা পানি বন্ধ করে মাছ মারার জন্য বিষ ছিটিয়ে দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এতে হালদা নদীতে মৎস্য প্রজননও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সময়মতো পানি নিষ্কাশন ও পানি সেচ না হওয়ায় শত শত একর জমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করেও চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।

  • মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত সাবেক নির্বাহী পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এবং উপদেষ্টা, হাটহাজারী সাংবাদিক ফোরাম, চট্টগ্রাম।